মানবজীবনের অফুরান যাত্রা

মানবজীবনের অফুরান যাত্রা

কুর'আন রিসার্চ সেন্টার- কিউআরসি

এই প্রবন্ধে জটিল এক রহস্য উদঘাটন করা হবে। মানুষ কীভাবে কোথায় যাচ্ছে- তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।

মানুষকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে? মানুষ কেন পৃথিবীতে এসেছে? এরপর মৃত্যু, আবার জন্ম; এর মাধ্যমে মানুষের কী হচ্ছে বা হতে পারে? কেনইবা এই সৃষ্টি-ধ্বংসের খেলা? কী প্রয়োজন এসবের ? এর পেছনের কারণগুলো যুক্তিসহ বিশ্লেষণ করা হলো।

মহাগ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, কিয়ামতের পর গোটা মানবজাতিকে সমবেত করা হবে। যা পরিচিত হাশর’ নামে। সেই সময়পর্বে মানুষ মৃত অবস্থা থেকে পুনরায় জন্ম নেবে। সে জন্ম ভিন্ন ধরনের জন্ম। সম্পূর্ণ পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মানুষ তৈরি’ হবে। সেই জন্ম মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভ নয়। মহা-সমাবেশের সেদিন নতুন করে সৃষ্ট ভূপৃষ্ঠ বা যমিন থেকে মানুষের নতুন দেহগুলো দ্রুতগতিতে বের হবে বা তৈরি হবে। (২২:৫, ৫০:১১, ৪২, ৪৪)

এরপর, সেখানে দ্রুত জন্ম নেওয়া শক্তিশালী মানবদেহের সঙ্গে যুক্ত করা হবে প্রত্যেকের নফস

প্রচণ্ড শক্তিশালী হবে সেসব মানবদেহ। এই মানুষদের একটি অংশ জাহান্নামের প্রচণ্ড আযাব সহ্য করে টিকে থাকবে, আর একটি অংশ জান্নাতে অফুরন্ত নেয়ামত, প্রশান্তি, সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেও ক্লান্ত হবে না। দুই দলের মানুষগুলোই বিপুল শক্তিমত্তার অধিকারী হবে। নবগঠিত সেই দেহের রূপ:

🧿 এক্ষেত্রে তোমাদের আকৃতি (أَمْثَٰلَكُمْ) পরিবর্তন করব এবং তোমাদের উত্থান (وَنُنشِئَكُمْ) করবো এর মধ্যে- যা তোমরা জানো না। ৫৬:১  

সেই সঙ্গে যুক্ত হবে মানুষের নফস।

🧿 যখন নফসকে জুড়ে দেওয়া হবে। ৮১:৭ 

✅ নফস কেন যুক্ত করতে হবে দেহের সঙ্গে?

প্রথমত, মানুষের নফস বা আত্মা স্রষ্টা প্রদত্ত বিশেষ শক্তি- যা পৃথিবীর খুব স্বল্প সময়ে বিকাশ লাভ করে। নফস-ই হলো প্রকৃত মানুষ। মানবদেহ পৃথিবীর উপাদান দিয়ে তৈরি (৬:২, ২৩:১২)। অন্যদিকে, মানবদেহে মিশে থাকা নফস’ সর্বশক্তিমান মহা-প্রজ্ঞাবান আল্লাহ একটি একক নফস’ বা নফসিন ওয়াহিদাতিন’ থেকে তৈরি করেছেন (৪:১) । পৃথিবীর জীবনের অভিজ্ঞতা, স্রষ্টার প্রদত্ত দ্বিতীয় শক্তি ‘আর-রুহের’ সমন্বয়ে বিকশিত হয় নফস। এই নফস বহন করে স্মৃতি, এই নফস বা আত্মা বা soul হলো মানুষ নিজে।

দ্বিতীয়ত, হাশরের ময়দানে পুনরুত্থান হওয়া শক্তিশালী দেহের সঙ্গে প্রতিটি নফস যোগ হলেই সবাই চেতনাপ্রাপ্ত হবে। তখন পৃথিবীর অতীত মনে পড়বে, পৃথিবীর জীবনের আগের অতীত-ও মনে পড়বে। সেই সঙ্গে প্রকৃত বাস্তবতাও দৃষ্টিগোচর হবে।

২০:৫৫ মাটি থেকে আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, আর তার মধ্যে তোমাদেরকে আমরা ফিরিয়ে আনব; এবং তা-থেকে তোমাদের আমরা বের করব পরের বার।

৩০:১৯ তিনিই জীবন্তকে বের করেন মৃত থেকে আর মৃতকে বের করেন জীবন্ত থেকে; আর যমিনকে পুনরায় জীবিত করেন তার মৃত্যুর পর; এবং এভাবেই তোমাদের বের করা হবে।

হাশরের ময়দানে মানুষের দ্রুত পুনরুত্থান হলো তৃতীয় পর্যায়ের নতুন সৃষ্টি।

আর, পৃথিবীর জীবন বা বর্তমান অবস্থা হলো দ্বিতীয় পর্যায়!

এই পৃথিবীতে প্রথম দফায় কিছু মানুষ পাঠানো হয়েছিল। তারপর পরবর্তী মানুষগুলো মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে শিশু হিসেবে পা ফেলে। এই পৃথিবীতে ঈসার জন্ম হয়েছে। তাঁর সৃষ্টির প্রক্রিয়া ছিল একেবারেই ভিন্ন। অর্থাৎ, যে কোনো পদ্ধতিতে মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন মহান আল্লাহ।

আর, মহা-সমাবেশের দিন নতুনভাবে সৃষ্ট উন্নতমানের ভূপৃষ্ঠ থেকে’ বের করা হবে আরও উৎকৃষ্ট মানবজাতিকে ।

২২:৫ হে মানবজাতি, পুনরুত্থান সম্পর্কে যদি তোমাদের সন্দেহে হয় (رَيْبٍ مِّنَ الْبَعْثِ)- তবে অবশ্যই আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি মাটি (تُرَابٍ) থেকে, এরপর শুক্র (نُّطْفَةٍ) থেকে, এরপর রক্তপিণ্ড (عَلَقَةٍ) থেকে, এরপর পূর্ণাকৃতির মাংসপিণ্ড (مُّضْغَةٍ) থেকে এবং অ-পূর্ণাকৃতির যেন স্পষ্ট করি আমরা তোমাদের কাছে; এবং স্থিতিশীল করি গর্ভের মধ্যে (ٱلْأَرْحَامِ) যে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমরা চাই, এরপর তোমাদের বের করি শিশুরূপে, এরপর তোমরা যেন পৌঁছাও তোমাদের যৌবনে; আর তোমাদের মধ্যে কাউকে মৃত্যু দেওয়া হয় (يُتَوَفَّىٰ)আর তোমাদের মধ্যে কাউকে ফিরানো হয় (يُرَدُّ) শোচনীয় বয়সের দিকে- যেন সে অনেক কিছু জানার পরও কোনো কিছু না-জানে; এবং তুমি দেখো বিরান যমিন, অতঃপর যখন আমরা তার ওপর পানি পাঠাই তা সতেজ হয় ও বাড়তে থাকে এবং উদগত হয় সব সুদৃশ্য ধরণ (زَوْجٍۢ بَهِيْجٍ)

মানুষকে প্রথমে কখন, কোথায় ও কীভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল?

মানুষের প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল এই মহা-বিশ্বজগত বা Universe এর বাইরে কোথাও।

৭:১৭২ আর যখন তোমাদের রব আদম সন্তানদের পিঠসমূহ থেকে  বংশধরদের বের করেন এবং তাদের সাক্ষ্য নেন তাদের নিজেদের ওপর- আমি কি তোমাদের রব? তারা বলল- হাঁ অবশ্যই, আমরা সাক্ষ্য দিলাম; যেন তারা কিয়ামত দিবসে বলতে পারে, নিশ্চয়ই আমরা ছিলাম এ-বিষয়ে উদাসীন (غَٰفِلِينَ) ।

অর্থাৎ, হাশরের ময়দানে ভূপৃষ্ঠ থেকে ‘বের হওয়া দেহ এবং তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া নফস পৃথিবীর জীবন এবং পৃথিবীর আগের জীবনের কথা সুস্পষ্টভাবে মনে করতে পারবে। উল্লেখ্য, পৃথিবীর জীবন হলো মানুষের দ্বিতীয় পর্যায় এবং পৃথিবীতে আসার আগের অবস্থা ছিল মানুষের প্রথম পর্যায়। আর, পৃথিবীতে মৃত্যুর পর হাশরের ময়দানে পুনরুত্থান বা নতুন জন্মলাভ মানুষের তৃতীয় পর্যায়।

সংক্ষেপে এটা হলো মানবজাতিকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে সৃষ্টি করার ঘটনা।

✅এভাবে আরও আছে কি?

এই প্রশ্নের উত্তর বোঝার জন্য সংক্ষেপে মহাবিশ্বের (Universe) সৃষ্টি রহস্যের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ, মানুষের সৃষ্টি ও বিকাশের সঙ্গে মহা-বিশ্বজগতের সৃষ্টি ও ধ্বংসের গভীর সম্পর্ক আছে। এই বিশ্বজগতের অতি-ক্ষুদ্রতম অংশ হলো পৃথিবী।
আর, মানুষের আপাত বাসস্থান এই পৃথিবী। পৃথিবীকে লক্ষ-কোটি বছর ধরে মানুষের বসবাসের উপযোগী করা হয়েছে। এজন্য, উপযুক্ত গ্যালাক্সির যথাপোযুক্ত স্থানে সৌরজগৎ স্থাপন করা, সৌরজগতের উপযুক্ত স্থানে পৃথিবী ও চাঁদ স্থাপন করা, নির্ধারিত মাত্রায় মহাকর্ষ ও মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি, মানুষের বসবাসের উপযোগী করার জন্য পৃথিবীতে অসংখ্য ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে- উপযুক্ত মাত্রায়। যেমন, আবহাওয়া, জলবায়ু, বাস্তুসংস্থান থেকে শুরু করে অদৃশ্য পর্যায়ের জীবাণু ও প্রাণীচক্র (
water bear) সহ অনেক কিছু। সব কিছুর নিখুঁত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পৃথিবী মানুষের বসবাসের উপযোগী অবস্থায় রয়েছে লক্ষ বছর ধরে !

তিনিই যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার সব… ২:২৯


সম্প্রতি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার জেমস ওয়েব ডিপ স্পেস টেলিস্কোপ কিছু বিস্ময়কর ছবি প্রকাশ করেছে। তেমন একটি ছবিতে দেখা যায়- মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রাথমিক সময়ের সামান্য কিছু দৃশ্য। মহাবিশ্বের (Universe) প্রাথমিক দশায় বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মির মধ্যে কিছু পূর্ণতাপ্রাপ্ত গ্যালাক্সির ছবি আমরা দেখেছি! এই পূর্ণ গ্যালাক্সিগুলো’ প্রমাণ করে যে, বিজ্ঞানীদের একাংশের দাবি বিগব্যাং নয়; বরং বিগ-বাউন্স’ থেকে তৈরি হওয়া পরবর্তী পর্যায়ের মহাবিশ্বে আমরা বাস করছি। মহাগ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী বর্তমান মহাবিশ্ব হলো ষষ্ঠ পর্যায়ে বা ধাপে তৈরি হওয়া মহা-বিশ্বজগৎ।

মহা বিশ্বজগতের প্রভু বলেছেন-

তাদের আমরা অচিরেই দেখাবো আমাদের নিদর্শনাবলী দিগন্তে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে, যতক্ষণ-না তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয় যে এটা নিখুঁত-যথোপযুক্ত-মহা-সত্য (الْحَقُّۗ); যথেষ্ট নয় কি যে তোমার রব সব কিছুর বিষয়ে সাক্ষী (شَهِيدٌ)৪১:৫৩৫.

This image shows many overlapping objects at various distances. They include foreground stars, galaxies in a galaxy cluster, and distorted background galaxies behind the galaxy cluster. The background of space is black. Thousands of small galaxies appear across the image. Their colors vary. Some are shades of orange, others are white. Most appear as fuzzy ovals, but a few have distinctive spiral arms. In front of the galaxies are several foreground stars. Most appear blue with diffraction spikes, forming eight-pointed star shapes. Some look as large as the galaxies that appear next to them. A very bright star is slightly off center. It has eight blue, long diffraction spikes. In the center of the image, between 4 o’clock and 6 o’clock in the bright star’s spikes, are several bright, white galaxies. These are members of the galaxy cluster. There are also many thin, long, orange arcs. They follow invisible concentric circles that curve around the center of the image. These are images of background galaxies that have been stretched and distorted by the foreground galaxy cluster. [By Nasa]  click here for more.

মহা বিস্ময়কর এই ছবিতে দেখা যায়- মহাবিশ্বের আদিতে পূর্ণতাপ্রাপ্ত অসংখ্য গ্যালাক্সি যা সত্যিই বিস্ময়কর! কারণ, নিয়ম অনুযায়ী নেবুলা বা নিহারীকার মধ্যে নক্ষত্রমণ্ডলীর জন্মের বিলিয়ন বিলিয়ন বছর পর- ধাপে ধাপে এক পর্যায়ে নক্ষত্র এবং তার ধারাবাহিকতায় গ্যালাক্সিগুলো তৈরি হওয়ার কথা। অথচ, মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে কীভাবে পূর্ণ-মাত্রার গ্যালাক্সিগুলো দেখা যেতে পারে?

প্রশ্নটির একটাই জবাব হতে পারে। এই মহাবিশ্ব দ্বিতীয় পর্যায়ের সৃষ্টি। 
এ বিষয়ে মহান রব বলেছেন- 
যারা অস্বীকার করে তারা কি দেখে না যে, মহাকাশ ও যমিন ছিল একত্রিত, অতঃপর তাদেরকে আলাদা করেছি…  ২১:৩০

The data revealed light from one galaxy that traveled for 13.1 billion years before Webb’s mirrors captured it. 

উল্লেখ্য, এই ছবির সব গ্যালাক্সি, নক্ষত্র বা অন্যান্য উপাদান ১৩০০ কোটি বছর আগের নয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু উপাদান/ বস্তু হলো প্রাচীনকালের আলো। আলোর দূরত্ব নির্ধারণের কৌশল (Red-Shiftপ্রয়োগ করে জানা গেছে যে- সেই গ্যালাক্সিগুলো বর্তমান মহাবিশ্বের প্রথম পর্যায়ের সৃষ্টি।

পাশাপাশি, মহাকাশ বিজ্ঞানীদের তত্ত্বের আলোকে মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে সর্বোচ্চ ধোঁয়া ও গ্যাস জাতীয় পদার্থ থাকার কথা। অথচ, আমরা দেখেছি পাচ্ছি বিস্ময়কর পূর্ণ গ্যালাক্সি !

এটাই হলো মহাসত্য বা আল-হাক্ব বা মহা-বাস্তবতা। এই বাস্তবতার সঙ্গেই জড়িত আছে সব প্রশ্নের অপেক্ষাকৃত সঠিক উত্তর।

বিশাল মহাবিশ্বের মহা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই দৃশ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে- বর্তমান মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে বিগ বাউন্স থেকে বিগ ব্যাং বা প্রথম বিস্ফোরণ থেকে নয়।

যারা অস্বীকার করে তারা কি দেখে না যে, মহাকাশ ও যমিন ছিল একত্রিত, অতঃপর তাদেরকে আলাদা করেছি…  ২১:৩০
বল, তোমরা কি অস্বীকারই করছ যিনি যমিন সৃষ্টি করেছেন দুই ধাপে/ পর্যায়ে (فِيْ يَوْمَيْنِ) আর তাঁর সমকক্ষ বানাচ্ছ? তিনিই বিশ্বজগতের রব! ৪১:৯   
অতঃপর তিনি নজর দিলেন আকাশের দিকে, যা ছিল ধোঁয়া/ গ্যাসীয় পদার্থ (دُخَانٌ); তারপর তিনি তাকে ও যমিনকে বললেন- উভয়ে আসো স্বচ্ছন্দে বা কষ্ট হলেও, তারা বলল আমরা এলাম স্বেচ্ছায়-সানন্দে। ৪১:১১

 

বর্তমান মহাকাশে এখনও সেই প্রথম পর্যায়ের ধোঁয়ার বিশাল অঞ্চল দেখা যায়। যা নিহারীকা বা নেবুলা নামে পরিচিত। মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু এই গ্যাসীয় পদার্থই বিদ্যমান ছিল। কোনো ভারী পদার্থ গ্রহ, নক্ষত্র, ধুমকেতু, উল্কা-শিলা এসব ছিল না।

তাই নিশ্চিত যে, বর্তমান মহাবিশ্ব প্রাথমিক বা প্রথম মহাবিশ্ব বা Universe নয়। বর্তমান পূর্ণতাপ্রাপ্ত মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে- সৃষ্টি, ধ্বংস ও ফের সৃষ্টির প্রক্রিয়ায়। আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্ব দ্বিতীয় দফার এই সৃষ্টিকে বলে বিগ বাউন্স।

‘বিগ বাউন্স’ বা ‘বিগ ক্রাঞ্চ’ হলো ‘বিগ ব্যাং’ বা প্রথম মহাবিস্ফোরণ থেকে মহাবিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়ে চূড়ান্তভাবে বৃদ্ধির পর প্রচণ্ড মহাকর্ষ শক্তির টানে ফের প্রথম অবস্থার মতো এক বিন্দুতে ফিরে আসা।

The Big Bounce is a hypothesized cosmological model for the origin of the known universe. It was originally suggested as a phase of the cyclic model or oscillatory universe interpretation of the Big Bang, where the first cosmological event was the result of the collapse of a previous universe. Wikipedia

চিত্র: The Big Bounce

ইউনিভার্স সৃষ্টির প্রথম দফায় মহাশূন্য বা শূন্যস্থানও ছিল না! কিন্তু, নাসার প্রকাশিত ছবিতে আমরা দেখছি মহাবিশ্বের প্রথম পর্যায়ে সৃষ্টি হওয়া পূর্ণ গ্যালাক্সি!

মহাগ্রন্থে উল্লেখ করা মহাবিশ্বের প্রথম দিকের ধোঁয়া ও গ্যাস প্রথম পর্যায়ের সৃষ্টি। যা পরবর্তী পর্যায়ের মহাবিশ্বেও রয়েছে। এজন্যই আল-কুরআনে বলা হয়েছে- মানুষ তা দেখতে পারে!

মহাকাশে নেবুলা বা নিহারীকা পর্যবেক্ষণ করেই বিজ্ঞানীরা তা দেখতে পারেন। একে বলা হয়- নক্ষত্রের আঁতুড় ঘর। যেখানে এখনও ধোঁয়া, গ্যাস, তাপ, চাপ- ইত্যাদি নানা বস্তুর সমন্বয়ে একের পর এক নক্ষত্র তৈরি হচ্ছে।

ছবি: নেবুলা

মহাগ্রন্থ থেকে এটাই স্পষ্ট যে, যখন প্রথম পর্যায়ের সৃষ্টির সময় শুধুই ছিল গ্যাসীয় পদার্থ। তখন মহাকাশ / শূন্যস্থান এবং গ্রহ-নক্ষত্র/ যমিন, ছায়াপথ বলতে আলাদা কিছু ছিল না। বরং সবই ছিল একত্রিত, সম্মিলিত। সেখান থেকেই শুরু হয় দৃশ্যমান পদার্থ ও অদৃশ্য মহাশূন্য বা Space-এর বিস্তার।

যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয়েছিল এসব কথা। এভাবে আরও দফায় দফায় ধ্বংস ও সৃষ্টি আছে কি?

মহাগ্রন্থ বা মুসহাফের মাধ্যমে দিয়ে যতদূর দেখা যায়- ধ্বংস ও সৃষ্টির এই পর্যায়গুলো অনবরত চলছে। অর্থাৎ, বিজ্ঞানীদের বিগ বাউন্স তত্ত্বকেই দৃঢ় সমর্থন দিচ্ছে আল-কুরআন।

২.

প্রথমে আদম বা মানবজাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছিল জান্নাতে। জান্নাত এই মহাবিশ্বের বাইরে অবস্থিত। এই মহাবিশ্ব মানে ‘সামাওয়াত ওয়াল আরদ’ The Universe.

প্রথমে মহা-বিস্ফোরণ বা বিগ-ব্যাং এর মধ্য দিয়ে ধোঁয়া ও গ্যাসীয় পদার্থের মহা-কুণ্ডুলী তৈরি হয়। তারপর ক্রমান্বয়ে সেখান থেকে মহাশূন্য , গ্রহ-নক্ষত্র আলাদা করা হয়। যা ছিল প্রথম পর্যায়ের মহাবিশ্ব। তারপর মহা-সংকোচন বা কিয়ামত সদৃশ এক ঘটনা বা বিগ ক্রাঞ্চ এবং বিগ বাউন্স ঘটে। এর মধ্য দিয়ে পরবর্তী পর্যায়ের মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়। যেখানে, প্রথম পর্যায়ের মহাবিশ্বের চেয়ে আরও উন্নত বস্তু/ পদার্থ/ সৃষ্টি দেখা যায়। এভাবে ৫টি পর্যায় পার হয়ে ৬ষ্ঠ পর্যায়ের মহাবিশ্বের প্রথম দিকের ছবি আমরা দেখেছি জেমস ওয়েবের চোখে। এ ছাড়া, বর্তমান মহাবিশ্বের প্রথম দিকে পূর্ণ গ্যালাক্সি দেখার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

বিজ্ঞানীদের তত্ত্ব অনুযায়ী বর্তমান মহাবিশ্বের-ও ধ্বংস অনিবার্য। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনই শুধু নয়- পূর্ববর্তী সব কিতাব সেই কথাই বার বার বলেছে। ঘনিয়ে আসছে মহাধ্বংস বা কিয়ামত! দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে ইয়াওমিদ্দিন। আরেকটি বিগ ক্রাঞ্চ ও বাউন্স!

এরপর আবার নতুন করে সৃষ্টি হবে পরিবর্তিত মহাবিশ্ব। আর এই পরিবর্তনটাই বার বার দেখা যায়। ভারী থেকে ভারী বস্তু- উন্নত থেকে উন্নততর বস্তু তৈরি হচ্ছে। মহাবিশ্বের কয়েকটি পর্যায়ের সৃষ্টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি পর্যায়ে সৃষ্ট বিশালাকার বস্তুগুলো উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে উঠছে।

মানুষের প্রথম সৃষ্টি, দ্বিতীয় সৃষ্টি, তৃতীয় সৃষ্টি খেয়াল করুন! মহাবিশ্বের কয়েকটি পর্যায়ের সৃষ্টি খেয়াল করুন!


আসন্ন কিয়ামতে মহা পরাক্রমশারী রব এই বিশ্বজগতের সবকিছু তাঁর শক্তির মধ্যে গুটিয়ে নেবেন! শুধুই তাঁর মহান সত্তা অবশিষ্ট থাকবে এই সামাওয়াতে বা মহাবিশ্বে। স্তরে স্তরে সজ্জিত মহাকাশগুলো আবারও এক বিন্দুতে চলে যাবে।

অর্থাৎ, আরকেটি বিগ বাউন্সের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে!

যখন সূর্য আচ্ছন্ন হবে। আর যখন নক্ষত্ররাজি নিষ্প্রভ ও বিশৃঙ্খল হবে (كَدَرَتْ অর্থ- ঘোলাটে, নিষ্প্রভ, অস্বচ্ছ, বিশৃঙ্খল)। আর যখন পাহাড়পর্বত গতিশীল হবে। আর যখন গর্ভবতী উটনিকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর যখন বন্য পশুদের জড়ো করা হবে। আর যখন সমুদ্রে আগুন ধরে যাবে (سجرت অর্থ- আগুন লাগানো)। আর যখন আত্মাসমূহ (النُّفُوْسُ) পুনঃসংযোজন হবে। আর যখন জীবন্ত কবর দেওয়া কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল? আর যখন আমলনামা (الصُّحُفُ) দেখানো হবে। (আস-সহুফু হলো- পৃথিবীর সময় মানুষের যাবতীয় কৃতকর্মের সংরক্ষিত রূপ)। আর যখন আকাশ সরানো (كُشِطَتْ) হবে। আর যখন আল-জাহিম (একটি জাহান্নাম) প্রজ্বলিত করা হবে। আর যখন আল-জান্নাত কাছে আনা হবে। তখন প্রত্যেকেই (نَفْسٌ) জানবে যা সে এনেছে। ৮১:০১-১৪

৩.

কিয়ামত দিবসের পর্যায়ে (৭ম পর্যায়ে) সৃষ্টি হবে ভিন্ন ধরনের মহাবিশ্ব। যেখানে গোটা মানবজাতি থাকবে হাশরের ময়দান, সামাওয়াতে থাকবে প্রচণ্ড শক্তির জাহান্নাম! আর থাকবে- সামাওয়াত থেকে বারজাখ (প্রতিবন্ধকতা) পার হয়ে জান্নাতের মহাবিশ্বে যাবার ব্যবস্থা। সেই সময়ের দুই মহাবিশ্বের উপযোগী করে গড়ে তোলা হবে মানুষকে। এই পর্যায়ে মানবজাতি ডার্ক এনার্জির তৈরি জিন-জাতির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের শক্তি লাভ করবে। জিন আগের মতো থাকলেও মানুষের ক্ষমতা এবার শক্তিশালী জিন-জাতির পর্যায়ে পৌঁছে যাবে, হয়তো ছাড়িয়েও যাবে! জাহান্নামে যাওয়া মানুষগুলো শয়তান জিনদের সব প্রতারণা বুঝতে পারবে।

দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় পর্যায়ে মহাবিশ্বে মানুষকে প্রচণ্ড শক্তিশালী ও উন্নত করে তৈরি করা হচ্ছে। জান্নাতি ও জাহান্নামি মানুষদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যই তার প্রমাণ দেয়। তারা আরও শান্তি বা শাস্তি ভোগ করবে- কিয়ামত পরবর্তী ৭ম পর্যায়ের সৃষ্টি হিসেবে।

প্রশ্ন হলো, কিয়ামত পরবর্তী জান্নাত ও জাহান্নাম কি চূড়ান্ত স্থায়ী? কারণ বার বার বলা হয়েছে- সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। কিন্তু, এ পর্যন্ত বিগ বাউন্সের থিওরি বলে- ধারণার চেয়েও দীর্ঘ সময় পরে হলেও সপ্তম পর্যায়ের সেই মহাবিশ্বকেও ধ্বংস হতে হবে! তাহলে মহান রব কি আমাদের সে বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন?

-হ্যাঁ, দিয়েছেন।

তিনি জানিয়েছেন, কিয়ামতের পর তৈরি হওয়া মহাবিশ্বসহ (সপ্তম পর্যায়) ধ্বংস করা হবে। ইঙ্গিত আছে রহস্যময় জান্নাতও সেই ধ্বংসের আওতায় পড়বে! তবে, যদি মহাজগতের রব ভিন্ন কিছু চান- তাহলে ভিন্ন কথা। সেই কথাও স্পষ্ট বলা হয়েছে।

হতভাগারা থাকবে জাহান্নামে। সেখানে তাদের জন্যে থাকবে কেবল চিৎকার আর আর্তনাদ। সেখানেই স্থায়ীভাবে পড়ে থাকবে তারা যতদিন মহাকাশ ও যমিন-সমূহ বিদ্যমান থাকবেযদি না তোমার প্রভু অন্য কিছু চান। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু যা চান তাই করেন।

আর যারা হবে ভাগ্যবান, তারা থাকবে জান্নাতে। স্থায়ীভাবে তারা সেখানে থাকবে, যতদিন বিদ্যমান থাকবে মহাকাশ ও যমিন-সমূহ, যদি না তোমার প্রভু ভিন্ন কিছু চান। এ এক অনন্ত অবিরাম পুরস্কার। {১১:১০৬,১০৭,১০৮}

যতদিন ‘সামাওয়াত ওয়াল আরদ’ থাকবে- ততদিন জান্নাত ও জাহান্নাম থাকবে।


সামাওয়াত ওয়াল আরদ হলো
মহাকাশ ও যমিন-সমূহ। অর্থাৎ, মাথার ওপর আকাশ, তারও ওপর আলোয় উদ্ভাসিত অসীম অন্ধকার মহাশূন্য হলো সামাওয়াত। তার মাঝে যতগুলো গ্রহ উপগ্রহ আছে- সেসবই হলো আরদ বা যমিন।

অর্থাৎ, কিয়ামতের বহু বছর পর (ধারণাতীত সময়) আবারও আরেকটি বিগ বাউন্স!

৪.

বিগ বাউন্স তত্ত্ব অনুযায়ী প্রতিটি ধ্বংস বা এক বিন্দুতে সংকোচন হয় পুনরায় সৃষ্টির জন্য। ধারণা করা যায়- প্রচণ্ড উন্নত মহাবিশ্বের জন্য মানুষকে আরও উন্নত করে সৃষ্টি করা হবে। সবকিছু সঠিকভাবে মহান আল্লাহ জানেন। প্রথম থেকে সপ্তম পর্যায়ে আমরা সুস্পষ্টভাবে তা-ই দেখছি। তাঁর সৃষ্টিতে কোনো কিছুই কম হয় না। সেই অনুযায়ী মানুষও মহা-উন্নত হয়ে উঠবে। যেভাবে- মানুষের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের সৃষ্টিতে সেই উন্নতি আমরা সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণসহ দেখেছি। তাই ৮ম পর্যায়েও সৃষ্টিতেও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলেই ধরে নেওয়া যায়। দেখা যাচ্ছে, মানবজাতি মহা-পরাক্রমশালী রব্বুল আলামিনের শক্তিশালী বা উপযুক্ত প্রতিনিধি হয়ে গড়ে উঠছে ধাপে ধাপে!

পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অকল্পনীয় প্রচণ্ড উন্নত হচ্ছে মানুষ!


পরিবর্তন, উন্নয়ন ও বিকাশ হলো এই মহাবিশ্বের পরিণতি ও নিয়তি। মৃত্যু ও জন্ম হলো মানুষ এবং অন্যান্য সৃষ্টির উন্নয়নের পদ্ধতি। এভাবেই চলছে সবকিছু- সবসময়। তাহলে, হঠাত্ করে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবে
এমন চিন্তা আসবে কেন ! মহান রবের সুন্নত বা পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন নেই, এ তো কিতাবেরই কথা ! তিনি এই নিয়মে সবকিছু এগিয়ে নিচ্ছেন। সেই মহাপরিকল্পনার আলোকেই সবকিছু অগ্রসর হচ্ছে।

তোমরা কখনও আল্লাহর সুন্নতে কোনো পরিবর্তন (no change) পাবে না এবং তোমরা আল্লাহর সুন্নতে কোনো ব্যতিক্রমও (no alteration) পাবে না। {৩৫:৪৩}

এটাই আল্লাহর সুন্নত (سُنَّةَ), প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। তুমি আল্লাহর সুন্নতে কোনো পরিবর্তন পাবে না। {৪৮:২৩}

৫. মহাবিশ্ব সৃষ্টির ছয়টি ধাপ/পর্যায়/ فِيْ سِتَّةِ اَيَّامٍ

মহাবিশ্বজগৎ সৃষ্টির বিস্ময়কর এ ধাপ বা পর্যায়ের ঘটনাগুলো বর্ণনা করা হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বিভিন্ন বক্তব্যে। যেমন-

৭:৫৪اِنَّ رَبَّكُمُ اللّٰهُ الَّذِيْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ فِيْ سِتَّةِ اَيَّامٍ

নিশ্চয়ই তোমাদের রব আল্লাহ যিনি সৃষ্টি করেছেন মহাকাশ ও যমিন ছয়টি ধাপে/পর্যায়ে… ৭:৫৪


একই বক্তব্য আছে ১০:৩, ১১:৭, ২৫:৫৯, ৩২:৪, ৫০:৩৮, ৫৭:৪

সবগুলো বক্তব্যে অসীম মহাকাশ ও গ্রহ-উপগ্রহ (যমিন) সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত ছয়টি ধাপ বা পর্যায়ের কথা জানা যায়।

এই ছয়টি ধাপ বা পর্যায় কেমন? সে তথ্যও পাওয়া যায় নিচের আয়াতগুলোতে।

যারা অস্বীকার করে তারা কি দেখে না যেমহাকাশ ও যমিন ছিল একত্রিতঅতঃপর তাদেরকে আলাদা করেছি…  ২১:৩০

এখানে ২টি পর্যায় রয়েছে! একত্রিত মহাকাশ যমিন সৃষ্টি প্রথম একটি পর্যায়। এরপর তা আলাদা করা’ একটি পর্যায়। আলাদা করার প্রক্রিয়ায় প্রচণ্ড শক্তি/বিস্ফোরণ প্রয়োজন। যা ঘটেছিল একটি সংকোচন বা বিগ বাউন্স থেকে; যা দ্বিতীয় পর্যায়

🧿 ৪১:৯ বলতোমরা কি অস্বীকারই করছ যিনি যমিন সৃষ্টি করেছেন দুই ধাপে/পর্যায়ে (فِيْ يَوْمَيْنِ) আর তাঁর সমকক্ষ বানাচ্ছ? তিনিই বিশ্বজগতের রব!

এখানে আরও ২টি পর্যায়ে যমিন/ ভূপৃষ্ঠগুলো সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, ৩য় ও ৪র্থ নম্বর প্রচণ্ড সংকোচন পর্যায় পার হয়ে পৃথিবী কিছুটা বাস উপযোগী হয়। অবশ্য, তখনও অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের অবস্থা মানুষের জন্য ভয়াবহ বাস-অযোগ্য থাকার কথা, যেমনটি এখন আছে। এ পর্যন্ত যে চারটি পর্যায় পার হলো, তার কথা বলা হয়েছে পরের আয়াতেই!

🧿 ৪১:১০,১১,১২ আর বানালেন তার মধ্যে পর্বতমালা (رَوَٰسِىَ) তার ওপরে (مِنْ فَوْقِهَا) এবং তার মধ্যে কল্যাণ দিলেন; আর তাতে নির্ধারণ করলেন তাদের সামগ্রী (أَقْوَٰتَهَاَ) সমান চারটি পর্যায়ে অনুসন্ধানকারীদের জন্য (لِّلسَّآئِلِينَ) অতঃপর তিনি আকাশে উস্তাওয়া (ٱسْتَوَىٰٓ) করলেন, যা ছিল ধোঁয়া/গ্যাসীয় পদার্থ (دُخَانٌ); তারপর তিনি তাকে ও যমিনকে বললেন- উভয়ে আসো স্বচ্ছন্দে বা কষ্ট হলেও, তারা বলল আমরা এলাম স্বেচ্ছায়-সানন্দে। অতঃপর তিনি আকাশকে দুই পর্যায়ে সাত আকাশে পরিণত করলেন এবং প্রত্যেক আকাশে তাঁর নির্দেশ (أَمْرَهَاۚ) ওহি করলেন; আর আমরা দুনিয়ার আকাশকে সুশোভিত করলাম প্রদীপমালা দিয়ে, আর সুরক্ষিত করলাম; এটা মহাপ্রতাপশালী ও মহাজ্ঞানী আল্লাহর ব্যবস্থাপনা।

এখানে সর্বশেষ ২টি পর্যায় পাওয়া যায়। মহা-পরাক্রমশালী স্রষ্টার আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বেচ্ছায় ও সানন্দে এক বিন্দুতে গিয়ে পড়ে মহাশূন্য ও গ্রহ-উপগ্রহগুলো। অর্থাৎ, আরেকটি মহা সংকোচন; যা ৫ম ধাপ। এই সংকোচনের পরের পর্যায়ে যে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়, তা বর্তমান অবস্থা। যা চলমান ষষ্ঠ ধাপ।

এই প্রতিটি পর্যায় হলো একেকটি বিগ বাউন্স বা তীব্র সংকোচন। প্রতিটি সংকোচন হলো একেকটি কিয়ামতের মতো অবস্থা। তবে, প্রতিটি পর্বে উন্নত থেকে উন্নততর সৃষ্টি দেখা যায়। মহান রবের এই সুন্নত বা রীতি-পদ্ধতি অপরিবর্তনীয়!

৫০:৩৮ আর নিঃসন্দেহে আমরা সৃষ্টি করেছি মহাকাশ ও যমিন আর তার মাঝে যা কিছু আছে- ছয়টি পর্যায়ে (فِيْ سِتَّةِ اَيَّامٍۖ); আর ক্লান্তি-শ্রান্তি-অবসাদ (لُّغُوبٍ) আমাদের স্পর্শ করে না!

 বিগ বাউন্স এবং বিগ ক্রাঞ্চ মডেলটির ছবি তৈরি করেছেন চিত্রশিল্পীরা। ছবি থেকে বিজ্ঞানের ধারণাটির একটি অনুধাবনযোগ্য ছবি থেকে বোঝা যায় মহা সঙ্কোচন ও মহা সম্প্রসারণের বিষয়টি। সংকোচন ও প্রসারণ কেন হচ্ছে, কোন শক্তির প্রভাবে হচ্ছেসে সম্পর্কেও ধারণা করেছেন বিজ্ঞানীরা। সেই মহাশক্তির নামও দিয়েছেন বিজ্ঞানীরাডার্ক এনার্জি।

এই ৬টি পর্যায় বা ধাপ বা ইয়াওমে (في ستة أيام) সৃষ্টি করা হয়েছে মহাকাশ ও যমিনসমূহ। আর গোটা প্রক্রিয়াটির সারাংশ বর্ণনা করা হয়েছে সুরা আল-ক্দরে।

  • ৯৭:১-৫ নিশ্চয়ই আমরা তা অবতীর্ণ করেছি শক্তিময় আঁধারে (لَيْلَةِ الْقَدْرِ); আর কীভাবে তুমি জানবে শক্তিময় আঁধার (لَيْلَةِالْقَدْرِ) কী ?! শক্তিময় আঁধার-টি (لَيْلَةِالْقَدْرِ) হাজার ঘটনার (اَلْفِشَهْرٍۗ) চেয়ে উৎকৃষ্ট (خَيْرٌ)। অবতীর্ণ হয়েছিল মালাইকা ও আর-রুহ তার মধ্যে তাদের রবের অনুমতিক্রমে সব বিষয়ের নির্দেশ (كُلِّاَمْرٍۛ) নিয়ে (مِنْ)। গভীর প্রশান্ত ছিল সেই প্রচণ্ড গতির আলোর আবির্ভাব (مَطْلَعِ الْفَجْرِ) পর্যন্ত!

আর, এই ধারাবাহিকতায় ধেয়ে আসছে কিয়ামত’ বা আরেকটি ধ্বংসযজ্ঞের মহা সংকোচন

৬. শেষ কথা

ধারাবাহিক এই প্রক্রিয়াটি আরেকবার দেখা যাক:

জান্নাতে আদমকে শিশু-কিশোর অবস্থায় সৃষ্টি করা হয়েছিল। আদম মানে, দেহ ও নফসের সমন্বয়ে গঠিত একটি সৃষ্টি। দেহ হলো দৃশ্যমান পদার্থের তৈরি এবং নফস হলো অদৃশ্য শক্তির তৈরি। ইতোমধ্যে পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে ফেলা হয়েছে। আর সেই পৃথিবীর অবস্থান সামাওয়াত ওয়াল আরদের (মহাবিশ্বের) মধ্যে। যেখানে গতি ও সময় দিয়ে সব কিছু বাঁধা। সৃষ্টি, বিকাশ, ধ্বংস হলো এই মহাবিশ্বের নিয়ম।

✅এই পৃথিবীতে মানুষের দেহের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া মহা বিস্ময়কর নফস বা আত্মার পূর্ণতা/ বিকাশ হয়। কারও নফস পবিত্র/ সুষ্ঠুভাবে কারও-বা অপবিত্র/ নষ্ট-বক্র-ভাঙ্গাচোরা হয়।

✅জান্নাতে সঠিকভাবে বিকশিত নফসগুলোকে পুরস্কার দেওয়া হবে। জান্নাতে উপভোগের মাধ্যমে নফস নিশ্চয়ই আরও উন্নত ও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। অন্যদিকে জাহান্নামে অবাধ্যদের শাস্তি দেওয়া হবে। তাদের বিকৃত/ অপবিত্র/ নষ্ট-বক্র-ভাঙ্গাচোরা নফসকে সঠিক আকার দেওয়া হয়। নফস হলো ফোর্স ফিল্ড বা শক্তি ক্ষেত্র। যা প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগে ঠিক করা হবে বলেই বোঝা যায়। যেহেতু এসবই নফসই মানুষ যা চেতনাপ্রাপ্ত, তাই তারা ভয়াবহ প্রচণ্ড শাস্তির মধ্যে দিয়ে যাবে। আর, এমন ভয়াবহ অবস্থাতেও টিকে থাকবে মহান রবের বিস্ময়কর সৃষ্টি মানুষ। এ বিষয়টিকেই মানুষের উপযোগী করে বর্ণনা করা হয়েছে আল-কিতাবে।

✅এই পর্যায়ের বিভিন্ন বিষয় বা প্রয়োজন শেষ হলে জাহান্নামের মেয়াদ পূর্ণ হবে, জান্নাতের মেয়াদও শেষ হবে; ফের সংকোচন বা ধ্বংস হবে (another Big-Bounce) সব কিছু। নতুন একটি পর্যায়ের দিকে ধাবিত হবে সব সৃষ্টি।

✅এই ধ্বংস হলো আরও উন্নত সৃষ্টির জন্য। ধাপে ধাপে উন্নত হচ্ছে মানুষ ও মহা-বিশ্বজগৎ।

গোটা ইউনিভার্সের যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে যা দেখা যায় তা হলো- সৃষ্টি, ধ্বংস ও বিবর্তনের ধারাবাহিক দশা। অদৃশ্যের মধ্যেও অদৃশ্য-সম ক্ষুদ্র এই পৃথিবীতে সব প্রাণীর বিবর্তন দেখা যায়। শুধুমাত্র মানুষের দেহের কোনো বিবর্তন হয় নি। লক্ষ বছরের প্রাচীন মানব-ফসিল থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের মানবদেহের গঠন হুবহু একই রকম আছে। মানুষের পরিবর্তন বা বিবর্তন হয়েছে শুধুমাত্র চিন্তায় ও কাজে। গুহাবাসী থেকে অট্টালিকাবাসী পর্যন্ত মানুষের পরিবর্তন, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে জ্ঞানের সম্প্রসারণের মাধ্যমে হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় আরও হাজার লক্ষ বছর পর মানুষের জ্ঞান অকল্পনীয় উন্নত হবে বলেই ধরে নেওয়া যায়।

তবে, তারপরও মানুষ পৃথিবীর জীবনে মহা-বিশ্বজগতের প্রভুকে দেখতে পাবে না। রব্বুল আলামিনকে চর্মচক্ষু দিয়ে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাই, মানবদেহেরও মহা-পরিবর্তন হবে কিয়ামত-এর পর। সেদিন যাবতীয় মহাসত্য এক এক করে উদ্ভাসিত হবে সবার সামনে।

প্রথম প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *