জাহান্নাম কী ও কোথায় (প্রথম পর্ব)
সুরা আত্ তাহরিমে আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেছেন, হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদের ও পরিবারবর্গকে রক্ষা করো নার (আগুন) থেকে, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর; যাতে আছে মালাইকারা ভীষণ কঠোর! তারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে-না; বরং তাই করে যা নির্দেশ দেওয়া হয়। {৬৬:৬}
ঈমানদার বা বিশ্বাসী লোকদের জন্য পবিত্র মহাগ্রন্থে এই সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, জান্নাতের অপূর্ব বর্ণনা, জান্নাতে যাবার উপায় এবং মহান রবের ক্রোধ থেকে বাঁচার বিস্তারিত উপায় বর্ণনা করা হয়েছে। জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য মু’মিনদের প্রার্থনার কথাগুলো পর্যন্ত শিখিয়ে দিয়েছেন রব্বুল আলামিন—বার বার!
মহান রব্বুল আলামিন পবিত্র কুর’আনে অসংখ্যবার জাহান্নামের কথা বলেছেন, বিভিন্ন আঙ্গিকে আমাদের সামনে বিভিন্ন জাহান্নাম তুলে ধরেছেন। নিশ্চয়ই এর নিগূঢ় তাৎপর্য রয়েছে। শুধুমাত্র ভয়ের কথাই নয়; বরং জাহান্নাম সম্পর্কে এমন সব তথ্য দেওয়া হয়েছে- যা আধুনিক বিজ্ঞানের সহযোগিতায় কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। মহাগ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী বিজ্ঞানের ধারণাগুলোর কোনটা সঠিক এবং কোনটা ভুল—তাও চিহ্নিত করা যায়। স্রষ্টার বিশাল সাম্রাজ্যের একটি অংশ হলো এই জাহান্নাম। জাহান্নাম সম্পর্কে জানলে দৃশ্যমান সৃষ্টিজগতের কিয়দাংশ এবং সৃষ্টিকর্তার শক্তিমত্তার বিশালতা সম্পর্কে যে সম্পূর্ণ ধারণা করা যায় না— তা নিশ্চিত হওয়া যায়। যাতে মানুষের অন্তর আরও কৃতজ্ঞতা ও ভয়ে তাঁর প্রতি নুয়ে পড়ে এবং বিশ্বাসীদের ঈমান মজবুত হয়।
মহাপবিত্র মহাগ্রন্থ-জুড়ে জাহান্নামের এমন অসংখ্য বর্ণনার এ ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে? আমরা তাও জানার চেষ্টা করব।
এই প্রবন্ধে আমরা দেখব:
১. নামকরণ ও সুক্ষ্ম পার্থক্য
২. জাহান্নামের প্রচলিত বর্ণনা
৩. জাহান্নামের অবস্থান
৪. জাহান্নামের অধিবাসী ও তাদের কথোপকথন
৫. মহাকাশের জ্বলন্ত আগুন
৬. জাহান্নাম ও জাহান্নামিদের স্থায়িত্ব
৭. মহাবিশ্বের গঠন প্রকৃতির সঙ্গে জাহান্নামের সম্পর্কের প্রমাণ
তবে, মূল আলোচনায় যাবার আগে কয়েকটি বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার।
প্রথমত, মৃত্যুর পর মানুষের পুনরুত্থান হবে—এটা হলো বিশ্বাস। পুনরুত্থান কীভাবে হবে? মানব দেহের হবে, বা নফসের হবে? নফস দেখতে কেমন? নফসের শাস্তি কীভাবে হয়? নফস আসলে কী?—ইত্যাদি বিষয় প্রধানত বিশ্বাস এবং কিছুটা যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। তাই এসব বিষয়ে যার যত-বেশি স্বচ্ছ ধারণা থাকবে, সে তত-বেশি উপলব্ধি করতে পারবে—যা একজন ইবাদের ঈমান বৃদ্ধিতে সহয়াক।
দ্বিতীয়ত, আযাব বা শাস্তির যে ভয়াবহ বর্ণনা আছে- তা মানবদেহের পক্ষে ধারণ করা সম্ভব না। কিন্তু মানুষের বোঝার উপযোগী করেই আল্লাহ-তা’আলা আগাম জানিয়ে দিয়েছেন। তা আমরা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারি মাত্র। মনে করুন, সূর্যের মতো উত্তপ্ত আগুনে কাউকে ঝলসানো হবে—এ বিষয়টি আসলে কী আমরা উপলব্ধি করতে পারি? যেখানে, মাথার ওপরে থাকা সূর্যের দিকে চোখ তুলে তাকানোও আমাদের জন্য সম্ভব হয়ে ওঠে না!
বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ থেকে জানতে পারি, সূর্য বা অন্যান্য নক্ষত্রের তাপমাত্রা কতটা ভয়াবহ হতে পারে! সেই জানা বিষয়গুলো দীর্ঘ সংখ্যার মতো! তাপের মাত্রা উপলব্ধি করা আমাদের পক্ষে কখনওই সম্ভব না। জাহান্নাম বা নার-এর আগুন কতটা উত্তপ্ত- তা শব্দ-বাক্য দিয়ে কিছুটা সাজানো গেলেও- উপলব্ধির বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করে আপনার-আমার বিশ্বাস, বোধশক্তি ও গুরুত্ব দেওয়ার ওপর।
১. নামকরণ ও সুক্ষ্ম পার্থক্য
১ (ক). ভূমিকা
জাহান্নামের স্রষ্টা তিনিই যিনি জান্নাত তৈরি করেছেন। মহান রব্বুল আলামিনের রহমত তাঁর সৃষ্টির সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত। মহাজগতের প্রভুর রহমত তাঁর ক্রোধের চেয়েও বেশি। এটাই মূলত তাঁর ইবাদ/ দাস বা মানুষের জন্য সবচেয়ে আশার দিক। তিনি বলেছেন-
…আমার শাস্তি যাকে চাই- তাকে দেই; কিন্তু আমার রহমত সব কিছুর উপর পরিব্যাপ্ত…। {৭:১৫৬}
বলে দাও- হে আমার ইবাদ! যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছো, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সব পাপ (আয-যুনুবা) ক্ষমা করেন; নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল, অতীব দয়াবান। {৩৯:৫৩}
সব মানুষই আল্লাহর ইবাদ। ইবাদ যা করে তা ইবাদত। বিস্তারিত দেখুন এখানে।
মহাগ্রন্থ থেকে জানা যায়, মানুষ সৃষ্টির আগেই জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করা হয়েছিল। আদম ও হাওয়াকে সৃষ্টির পর বলা হয়েছিল- প্রবেশ করো জান্নাতে। অর্থাৎ আগে থেকেই জান্নাতের অস্তিত্ব ছিল। মানুষ সৃষ্টির বহু আগেই তৈরি হয়েছিল সামাওয়াত ওয়াল আরদ, জান্নাত, বারজাখ, আরশ; সর্বোপরি অনাদি অনন্তকাল থেকে আছেন মহা পরাক্রমশালী রব্বুল আলামিন। তিনি ছাড়া সব কিছুর শুরু আছে- শেষ আছে; শুধু তাঁরই কোনও শুরু-শেষ নাই। তিনি যেখানে নিজ ইচ্ছার সঞ্চার করেছেন, সেই স্থান আছে; এর বাহিরে কিছু নাই; ‘এর বাহির’ বলতেও কিছু নাই; তাঁর ইচ্ছা ও চাওয়ার শক্তি অসীম; সেই অসীমের কোনও সীমা নাই; এমন কোনও স্থান নাই- যেখানে তিনি দৃষ্টি দেন নি! যেখানে তিনি ইচ্ছা প্রয়োগ করেন নি- সে জায়গাটাই নাই! সেই ‘নাই জায়গাটা’ই-বা কেমন? তেমন কোনও ‘নাই জায়গাও’ আসলে নাই! এই মহাবিস্ময় অনুভব এবং তা প্রকাশের শক্তিও মানুষের নাই।
তিনিই সব কিছু তৈরি করেছেন শূন্য থেকে। আসলে শূন্যস্থানও তাঁর সৃষ্টি। সৃষ্টির শুরুতে ছিল-না কোনও শূন্যস্থান কিংবা মহাশূন্য। মহাশক্তিধর প্রভু তাঁর ‘একক নফস’ থেকে তৈরি করেছেন মহাশূন্য—সময়ের পরিক্রমায় তাঁর শক্তি (ইচ্ছা) থেকে তৈরি হয়েছে জানা-অজানা সবকিছু। সবকিছুই তাঁর; তিনিই আদি-অনন্ত, জানা-অজানার সম্রাট; তিনিই মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী মহান স্রষ্টা, মহাজগতের প্রভু—রব্বুল আলামিন।
সামাওয়াত ওয়াল আরদ-এর বাংলা অর্থ- মহাকাশ ও যমিন-সমূহ। মহাবিশ্বের আকাশ বা তারকা বা গ্যালাক্সির অস্তিত্ব সাত স্তরে সজ্জিত; আর যমিনগুলো হলো নক্ষত্র, নিহারিকা, ধুমকেতু, কোয়াসার, কৃষ্ণগহ্বর তথা জ্বালানি ছাড়া ও অভিকর্ষ বলের টানে ছুটতে থাকা ঘুরতে থাকে গ্রহ- উপগ্রহ বা এমন বস্তু। যাতে মানুষ ও মানুষের সৃষ্টি অবতরণ করতে পারে। মানুষ পা রেখেছে চন্দ্র-পৃষ্ঠে। মানুষের তৈরি নভোযান ঘুরে বেড়াচ্ছে দ্য রেড প্ল্যানেট মঙ্গলগ্রহে। এসবই যমিন।
এমনতর বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন-যিলিয়ন এবং আরও অগনিত যমিন আছে এই মহাবিশ্বে। হাবল টেলিস্কোপ ও নানা অবজারভেটরির রেডিও টেলিস্কোপের সাহায্যে মোটামুটি দুই স্তরের আসমানের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। এর স্তরগুলোর মাঝে রয়েছে ভয়েড বা খালি স্থান যা বোঝা যায়। এই ভয়েডই মূলত আকাশের গ্যালাক্সি ও অন্যান্য উপাদানের উপস্থিতি নিশ্চিত করে।
১ (খ). নামকরণ
কুর’আনে অপরাধীদের শাস্তির স্থান হিসেবে বেশ কয়েকটি নাম পাওয়া যায়। সেগুলো হলো- জাহান্নাম, জাহিম, সায়ির, সাকার, হুতামা, হাবিয়া, লাযা ও নার। তবে- জাহান্নাম শব্দটি একটি সার্বিক শব্দ বলেই মনে হয়। সবগুলোকেই একশব্দে জাহান্নাম বলা যায়।
কিন্তু এরকম বিভিন্ন নাম কেন?
ধারণা করা যেতে পারে অপরাধের প্রকৃতি ও শাস্তির মাত্রা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের স্থান নির্ধারণ করেছেন মহাপ্রভু। তিনি বিভিন্ন নাম নিশ্চয়ই বিনা-কারণে বলেন নি। তিনি কোনও শব্দ বিনা কারণে উল্লেখ করেন না। জাহান্নামের নাম হিসেবে আল্লাহ বিশেষ্য-পদ ব্যবহার করেছেন; কখনও বিশেষণ পদ ব্যবহার করে বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। আমরা সেভাবেই বিভিন্ন ধরনের জাহান্নামের নাম, শাস্তির মাত্রা এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধগুলো জানার চেষ্টা করব।
১. প্রথম নামটিই হলো- জাহান্নাম جَهَنَّمَ। এটি বিশেষ্য পদ এবং তা সুস্পষ্ট। জাহান্নাম (جَهَنَّمَ) শব্দটি কুর’আনে ৫৯ বার সরাসরি পাওয়া যায়।
..তোমাদের সমবেত করা হবে জাহান্নামে..৩:১২
২. দ্বিতীয় নামটি হলো আল-জাহিম ٱلۡجَحِيمِ al-jahimi; এই নামটি ২৬ বার এসেছে। (الْجَحِيمِ, الْجَحِيمَ, الْجَحِيمُ جَحِيمٍ وَجَحِيمًا)
আর যারা অবিশ্বাস করে এবং আমাদের আয়াত/নিদর্শন অস্বীকার করে, তারা জাহিমের অধিবাসী। ৫:১০
৩. তৃতীয় নামটি হলো আল-সায়ির السَّعِيرِ যা কুর’আনে বিশেষ্য পদ হিসেবে ১৮ বার পাওয়া যায়। (السَّعِيرِ, السَّعِيرِ, وَسُعُرٍ وَسَعِيرًا)
নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের শত্রু, তাই তাকে শত্রু হিসেবেই গ্রহণ করো; সে শুধু তার দলকে আহ্বান করে যাতে তারা আল-সায়িরের অধিবাসী হয়। ৩৫:৬
৪. চতুর্থ নামটি সাকার- سَقَرَ চারবার বলা হয়েছে।
শিগগিরি আমি তাকে দগ্ধ করব সাকারে। তুমি কি জানো সাকার কী? এটা কিছু রাখবে না এবং কিছু অবশিষ্টও থাকবে না। ৭৪:২৬,২৭,২৮
৫. পঞ্চম নামটি হলো আল হুতামা- الْحُطَمَةُ । এই নামটি বিশেষ্য পদ হিসেবে দুইবার কুর’আনে পাওয়া যায়। (حُطَامًا, الْحُطَمَةُ, الْحُطَمَةِ)
কখনও না, অবশ্যই তাকে ছুঁড়ে ফেলা হবে আল-হুতামায়। তুমি কি জানো আল-হুতামা কি? এটা আল্লাহর জ্বালানো আগুন; যা হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। নিশ্চয়ই এটা তাদের ঘিরে রাখবে; বর্ধিত খুঁটিতে। ১০৪:৪-৮১০৪:৪-৮
৬. ষষ্ঠ নামটি হলো হাবিয়া هِيَهْ। সুরা ক্বরিয়াতে এই নামটি পাওয়া যায়। একবার এই নামটি এসেছে।
তার বাসস্থান হবে হাবিয়া। তুমি কি জানো সেটা কী? প্রচণ্ড উত্তপ্ত আগুন। ১০১:৯-১১
৭. চতুর্থ নামটি হলো আল-নার ٱلنَّارِ– যার প্রচলিত বাংলা হলো আগুন।
হ্যাঁ, যারাই পাপ অর্জন করে; পাপে ঘেরাও হয়ে থাকে, তারাই হবে আসহাবুন নার..২:৩৯
৮. সুরা মা’আরিজের ১৫ নং আয়াতে লাযা- لَظَىٰ শব্দটি পাওয়া যায়। যা মূলত নাম বলে মনে হয় না; বরং আগুনের তীব্রতা ও প্রচণ্ডতা প্রকাশ করে।
কখনই নয়। নিশ্চয় এটা লেলিহান অগ্নি (লাযা)। যা চামড়া তুলে নেবে। ৭০:১৫,১৬
প্রথম প্রকাশ: ১০ মার্চ, ২০২২