স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা !

স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা !

এই প্রবন্ধে রয়েছে-
       ১. বিখ্যাত ৪:৩৪ আয়াতের সঠিক অনুবাদ।
       ২. কে কার ওপর দায়িত্বশীল ও মর্যাদা পায় এবং কেন/ কীসের ভিত্তিতে ?
       ৩. নারী কোন অদৃশ্য বিষয় সংরক্ষণ করে? এবং
       ৪. ইয়াদ্বরিবু-হুন্না বলে কি স্ত্রীকে আঘাত করতে বলেছে?

       ১. আয়াতের সঠিক অনুবাদ নিম্নরূপ

৪:৩৪ পুরুষরা নারীদের ওপর দায়িত্বশীল (قَوَّامُونَ) কারণ আল্লাহ তাদের কারও ওপর কাউকে মর্যাদা দিয়েছেন; কারণ তারা খরচ করে তাদের সম্পদ থেকে; অতঃপর সৎ নারী হয় অনুগত রক্ষাকারিণী অদৃশ্য সেই বিষয়ে (غَيْبِ) যা সংরক্ষণ করেছেন আল্লাহ; এবং যাদেরকে তোমরা তাদের অবাধ্যতার জন্য ভয় করো- তাদেরকে উপদেশ দাও, বিছানা ত্যাগ করো ও বিচ্ছিন্ন থাকো (ضربوهن); অতঃপর যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা কোনও পথ খুঁজো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ হলেন উচ্চতর শ্রেষ্ঠ।

প্রচলিত অনুবাদগুলোতে জোরপূর্বক লিখে দেওয়া ভ্রান্ত শব্দ-বাক্যাংশ ছেঁটে ফেলা হয়েছে। সর্বোচ্চ সঠিক শুদ্ধ বাংলা ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে মহাজগতের প্রভুর বাণী।

২. পুরুষ নারীর ওপর দায়িত্বশীল বা অভিভাবক

কীভাবে ও কেন পুরুষ নারীর ওপর অভিভাবকত্ব বা দায়িত্বশীল হতে পারে? তার ২টি পরস্পর সংযুক্ত ধারাবাহিক কারণ বলা হয়েছে।

তাদের কেউ কারও ওপর মর্যাদা পায়, কারণ পুরুষ খরচ করে নারীর জন্য।


অর্থাৎ
, আপনি যার জন্য খরচ করেন না, আপনি তার দায়িত্বশীল-ও না। অর্থাৎ, যদি স্ত্রী চাকরি/ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন ও খরচ করে, আর আপনি তা ভোগ করেন। এমতাবস্থায় আল্লাহর দৃষ্টিতে স্ত্রী আপনার ওপর মর্যাদাবান ও আপনার দায়িত্বশীল হয়ে যাবেন।

৩. একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়- যা শুধুমাত্র নারীদের সঙ্গে জড়িত

অতঃপর সৎ নারী হয় অনুগত রক্ষাকারিণী অদৃশ্য সেই বিষয়ে যা সংরক্ষণ করেছেন আল্লাহ


বিভ্রান্তকারী অনুবাদ থেকে সরে এসে সঠিক অনুবাদ দেখুন। স্বয়ং মহান আল্লাহ কোন নারীদের সৎ
, অনুগত রক্ষাকারিণী বলেছেন এবং কেন বলেছেন?

কারণ, নারীদের অদৃশ্য বিষয় রক্ষা করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা আছে। স্বামীর ধন-সম্পদ, নারীর সতীত্ব- এসব কি অদৃশ্য বা গায়িব (غَيْبِ)?!? কারো না কারো কাছে তা প্রকাশ পায়। কিন্তু, প্রচলিত অনুবাদে উদ্দেশ্যমূলক এসব মিথ্যা কথা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ, আল্লাহ বলছেন- অদৃশ্য এক বিষয়!

আর অদৃশ্য সেই বিষয়টি হলো নারীর গর্ভে ধারণ করা সন্তান!

অন্যান্য বেশ কিছু আয়াত থেকেও বোঝা যায়, সন্তানের জন্ম/ সৃষ্টি প্রক্রিয়া অদৃশ্য স্তরে ঘটে (৩:৬, ২২:৫, ৩১:৩৪, ৩৯:৬, ৫৩:৩২)- যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না (১৩:৮, ১৬:৭৮, ৭:১৮৯ )।

মহাপ্রভু স্বয়ং মাতৃগর্ভের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে অদৃশ্য একটি কোষ (জাইগোট) থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন কোষের পূর্ণাঙ্গ মানব-শিশু গড়ে তোলেন শুধুমাত্র তিনিই। এরপর সেই শিশু আকৃতি লাভ করে, ভূমিষ্ঠ হয় ও দৃশ্যমান হয়। নারীদেরকে তাদের গর্ভস্থ সন্তানের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে, গোপন করতে নিষেধ করা হয়েছে (২:২২৮) এমনকি মানবজাতিকে খুব যত্নবান হতেও বলা হয়েছে (৪:১)।

৪:১ হে মানবজাতি, তোমাদের রবের বিষয়ে সচেতন হও (ٱتَّقُوا۟) যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একক নফস থেকে এবং সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া (زَوْجَهَا); তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন অনেক পুরুষ ও নারী (رِجَالًا كَثِيْرًا وَّنِسَاۤءً); সচেতন হও আল্লাহ সম্পর্কে (اتَّقُوا اللّٰهَ) যার নামে তোমরা চাও এবং  গর্ভ সম্পর্কেও ( وَالْاَرْحَامَand the wombs); নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর দৃষ্টি রাখেন।

পৃথিবীতে মানুষ পাঠানো এবং মানবজাতির ধারাবাহিক বিকাশের একমাত্র এই প্রদ্ধতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত নারীরা। যাদেরকে আল্লাহ সৎ ও অনুগত রক্ষাকারী হতে বলেছেন, তাঁরাই রক্ষা করে অদৃশ্য সেই বিষয়ে যা সংরক্ষণ করেছেন আল্লাহ তাদের অভ্যন্তরে

তঃপর সৎ নারী হয় অনুগত রক্ষাকারিণী অদৃশ্য সেই বিষয়ে যা সংরক্ষণ করেছেন আল্লা

৪. “উপদেশ দাও, বিছানা ত্যাগ করো ও বিচ্ছিন্ন থাকো”

আর যাদেরকে তোমরা তাদের অবাধ্যতা/ উপেক্ষার জন্য ভয় করো- তাদেরকে উপদেশ দাও, বিছানা ত্যাগ করো ও বিচ্ছিন্ন থাকো (ضربوهن)।

যদি নারী সন্তান নিতে না চায় তখন স্বামী হিসেবে পুরুষের ধারাবাহিক কর্তব্য স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা হলো:-

ক) তাদেরকে উপদেশ দাও; অর্থাৎ কাউন্সিলিং করো, উদ্যানে, রেস্তোরাঁয়, সিনেমায় নিয়ে যাও- বোঝাও।
খ) কাজ না হলে- বিছানা ত্যাগ করো
গ) তাতেও কাজ না হলে- বিচ্ছিন্ন থাকো (ضربوهن)

এবার এর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা শুনুন। কারণ, এখানেই ঢুকানো হয়েছে বৌ-পিটানোর মানসিকতা।

ওয়াদরিবু হুন্না > দ্বরিবু হুন্না দ্ব-রা-বা।

কি এই দ্বরাবা ? কেউ বলছেন পিটানো, কেউ বলছেন ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। এমন পার্থক্য হচ্ছে কেন? কারণ, দ্বরাবা একটি VERB বা ক্রিয়াপদ। অনুবাদকগণ যদি ক্রিয়াপদের ব্যবহার না জানেন, নিজের মাতৃভাষাও না জানেন- তাহলে নিজের খায়েশ পূরণ করতে স্ত্রীকে অপমান অপদস্থ করা ছাড়া আর কী-ই-বা লিখবেন?

যেমন: খাওয়া’ একটি ক্রিয়াপদ। বিভিন্ন বিশেষ্য-পদের সঙ্গে ক্রিয়াপদ বসে ভিন্ন অর্থ তৈরি হয়। 

  • ভাত (বিশেষ্য) খাওয়া (ক্রিয়াপদ): মুখ দিয়ে চিবিয়ে গলাধঃকরণ করা। 
  •  সম্পদ (বিশেষ্য) খাওয়া (ক্রিয়াপদ): অন্যের সহায় সম্পদ আত্মসাৎ করা। 
  •  মাথা (বিশেষ্য) খাওয়া (ক্রিয়াপদ): শপথ করা, দিব্যি দেওয়া।

দাঁড়াও, মাথা খাও, যেও না সখা।। শুধু সখা, ফিরে চাও, অধিক কিছু নয় কতদিন পরে আজি পেয়েছি দেখা॥


যেমন:
ধরা একটি ক্রিয়া পদ। 

  • এখন হাতে-পায়ে ধরাচোখে ধরা, মনে ধরা, মাথা ধরা, ছাতা ধরা যদি যাদের কাছে একই জিনিস মনে হয় (!) তাহলে এমন আমড়া কাঠের ঢেঁকি (অপদার্থ) দিয়ে জাতির কী উপকার হবে? আচ্ছা, আমড়া কাঠের ঢেঁকির ইংরেজি অনুবাদ কী করবেন?

ঠিক সেইভাবে দ্বরাবা একটি আরবি ক্রিয়াপদ। বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে দ্বরাবা শব্দটি যুক্ত হলে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। আরবি অভিধান খুলে দেখার মতো কষ্টটুকু করলেই দ্বরাবা দিয়ে অর্ধ-শতাধিক শব্দ পাবেন (ছবি সংযুক্ত)।

নারীদের সঙ্গে যখন দ্বরাবা শব্দ যুক্ত হয় তখন অর্থ দাঁড়ায় তাদের থেকে পৃথক থাকা। অর্থাৎ, যে দম্পতি একত্রে থাকতো, তারা এখন পৃথক থাকে, যা separation বোঝায়। এর একমাত্র উদ্দেশ্য- গর্ভে সন্তান ধারণে ক্ষেত্রে স্ত্রী যদি অবাধ্যতা দেখায় বা উপেক্ষা করে- তখন প্রথমে উপদেশ দাও (عظوهن)কাজ না হলে বিছানা ত্যাগ করো (هجروهن), তাতেও কাজ না হলে বিচ্ছিন্ন থাকো (ضربوهن)
এভাবেই, 

  • দ্বরাবা যখন পৃথিবীর সঙ্গে বসে (দ্বরাবা + আরদ)— তখন দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো বোঝায় (২:২৭৩; ৪:৯৪, ১০১)। 
  • দ্বরাবা যখন মানুষের সঙ্গে বসে— তখন স্বামী-স্ত্রীর সেপারেশন বা বিচ্ছিন্ন থাকা বোঝায় (৪:৩৪)।

নারীদের গায়ে হাত তোলার চিন্তা করা মাত্রই আপনি পশুর চেয়েও অধম জাতে পৌঁছে গেলেন। অভিনন্দন!

পরিশেষে মহান আল্লাহ জানালেন অতঃপর যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা কোনও পথ খুঁজো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ হলেন উচ্চতর শ্রেষ্ঠ।

পাদটীকা:

১. ৪:৩৪ আয়াতের পাশাপাশি ক্বওয়ামুনা (قَوَّامُونَ) শব্দটি ৪:৩৫৫:৮ আয়াতেও এসেছে। যেখানে তার অর্থগুলো এমন: অভিভাবকদায়িত্বশীলঅটলএকনিষ্ঠসুদৃঢ় ইত্যাদি।

২. ৪:৩৪ আয়াতের নুশুঝা-হুন্না নুশুঝ শব্দটি ৪:১২৮ আয়াতেও এসেছে। যার অর্থ হতে পারে: অবাধ্যতাউপেক্ষাঅসদাচরণ, ill-conduct ইত্যাদি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *