ফারদ্‌/ ফরজ এর বিধান

ফারদ্‌/ ফরজ (فرض) কি কি

ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব- এই শব্দগুলো কমবেশি সবার পরিচিত। বিষয়গুলো সম্পর্কে এক ধরনের ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে। এসবের মধ্যে পবিত্র মহাগ্রন্থে মহান আল্লাহ মানুষের জন্য যা কিছু ফরজ বা ফারদা বা নির্ধারণ করেছেনতা উল্লেখ করা হবে।
ফারসি, তুর্কি, উর্দু ও হিন্দি ভাষাতেও ‘ফরজ’ শব্দটি ‘অবশ্য করণীয়’, ‘বাধ্যতামূলক’ অর্থে ব্যবহৃত হয়।
দেখা যায়, মহান আল্লাহ মোহাম্মাদ রাসুল-আল্লাহর জন্য কিছু করণীয় নির্ধারণ করেছিলেন বা ফরজ করেছিলেন–যা অন্যদের জন্য করেন নি। সে ঘোষণা কিতাবেই লিপিবদ্ধ আছে। চলুন দেখা যাক  প্রচলিত অনুবাদে।

১.
মাতা-পিতা এবং আত্মীয়দের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে পুরুষদের অংশ রয়েছে
; আর মাতা-পিতা এবং আত্মীয়দের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছেতা অল্পই হোক আর বেশিই হোক, এক নির্ধারিত অংশ (an obligatory share- مَّفْرُوضًا){৪:৭}

২.
আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তান-সন্ততির (অংশ) সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন, পুরুষ দুই নারীর অংশের সমান পাবে। তবে তারা যদি শুধু দু’জন নারীর অধিক হয় তাহলে তারা রেখে যাওয়া সম্পত্তির তিন ভাগের দু’ ভাগ পাবে, আর কেবল একটি কন্যা থাকলে সে অর্ধেক পাবে এবং তার পিতা-মাতা উভয়ের প্রত্যেকে রেখে যাওয়া সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ পাবে যদি তার সন্তান থাকে, আর যদি তার সন্তান না থাকে এবং তার ওয়ারিশ মাতা-পিতাই হয়, সে অবস্থায় তার মাতার জন্য এক তৃতীয়াংশ, কিন্তু তার ভাই-বোন থাকলে, তার মাতা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ, (ঐসব বণ্টন হবে) তার কৃত ওয়াসীয়াত অথবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমরা জান না তোমাদের পিতা এবং সন্তানদের মধ্যে কে তোমাদের পক্ষে উপকারের দিক দিয়ে অধিকতর নিকটবর্তী। (এ বণ্টন) আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত (An obligation- فَرِيضَةًকরে দেয়া হয়েছে, নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাশীল।  {৪:১১}

৩.
স্বদাকাহ হল ফকির
মিসকীন, কর্মচারীর ওপর, কারও মন জয়ে, দাস/বন্দী মুক্তি, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে ও পথের মানুষের জন্য- এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত (An obligation- فَرِيضَةً)আর আল্লাহ হলেন সর্বজ্ঞ, মহাবিজ্ঞানী। {৯:৬০}

৪.
এ সুরা 
আমি পাঠিয়েছি এবং আমি তা নির্ধারণ করেছি (فرض), আর এতে আমি অবতীর্ণ করেছি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ- যাতে তোমরা মনোযোগ দাও। (২৪:১)

৫.
যিনি তোমার জন্য কুরআনকে নির্ধারিত করেছেন (
فرض), তিনি তোমাকে অবশ্যই ফিরিয়ে নেবেন প্রত্যাবর্তনস্থলে। বলোআমার রব ভাল জানেন কে সৎপথের নির্দেশ এনেছে আর কে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছে। (২৮:৮৫)

৬.
নবীর জন্য সেটা (করতে) কোনো সমস্যা নেই যা আল্লাহ্ নির্ধারণ (فرض) করেছেন তার জন্য। আগে যারা চলে গেছে তাদের ক্ষেত্রেও এটাই ছিল আল্লাহর বিধান। আর আল্লাহ্‌র ফয়াসালা সুনির্ধারিত, অবশ্যম্ভাবী। (৩৩:৩৮)

৭.
….আমরা অবশ্যই জানি মুমিনদের স্ত্রী এবং তাদের মালিকানাধীন দাসীদের সম্বন্ধে তাদের উপর যা নির্ধারণ (فرض) করেছিএটা বিশেষ করে তোমার জন্য, অন্য মুমিনদের জন্য নয়; যাতে তোমার কোনো অসুবিধা না হয়; আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (৩৩:৫০)

সরল ব্যাখ্যা:

এসব আয়াতে দেখা যাচ্ছে মহান আল্লাহ- 

  • ১. সামাজিক উত্তরাধিকার আইন বিস্তারিত বর্ণনা করে, তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন।  
  • ২. সদক্বাহ বা দানের টাকা কোন কোন খাতে ব্যয় করতে হবে- সেই খাতগুলো স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে।  
  • ৩. সুরা নুরে বেশ কিছু বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে; 
  • ৪. মুমিন পুরুষদের স্ত্রী ও অধীনস্থদের অধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে। 
  • ৫. মোহাম্মদ রসুলুল্লাহর জন্য কুরআন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল।

এখন সংক্ষেপে দেখুন সুরা নুরে কী কী বিষয় আছে-

                                                       (আয়াত সংখ্যা: ৬৪, রুকু সংখ্যা: ০৯)

  • অনুচ্ছেদ ১ [আয়াত ১]: সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং বাধ্যতামূলক আইনের একটি সুরা
  • অনুচ্ছেদ ২ [আয়াত ২,৩]: শত কশাঘাত
  • অনুচ্ছেদ ৩ [আয়াত ৪,৫]: আশি কশাঘাত
  • অনুচ্ছেদ ৪ [ আয়াত ৬-৯]: স্বামী/স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ
  • অনুচ্ছেদ ৫ [আয়াত ১০-২৬]: এটা যদি আপনার উপর আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও করুণা না হত!
  • অনুচ্ছেদ ৬ [আয়াত ২৭-২৯]: একটি বাড়ির গোপনীয়তা ও নারীদের পবিত্রতা
  • অনুচ্ছেদ ৭ [আয়াত ৩০,৩১]: পোশাকের নিয়ম
  • অনুচ্ছেদ ৮ [আয়াত ৩২-৩৪]: বিয়ে—যত দ্রুত, তত ভালো
  • অনুচ্ছেদ ৯ [আয়াত ৩৫-৩৮]: আল্লাহ্‌র ঘর/অবস্থান
  • অনুচ্ছেদ ১০ [আয়াত ৩৯,৪০]: আল্লাহ্‌ যাকে আলো দেন না, তার কোন আলো নেই!
  • অনুচ্ছেদ ১১ [আয়াত ৪১-৪৪]: পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ
  • অনুচ্ছেদ ১২ [আয়াত ৪৫,৪৬]: প্রাণীজগতের বিবর্তনের ধারা
  • অনুচ্ছেদ ১৩ [আয়াত ৪৭-৫৭]: আল্লাহ্‌র আনুগত্য করুন এবং রসুলের আনুগত্য করুন
  • অনুচ্ছেদ ১৪ [আয়াত ৫৮-৬০]: ঘরের পোশাক ও শিষ্টাচার– প্রেক্ষিত বেডরুম
  • অনুচ্ছেদ ১৫ [আয়াত ৬১]: ঘরের শিষ্টাচার– প্রেক্ষিত ডাইনিং রুম
  • অনুচ্ছেদ ১৬ [আয়াত ৬২-৬৪]: রসুল সা. এর সমন/আহ্বান

এই সুরাতে আল্লাহ কিছু বিধান দিয়েছেন। পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য উপদেশ। যেমন- সত্য কথা বলা, সত্য সাক্ষ্য দেওয়া, অপবাদ/মিথ্যারোপ না করা, পারিবারিক ও সামাজিক আদব কায়দা মেনে চলা, নারী ও পুরুষকে দৃষ্টি সংযত করা, সামাজিক-শালীনতা রক্ষায় পোশাক পরাঅনুমতি নিয়ে ঘরে ঢোকার মতো শিষ্টাচার শিক্ষা। এসব  ব্যক্তিগতপারিবারিক ও সামাজিক নির্দেশে ও উপদেশে পরিপূর্ণ এই সুরা।

এ ছাড়া, বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে অনুবাদকগণ কুতিবা/ কাতাবা শব্দের অর্থ প্রকাশ করেছেন ফরজ শব্দ দিয়ে যদিওকুতিবা/ কাতাবা শব্দের সরল বাংলা অর্থ হলো লিখে দেওয়া/ prescribe অন্যদিকে এর সঠিক অর্থ, জোর নির্দেশনা-প্ররণা-তাড়ণা দেওয়া। 

বোঝার সুবিধার্থে এখানে সে আয়াতগুলো উল্লেখ করা হলো-

কুতিবা/ কাতাবা/ prescribed :

হে ঈমানদারগণ! নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের উপর কিসাসের বিধান দেওয়া হলো। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতদাসের বদলে ক্রীতদাস, নারীর বদলে নারী। তবে তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে কোনো ক্ষমা প্রদর্শন করা হলে যথাযথ বিধির অনুসরণ করা ও সততার সাথে তার রক্ত-বিনিময় আদায় করা কর্তব্য। এটা তোমাদের রব-এর পক্ষ থেকে শিথিলতা ও অনুগ্রহ। সুতরাং এর পরও যে সীমালঙ্ঘন করে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি। (২:১৭৮)

তোমাদের মধ্যে কারও মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে সে যদি ধন-সম্পত্তি রেখে যায় তবে প্রচলিত ন্যায়নীতি অনুযায়ী তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য অসিয়াত করার বিধান তোমাদেরকে দেয়া হলো। এটা মুত্তাকীদের উপর কর্তব্য (২:১৮০)

হে ঈমানদার! তোমাদেরকে সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো, যেভাবে দেওয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্বেকার লোকেদের জন্যে, যাতে করে তোমরা তাকওয়াবান হতে পারো। (২:১৮৩)

তোমাদের অপ্রিয় হলেও তোমাদের জন্যে যুদ্ধের বিধান দেয়া হলো। হতে পারে, তোমরা কোনো বিষয় অপছন্দ করো, অথচ সেটা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। (২:২১৬)

হে মুমিনগণ! তোমরা যখন একে অন্যের সাথে নির্ধারিত সময়ের জন্য ঋণের আদান-প্রদান কর তখন তা লিখে রেখো। (২:২৮২)

নির্ধারিত সময় আকিমুস সালাত মুমিনদের জন্যে এক লিখিত বিধান। (৪:১০৩)

সারকথা:

পবিত্র কুরআনের মৌলিক নীতি অনুযায়ী- মহান রব যা ফারদ্ فرض বা ফরজ লিখে দিয়েছেনশুধুমাত্র সেসবই ফরজ কাজ বা স্পষ্টভাবে নির্ধারিত কাজ।

মহান রব মানবজাতির কল্যাণে যেসব নিয়ম লিখিত আকারে  দিয়েছেনতা প্রয়োজনীয় আইন-কানুন ও উপদেশ; তা ফরজ বা নির্ধারিত। কিন্তু সবার জন্য বাধ্যতামূলক নয়! এই অবস্থায় সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কার্যক্রমকে “ফরজ” বা “বাধ্যতামূলক” বলা, বাধ্যতামূলক” মনে করাএবং বাধ্যতামূলক” হিসেবে পালন করার কোনো সুযোগ নেই।

এক্ষেত্রে, মহান আল্লাহর নামে নতুন হুকুম/ নিয়ম/ বিধান তৈরি করার অপরাধে শিরকের অমার্জনীয় গুনাহ হবার আশঙ্কা থেকে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *