4- :
নমি আমি,কবি - গুরু তব পদাম্বুজে,
বাল্মীকি;হে ভারতের শিরঃচূড়ামণি,
তব অনুগামী দাস,রাজেন্দ্র - সঙ্গমে
দিন যথা যায় দূর তীর্থ দরশনে;
তব পদ - চিহ্ন ধ্যান করি দিবানিশি,
পশিয়াছে কত যাত্রী যশের মন্দিরে,
দমনিয়া ভব - দম দুরন্ত শমনে—
অমর; শ্রীভর্ত্তৃহরি; সূরী ভবভূতি
শ্রীকন্ঠ;ভারতে খ্যাত বরপুত্র যিনি
ভারতীর, কালিদাস–সুমধুর - ভাষী;
মুরারী - মূরলীধ্বনি - সদৃশ মুরারি
মনোহর;কীর্ত্তিবাস,কীর্ত্তিবাস কবি,
এ বঙ্গের অলঙকার;–হে পিতঃ, কেমনে,
কবিতা - রসের সরে রাজহংস - কুলে
মিলি করি কেলি আমি, না শিখালে তুমি?
গাঁথিব নূতন মালা ,তুলি সযতনে
তব কাব্যদানে ফুল; ইচ্ছা সাজাইতে
বিবিধ ভূষনে ভাষা; কিন্তু কোথা পাব
( দীন আমি; ) রত্নরাজী,তুমি নাহি দিলে,
রত্নাকর ? কৃপা,প্রভু কর আকিন্চনে।
একাকিনি শোকাকুলা, অশোক - কাননে
কাঁদেন রাঘব - বান্ছা আঁধার কুটিরে
নীরবে;দুরন্ত চেড়ী,সতীরে ছাড়িয়া,
ফেরে দূরে মত্ত সবে উৎসব - কৌতুকে–
হীন - প্রাণা হরিণীরে রাখিয়া বাঘিনী
নির্ভয় হৃদয়ে যথা ফেরে দূর বনে
মলিন - বদনা দেবী,হায় রে যেমতি
খনির তিমির গর্ভে ( না পারে পশিতে
সৌর - কর - রাশি যথা ) সূর্য্যকান্ত - মণি;
কিম্বা বিম্বাধরা রমা অম্বুরাশি - তলে;
স্বনিছে পবন, দূরে রহিয়া রহিয়া
উছ্বাসে বিলাপী যথা; লড়িছে বিষাদে
মর্মরিয়া পাতাকুল; বসেছে অরবে
শাখে পাখী; রাশি রাশি কুসুম পড়েছে
তরুমূলে; যেন তরু, তাপি মনস্তাপে,
ফেলিয়াছে খুলি সাজ; দূরে প্রবাহিণী,
উচ্চ বিচী - রবে কাঁদি, চলিছে সাগরে,
কহিতে বারীশে যেন এ দুঃখ - কাহিনী;
না পশে সুধাংশু - অংশু সে ঘোর বিপিনে
ফোটে কি কমল কভু সমল সলিলে ?
তবুও উজ্বল বন ও অপূর্ব্ব রূপে;
একাকিনী বসি দেবী, প্রভা আভাময়ী,
তমোময় ধামে যেন ; হেন কালে তথা
সরমা সুন্দরী আসি বসিলা কাঁদিয়া
সতীর চরণ - তলে,সরমা সুন্দরী–
রক্ষঃকুল - রাজলক্ষী রক্ষোবধূ - বেশে;
কতক্ষনে চক্ষু - জল মুছি সুলোচনা
কহিলা মধুর স্বরে; ” দুরন্ত চেড়ীরা,
তোমারে ছাড়িয়া, দেবি ফিরিছে নগরে,
মহোৎসবে রত সবে আজি নিশা - কালে;
এই কথা শুনি আমি আইনু পূজিতে
পা - দুখানি। আনিয়াছি কৌটায় ভরিয়া
সিন্দুর; করিলে আজ্ঞা,সুন্দর ললাটে
দিব ফোঁটা। এয়ো তুমি, তোমার কি সাজে
এ বেশ ? নিষ্ঠুর,হায়, দুষ্ট লঙ্কাপতি ;
কে ছেঁড়ে পদ্মের পর্ণ ? কেমনে হরিল
ও বরাঙ্গ - অলঙ্কার, বুঝিতে না পারি ?
কৌটা খুলি,রক্ষো বধূ যত্নে দিলা ফোঁটা ।
সীমন্তে ; সিন্দুর বিন্দু শোভিল ললাটে ,
গোধূলি - ললাটে, আহা; তারা - রত্ন - যথা ;
দিয়া ফোঁটা, পদ - ধূলি লইলা সরমা ।
” ক্ষম লক্ষি, ছুইনু ও দেব - আকাঙ্খিত
তনু;কিন্তু চির - দাসী দাসী ও চরণে;”
এতেক কহিয়া পুনঃ বসিলা যুবতী
পদতলে;আহা মরি সুবর্ণ - দেউটি
তুলসীর মূলে যেন জ্বলিল, উজলি
দশ দিশ; মৃদু - স্বরে কহিলা মৈথিলী;—
” বৃথা গন্জ দশাননে তুমি, বিধুমুখী ;
আপনি খুলিয়া আমি ফেলাইনু দূরে
আভরণ,যবে পাপী আমারে ধরিল
বনাশ্রমে। ছড়াইনু পথে সে সকলে,
চিহ্ন হেতু। সেই হেতু আনিয়াছে হেথা–
এ কনক - লঙ্কাপুরে— - ধীর রঘুনাথে ;
মণি,মুক্তা, রতন, কি আছে লো জগতে,
যাহে নাহি অবহেলি লভিতে সে ধনে ?
যথা গোমুখীর মুখ হইতে সুস্বনে
ঝরে পূত বারি - ধারা, কহিলা জানকী,
মধুর ভাষিণী সতী, আদরে সম্ভাষি
সরমারে,—“হিতৈষিণী সীতার পরমা
তুমি,সখি; পূর্ব্ব - কথা শুনিবারে যদি
ইচ্ছা তব,কহি আমি, শুন মনঃ দিয়া ।—
ছিনু মোরা, সুলোচনে, গোদাবরী - তীরে,
কপোত কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষ - চূড়ে
বাঁধি নীড়,থাকে সুখে;ছিনু ঘোর বনে,
নাম পঞ্চবটী,মর্ত্ত্যে সুর - বন - সম।
সদা করিতেন সেবা লক্ষণ সুমতি।
দন্ডক ভান্ডার যার, ভাবি দেখ মনে,
কিসের অভাব তার? যোগাতেন আনি
নিত্য ফল - মূল বীর সৌমিত্রি; মৃগয়া
করিতেন কভু প্রভু; কিন্তু জীব নাশে
সতত বিরত,সখি রাঘবেন্দ্র বলী,—
দয়ার সাগর নাথ ,বিদিত জগতে;
“ভুলিনু পূর্ব্বের সুখ। রাজার নন্দিনী
রঘু - কুল - বধু আমি; কিন্তু এ কাননে,
পাইনু, সরমা সই,পরম পিরীতি ;
কুটীরের চারিদিকে কত যে ফুটিত
ফুলকুল নিত্য নিত্য,কহিব কেমনে?
পঞ্চবটী - বন - চর মধু নিরবধি;
জাগাত প্রভাতে মোরে কহরি সুস্বরে
পিকরাজ;কোন রাণী,কহ; শশিুমুখি,
হেন চিত্ত - বিনোদন বৈতালিক - গীতে
খোলে আঁখি? শিখী সহ । শিখীনি সুখিনী
নাচিত দুয়ারে মোর; নর্ত্তক,নর্ত্তকী,
এ দোঁহার সম, রামা,আছে কি জগতে ?
অতিথি আসিত নিত্য করভ,করভী,
মৃগ - শিশু, বিহঙ্গম,স্বর্ণ - অঙ্গ কেহ,
কেহ, শুভ্র,কেহ কাল,কেহ বা চিত্রিত,
যথা বাসবের ধনুঃ ঘন - বন - শিরে;
অহিংসক জীব যত। সেবিতাম সবে,
মহাদরে; পালিতাম পরম যতনে,
মরুভূমে স্রতোস্বতী তৃষাতুরে যথা,
আপনি সুজলবতী বারিদ - প্রসাদে।
সরসী আরসি মোর ; তুলি কুবলয়ে,
( অতুল রতন - সম ) পরিতাম কেশে ;
সাজিতাম ফুল - সাজে ; হাসিতেন প্রভু,
বনদেবী বলি মোরে সম্ভাষি কৌতুকে ;
হায়, সখি, আর কি লো পাব প্রাণনাথে?
আর কি এ পোড়া আঁখি এ ছার জনমে
দেখিবে সে পা - দুখানি—আশার সরসে
রাজীব ; নয়ন মণি? হে দারুণ বিধি,
কি পাপে পাপী এ দাসী তোমার সমীপে?
এতেক কহিয়া দেবী কাঁদিলা নীরবে ।
কাঁদিলা সরমা সতী তিতি অশ্রু - নীরে।
কতক্ষনে চক্ষু - জল মুছি রক্ষোবধূ
সরমা, কহিলা সতী সীতার চরণে;—
” স্মরিলে পূর্ব্বের কথা ব্যাথা মনে যদি
পাও, দেবী, থাক তবে ; কি কাজ স্মরিয়া ?—
হেরি তব অশ্রু - বারি ইচ্ছি মরিবারে ; ”
উত্তরিলা প্রিয়ম্বদা ( কাদম্বা যেমতি
মধু - স্বরা ) ;–“এ অভাগী,হায়, লো সুভগে,
যদি না কাঁদিবে, তবে কে আর কাঁদিবে
এ জগতে ? কহি, শুন পূর্ব্বের কাহিনী।
বরিষার কালে,সখি,প্লাবন - পীড়নে
কাতর,প্রবাহ,ঢালে,তীর অতিক্রমি,
বারি - রাশি দুই পাশে; তেমতি যে মনঃ
দুঃখিত,দুঃখের কথা কহে সে অপরে।
তেঁই আমি কহি,তুমি শুন,লো সরমে ;
কে আছে সীতার আর এ অবরু - পুরে?
” পঞ্চবটী - বনে মোরা গোদাবরী - তটে
ছিনু সুখে। হায়, সখি,কেমনে বর্ণিব
সে কান্তার - কান্তি আমি ? সতত স্বপনে
শুনিতাম মন - বীণা বন - দেবী - করে;
সরসীর তীরে বসি, দেখিতাম কভু
সৌর - কর - রাশি - বেশে সুরবালা - কেলি
পদ্মবনে; কভু সাধ্ধী ঋষিবংশ - বধূ
সুহাসিনী আসিতেন দাসীর কুটীরে,
সুধাংশুর অংশু যেন অন্ধকার ধামে;
অজিন ( রন্জিত, আহা, কত শত রঙে; )
পাতি বসিতাম কভু দীর্ঘ তরুমূলে,
সখী - ভাবে সম্ভাষিয়া ছায়ায়,কভু বা
কুরঙ্গিনী - সঙ্গে রঙ্গে নাচিতাম বনে,
গাইতাম গীত শুনি কোকিলের ধ্বনি;
নব - লতিকার,সতি দিতাম বিবাহ
তরু - সহ; চুম্বিতাম মন্জরিত যবে
দম্পতী, মন্জরীবৃন্দে আনন্দে সম্ভাষি
নাতিনী বলিয়া সবে; গুন্জরিলে অলি,
নাতিনী - জামাই বলি বরিতাম তারে;
কভু বা প্রভুরর সহ ভ্রমিতাম সুখে
নদী - তটে; দেখিতাম তরল সলিলে
নূতন গগন যেন,নব তারাবলী,
নব নিশাকান্ত - কান্তি ; কভু বা উঠিয়া
পর্ব্বত - উপরে ,সখি বসিতাম আমি
নাথের চরণ - তলে, ব্রততী যেমতি
বিশাল রসাল - মূলে; কত যে আদরে
তুষিতেন প্রভু মোরে, বরষি বচন -
সুধা, হায়, কব কারে ? কব বা কেমনে ?
শুনেছি কৈলাস - পুরে কৈলাস - নিবাসী
ব্যোমকেশ,স্বর্ণাসনে বসি গৌরী - সনে,
আগম,পুরাণ, বেদ, পঞ্চতন্ত্র - কথা
পঞ্চমুখে পঞ্চমুখ কহেন উমারে;
শুনিতাম সেইরূপে আমিও,রূপি,
নানাকথা ; এখনও, এ বিজন বনে,
ভাবি আমি শুনি যেন সে মধুর বাণী ;—
সাঙ্গ কি দাসীর পক্ষে, হে নিষ্ঠুর বিধি,
সে সঙ্গীত ?”—নীরবিলা আয়ত - লোচনা
বিষাদে। কহিলা তবে সরমা সুন্দরী ;—
“শুনিলে তোমার কথা, রাঘব - রমণি,
ঘৃণা জন্মে রাজ - ভোগে ; ইচ্ছা করে,ত্যজি
রাজ্য - সুখ, যাই চলি হেন বনবাসে ;
কিন্তু ভেবে দেখি যদি,ভয় হয় মনে।
রবিকর যবে, দেবি, পশে বনস্থলে
তমোময়,নিজগুনে আলো করে বনে
সে কিরণ; নিশি যবে যায় কোন দেশে,
মলিন - বদন সবে তার সমাগমে;
যথা পদার্পণ তুমি কর, মধুমতি,
কেন না হইবে সুখী সর্ব্ব জন তথা,
জগৎ - আনন্দ তুমি, ভুবন - মোহিনী ;
কহ, দেবি, কি কৌশলে হরিল তোমারে
রক্ষঃপতি? শুনিয়াছে বীণা - ধ্বনি দাসী,
পিকবর - রব নব পল্লব - মাঝারে
সরষ মধুর মাসে ; কিন্তু নাহি শুনি
হেন মধুমাখা কথা কভু এ জগতে;”