হজ কী, কেন ও কীভাবে? (২য় পর্ব)
সুরা বাকারা: ১৫৮, ১৮৯, ১৯৬-২০৪ এবং সুরা তওবা: ৩
এসব আয়াতে হজ শব্দটি ও সংশ্লিষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়। এসব আয়াতের অনুবাদে জোর করে ঢুকানো হয়েছে পারস্য চক্রান্তকারীদের সুগভীর জালিয়াতি। সেসব জালিয়াতি উদ্ধার ও অনুবাদ সংশোধনের দিকে মনোযোগ না দিয়ে আপাতত মূল বিষয়ের (হজের) দিকে নজর দেওয়া যাক। যারা আপনাকে টেনে-হিঁচড়ে মূল সত্য থেকে সরাতে চায়; তারা জিজ্ঞেস করবে- এটা কী? ওটা কী? দয়া করে মৌলিক বিষয়ে থাকুন। মূল বিষয়বস্তু হলো মোহাম্মাদ রসুলুল্লাহর হজ।
হজ সংক্রান্ত প্রথম পোষ্টেই হজের মূল বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো তুলে ধরা হলো। এসব আয়াত তৎকালীন হজের ব্যাখ্যা। আরবি ‘হজ (ٱلْحَجُّ); শব্দটির অর্থ কী? অর্থ- যুক্তিতর্ক/ কনফারেন্স/ সম্মেলন।
বাস্তবতা হলো- আরবি ‘হজ’ শব্দের অর্থ না জানলেও তার ব্যাখ্যা থেকে সহজেই বোঝা যায়- কোন বিষয়কে বলে হজ।
এই পদ্ধতিটি অন্যান্য আরবি টার্ম-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ‘সালাত’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ কি? সেই গবেষণা বাদ দিয়ে একটু চেষ্টা করলেই কুর’আন থেকে জানা যায়- কোন বিষয়কে বলে সালাত। এটা জানাই তো মূল উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হওয়া উচিত! এতে সালাত কায়েম করা আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষের জন্য সহজ হয়ে যায়।
২.
২:১৫৮ আয়াত থেকে আমরা সাফা ও মারওয়া শব্দ পাওয়া যায়। আরবের প্রচলিত ভাষা থেকেও এই নামের পাহাড় দেখা যায়; যা হজের আয়াতের তৎকালীন কাজের সঙ্গে জড়িত হতে পারে। সাফা মারওয়া যদি পাহাড় না-ও হয় তাতেও কোনো সমস্যা আছে কি? সমস্যা নাই।
২/৩ বার পড়ুন। লোকজনকে এসেছে অথবা তাদের কাছে যাওয়া হয়েছে কিতাব বুঝাতে, প্রভুর বাণী নিয়ে কথা বলার জন্য; অযথা পাহাড়ে ঘোরাঘুরি করবে কেন? নিশ্চয়ই লোকজন নিষেধ করছিল। আল্লাহ জানিয়ে দিলেন- সেখানে ঘোরাঘুরি করায় পাপ নাই! এটা কী দৌড়াদৌড়ি করার নির্দেশ? অথবা উৎসাহ দেওয়া হলো? নিশ্চয়ই না!
- ২:১৮৯ আয়াতে হজ শব্দ এসেছে। তবে, আয়াতটির আলোচ্য বিষয়বস্তু হজ নয়, বরং নতুন চাঁদ ও সময় নির্দেশ সংক্রান্ত।
- ২:১৯৬-১৯৮ আয়াতগুলোতে সেই সময় হজের নিয়ম জানিয়ে দেওয়া হয়েছে- এ বিষয়গুলো শুধুমাত্র ওই সময়ের সঙ্গেই জড়িত। One time event ! রসুলের লোকজনকে মুশরিকরা বাধা দিলে কীভাবে কী করতে হবে বিস্তারিতভাবে বলে দেওয়া হয়েছিল। কারণ, ওহির মাধ্যমেই রসুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন মহান আল্লাহ। কেউ যেন ভুল-ত্রুটি অন্যায় না করে; আর করলেও তার কি ব্যবস্থা হবে, কোন পথে যাতায়াত করতে হবে—সব বিস্তারিত জানিয়েছিলেন মহান আল্লাহ। এসব বিষয় থেকে নিঃসন্দেহে নানা বিষয় আমাদের জন্য শিক্ষণীয় আছে। কিন্তু, একে কোনোভাবেই ‘ধর্মীয় রীতি পদ্ধতি’ বানানোর নির্দেশ এসব ঘটনার ব্যাখ্যা থেকে পাওয়া যায় না।
- ৯:৩ আয়াতেও ‘ইয়াওমাল হজ’ পাওয়া যায়। সেদিন রসুলুল্লাহ মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্কে ছিন্নের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। তবে, “মুশরিকদের কেউ যদি তোমার কাছে আশ্রয় চায়, তাকে আশ্রয় দাও, যাতে করে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পায়; তারপর তাকে তার নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেবে; কারণ তারা এমন লোক, যারা জানে না ৯:৬” এ নির্দেশনা সেখানেই আছে। অর্থাৎ, এখানেও সরাসরি আল্লাহর কিতাবের বক্তব্য প্রচারের বিষয়টি জড়িত।
এসব আয়াত থেকে কোনোভাবেই বর্তমানের প্রচলিত ‘রিচুয়াল’ বা ‘ধর্মীয় প্রথা’ যায়েজ করা যায় না।
- ৪৮:২৭ এই আয়াত থেকে বানানো হয়ে তথাকথিত ‘মাথা কামানো’– মুহাল্লাকিনা রুউসাকুম ওয়া মুকাস্সারিনা লা তাখাফুনা (مُحَلِّقِيْنَ رُءُوْسَكُمْ وَمُقَصِّرِيْنَۙ لَا تَخَافُوْنَ)। ‘মুহাল্লাকিনা রুউসাকুম ওয়া মুকাস্সারিনা’ বিষয়টি শান্তিপূর্ণ নিরাপদ ও নির্ভয়ে কোথাও যাওয়ার সঙ্গে জড়িত।
বাংলা ভাষাতেও আমরা বলি ‘মাথা কাটা যাওয়া’, ‘মাথা খাওয়া’— যা কোনো আক্ষরিক বিষয় নয়। আর এসব সে সময় ঘটনা, পরবর্তী সময়ের জন্য পালনীয় কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি।
৩.
ধরে নেওয়া হয়, ২:১৫৮ আয়াত অনুযায়ী সাফা মারওয়া পাহাড়ে তাওয়াফ মানুষের জন্য কল্যাণকর। পাহাড়ি অঞ্চলে ঘোরাফেরায় কী কল্যাণ থাকতে পারে?
কুর’আন অনুযায়ী কল্যাণ বা ‘খাইর’ সরাসরি দুই ধরণের কাজের সঙ্গে যুক্ত।
যা করা হবে সরাসরি অন্য মানুষের কল্যাণে এবং অন্য মানুষের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। কল্যাণ সব সময় অন্য মানুষের সঙ্গেই জড়িত। এর বাইরে কোনো কল্যাণ আছে কি?
মানুষকে দীন শিক্ষা দিলে তার উপকার হয়। মানুষকে খাবার খাওয়ালেও তার উপকার হয়।
এই যুগে খাবারের ব্যবস্থা করা ছাড়াও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কুর’আনের বাণী পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যায়।
সভা-সমাবেশ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করা এবং কিতাবের বাণী পৌঁছে দিয়েও হজের হক আদায় হতে পারে। এসব কর্মসূচিকে অনলাইনের সঙ্গে সংযুক্ত করে দুনিয়াব্যাপী পৌঁছে দিলে- একই লক্ষ্য অর্জন হবে। মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখেই নানা পদ্ধতি সে সময় নেওয়া হয়েছিল। সেসব পদক্ষেপ আসল বিষয় নয়। বরং, আসল বিষয় হলো- “মৌলিক উদ্দেশ্য” অর্থাৎ মহান রবের আয়াত মানবজাতির কাছে পৌঁছে দেওয়া।
মক্কা কী কোনো জায়গার নাম? বাক্কা কি কোনো নদীর নাম? কা’বা কি কোনো ভবনের নাম? এসব প্রশ্ন ও শব্দের বিশ্লেষণ যাচাই বাছাই করা, তার সূত্র ধরে ১০/২০টা অভিধানের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা, আরবি ভাষার গবেষণা নিয়ে গোটা জীবন পার করে দেওয়া যায়। তবে, দিন শেষে মূল বিষয় থেকে বহু দূর সরে যায় মানুষ!
মূল বিষয়- মানুষের কল্যাণ। কোনো ভবনের চারদিকে ৭ পাক ঘোরাতে কল্যাণ হয় না। পাহাড় পর্বত ডিঙ্গালে প্রত্যক্ষ লাভ হয় কি?
কিতাবের মূল লক্ষ্য হলো মানুষ। আর মানুষের কল্যাণেই আল-কিতাব। কাজী নজরুলের ভাষায়-