3- :
প্রমোদ - উদ্যানে কাঁদে দানব - নন্দিনী
প্রমীলা, পতি - বিরহে কাতরা যুবতী।
অশ্রুআঁখি - বিধুমুখী ভ্রমে ফুলবনে
কভু,ব্রজ - কুঞ্জ - বনে,হায়রে, যেমনি
ব্রজবালা,নাহি হেরি কদম্বের মূলে
পীতধড়া পীতাম্বরে,অধরে মূরলী।
অবচয়ি ফুল - চয়ে সে নিকুঞ্জ বনে,
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি,সখীরে সম্ভাষি
কহিলা প্রমীলা সতী; “এইত তুলিনু
ফুলরাশি; চিকনিয়া গাঁথিনু,স্বজনি,
ফুলমালা;কিন্তু কোথা পাব সে চরণে,
পুস্পাঞ্জলি দিয়া যাহে চাহি পূজিবারে;
কে বাঁধিল মৃগরাজে বুঝিতে না পারি।
চল,সখি, লঙ্কাপুরে যাই মোরা সবে।”
কহিল বাসন্তী সখী;–“কেমনে পশিবে
লঙকাপুরে আজি তুমি? অলঙ্ঘ্য সাগর -
সম রাঘবীয় চমূ বেড়িছে তাহারে;
লক্ষ লক্ষ রক্ষঃ - অরি ফিরিছে চৌদিকে
অস্ত্রপাণি,দন্ডপাণি দন্ডধর যথা”
রুষিলা দানব - বালা প্রমীলা রূপসী;–
“কি কহিলি, বাসন্তি? পর্ব্বত - গৃহ ছাড়ি,
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
দানব - নন্দিনী আমি,রক্ষ - কুল - বধূ;
রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,–
আমি কি ডরাই,সখি,ভিখারী রাঘবে?
পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভূজ - বলে;
দেখিব কেমনে মোরে নিবারে নৃমনি?
যথা বায়ু - সখা সহ দাবানল গতি
দুর্ব্বার,চলিলা সতী পতির উদ্দেশে।
টলিল কনক - লঙ্কা, গর্জ্জিল জলধি;
ঘনঘনাকারে রেণু উড়িল চৌদিকে;–
কিন্তু নিশা - কালে কবে ধূম - পুঞ্জ পারে
আবরিতে অগ্নি - শিখা? অগ্নিশিখা - তেজে
চলিলা প্রমীলা দেবী বামা - বল - দলে।
কতক্ষনে উতরিলা পশ্চিম দুয়ারে
বিধুমুখী। একবারে শত শঙ্খ ধরি
ধ্বনিলা, টঙ্কারি রোষে শত ভীম ধনুঃ,
স্ত্রীবৃন্দ; কাঁপিল লঙকা আতঙ্কে; কাঁপিল
মাতঙ্গে নিষাদী; রথে রথী; তুরঙ্গমে
সাদীবর; সিংহাসনে রাজা;অবরোধে
কুলবধূ; বিহঙ্গম কাঁপিল কুলায়ে;
পর্ব্বত - গহ্বরে সিংহ ; বন - হস্তী বনে
ডুবিল অতল জলে জলচর যত ;
শিবিরে বসেন প্রভু রঘু - চুড়ামণি
করপুটে শূর - সিংহ লক্ষণ সম্মুখে,
পাশে বিভীষণ সখা, আর বীর যত,
রুদ্র - কুল - সমতেজঃ,ভৈরব মুরতি ।
সহসা নাদিল ঠাট; ‘জয় রাম’ - ধ্বনি
উঠিল আকাশ - দেশে ঘোর কোলাহলে,
সাগর - কল্লোল যথা;ত্রস্তে রক্ষোরথী,
দাশরথি - পানে চাহি , কহিলা কেশরী,–
“চেয়ে দেখ,রাঘবেন্দ্র, শিবির - বাহিরে ।
নিশীথে কি ঊষা আসি উতরিলা হেথা?”
বিস্ময়ে চাহিলা সবে শিবির - বাহিরে।
“ভৈরবীরূপিণী বামা,” কহিলা নৃমণি,
“দেবী কি দানবী,সখে, দেখ নিরখিয়া ;
মায়াময় লঙ্কা - ধাম; পূর্ণ ইন্দ্রজালে ;
কামরূপী তবাগ্রজ। দেখ ভাল করি;
এ কুহক তব কাছে অবিদিত নহে।
শুভক্ষণে, রক্ষোবর,পাইনু তোমারে
আমি। তোমা বিনা,মিত্র,কে আর রাখিবে
এ দুর্ব্বল বলে,কহ,এ বিপত্তি - কালে?
রামের চির - রক্ষণ তুমি রক্ষঃপুরে ;”
হেনকালে হনু সহ উতরিলা দূতী
শিবিরে। প্রণমি বামা কৃতাঞ্জলিপুটে,
( ছত্রিশ রাগিণী যেন মিলি এক তানে; )
কহিলা; “প্রণমি আমি রাঘবের পদে,
আর যত গুরুজনে;— নৃ - মুন্ড - মালিনী
নাম মম;দৈত্যবালা প্রমীলা সুন্দরী,
বীরেন্দ্র - কেশরী ইন্দ্রজিতের কামিনী,
তাঁর দাসী।” আশীষিয়া, বীর দাশরথি
সুধিলা; “কি হেতু,দূতি, গতি হেথা তব?
বিশেষিয়া কহ মোরে, কি কাজে তুষিব
তোমার ভর্ত্রিনী,শুভে ? কহ শীঘ্র করি;”
উত্তরিলা ভীমা - রূপী; “বীর - শ্রেষ্ঠ তুমি,
রঘুনাথ; আসি যুদ্ধ কর তাঁর সাথে;
নতুবা ছাড়হ পথ; পশিবে রূপসী
স্বর্ণলঙ্কাপুরে আজি পূজিতে পতিরে ।”
এতেক কহিয়া বামা শিরঃ নোয়াইলা,
প্রফুল্ল কুসুম যথা ( শিশির মন্ডিত )
বন্দে নোয়াইয়া শিরঃ মন্দ - সমীরণে ;
উত্তরিলা রঘুপতি ;”শুন, সুকেশিনী,
বিবাদ না করি আমি কভু অকারণে।
অরি মম রক্ষ - পতি ;তোমরা সকলে
কুলবালা,কুলবধূ; কোন অপরাধে
বৈরি - ভাব আচরিব তোমাদেরসাথে?
আনন্দে প্রবেশ লঙ্কা নিঃশঙ্ক হৃদয়ে”।
এতেক কহিয়া প্রভু কহিলা হনুরে;–
“দেহ ছাড়ি পথ, বলি। অতি সাবধানে,
শিষ্ট আচরণে তুষ্ট কর বামা - দলে।”
প্রণমিয়া সীতানাথে বাহিরিলা দূতী
হাসিয়া কহিলা মিত্র বিভীষণ “দেখ,
প্রমীলার পরাক্রম দেখ বাহিরিয়া,
রঘুপতি;দেখ, দেব, অপূর্ব কৌতুক।
না জানি এ বামা - দলে কে আঁটে সমরে
ভীমারূপী, বীর্য্যবতী চামুন্ডা যেমতি–
রক্তবীজ - কুল - অরি?” কহিলা রাঘব;–
” চল, মিত্র, দেখি তব ভ্রাতৃ - পুত্র - বধূ।”
যথা দূর দাবানল পশিলে কাননে,
অগ্নিময় দশ দিশ ;দেখিলা সম্মুখে
রাঘবেন্দ্র বিভা - রাশি নির্ধূম আকাশে,
সুবর্নি বারিদপুঞ্জে ;শুনিলা চমকি
কোদন্ড - ঘর্ঘর ঘোর,ঘোড়া - দড়বড়ি,
হুহুঙ্কার,কোষে বদ্ধ অসির ঝনঝনি।
সে রোলের সহ মিশি বাজিছে বাজনা,
ঝড় সঙ্গে বহে যেন কাকলী লহরী;
উড়িছে পতাকা —রত্ন - সঙ্কলিত - আভা;
মন্দগতি আস্কন্দিতে নাচে বজী রাজী;
বোলিছে ঘুঙ্ঘুরাবলী ঘুনু ঘুনু বোলে।
গিরিচূড়াকৃতি ঠাট দাঁড়ায় দুপাশে
অটল,চলিছে মধ্যে বামা - কুল - দল;
উপত্যকা - পথে যথা মাতঙ্গিনী - যূথ,
গরজে পূরিয়া দেশ, ক্ষিতি টলমলি।
সর্ব - অগ্রে উগ্রচন্ডা নৃ - মুন্ডমালিনী,
কৃষ্ণ - হয়ারূঢ়া ধনী, ধ্বজ - দন্ড করে
হৈমময় ; তার পাছে চলে বাদ্যকরী,
বিদ্যাধরী - দল যথা, হায় রে ভূতলে
অতুলিত; বীণা বাঁশী, মৃদঙ্গ, মন্দিরা -
আদি যন্ত্র বাজে মিলি মধুর নিক্কণে;
তার পাছে শূল - পাণি বীরাঙ্গনা - মাঝে
প্রমীলা,তারার দলে শশিকলা যথা;
চলি গেলা বামাকুল। কেহ টঙ্কারিলা
শিঞ্জিনী; হুঙ্কারি কেহ উলঙ্গিলা অসি;
আস্ফালিলা শূলে কেহ ;হাসিলা কেহ বা
অট্টহাসে টিটকারি ;কেহ বা নাদিলা,
গহন বিপিনে যথা নাদে কেশরিণী,
বীর - মদে, কাম - মদে উন্মাদ ভৈরবী;
লক্ষ্য করি রক্ষোবরে ,কহিলা রাঘব;–
” কি আশ্চর্য্য, নৈকষেয়? কভু নাহি দেখি,
কভু নাহি শুনি হেন এ তিন ভুবনে;
নিশার স্বপন আজি দেখিনু কি জাগি?”
উত্তরিলা বিভীষণ; ” নিশার স্বপন
নহে এ,বৈদেহী - নাথ,কহিনু তোমারে।
কালনেমি নামে দৈত্য বিখ্যাত জগতে
সুরারি,তনয়া তার প্রমীলা সুন্দরী ।
মহাশক্তি - সম তেজে;দম্ভোলি - নিক্ষেপী
সহস্রাক্ষে যে হর্ষ্যক্ষ বিমুখে সংগ্রামে,
সে রক্ষেন্দ্রে,রাঘবেন্দ্র,রাখে পদতলে
বিমোহিনী,দিগম্বরী যথা দিগম্বরে;”
লঙ্কার কনক - দ্বারে উতরিলা সতী
প্রমীলা। বাজিল শিঙ্গা,বাজিল দুন্দুভি
ঘোর রবে;গরজিল ভীষণ রাক্ষস,
প্রলয়ের মেঘ কিম্বা করীযুথ যথা;
উচ্চৈস্বরে কহে চন্ডা নৃ - মুন্ডমালিনী;—
” কাহারে হানিস্ অস্ত্র,ভীরু,এ আঁধারে ?
নহি রক্ষোরিপু মোরা, রক্ষঃ - কুল - বধূ,
খুলি চক্ষুঃ দেখ চেয়ে।” অমনি দুয়ারী
টানিল হুড়ুকা ধরি হুড় হুড় হড়ে ;
বজ্রশব্দে খুলে দ্বার। পশিলা সুন্দরী
আনন্দে কনক লঙ্কা জয় জয় রবে ।