কবিরা গুনাহ

বড় গুনাহ, কবিরা গুনাহ (Major Sin)

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্‌ নির্দিষ্ট কিছু কাজকে বড় গুনাহ বা কবিরা গুনাহ বলে উল্লেখ করেছেন এবং সরাসরি জাহান্নামের খবর জানিয়ে দিয়েছেন। তা হলো- 

   ১. মহান আল্লাহ্‌র সঙ্গে শরিক করা বা শিরক্‌ করা 
   ২. স্বেচ্ছায় কোনও মুসলিমকে হত্যা করা
   ৩. মুনাফেকি আচরণ করা 
   ৪. এতিমদের সম্পদ আত্মসাৎ করা
   ৫. 
মানুষকে বিদ্রুপ ও নিন্দা করা

এই ক’টি গুনাহের ক্ষেত্রে জাহান্নামের আযাব বা শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং সরাসরি ‘কবিরা গুনাহ’ বলা হয়েছে।

পাশাপাশি, মহান আল্লাহ্‌র পূর্ববর্তী কিতাব অর্থাৎ, তাওরাতে (তোরাহ) ইহুদি জাতির জন্য কিছু কাজে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এখানে তাও উল্লেখ করা হলো; যাতে তাওরাতের আয়াতকে অজ্ঞতাবশতঃ নিজেদের ওপর আরোপ না করি। 

বড় গুনাহ, কবিরা গুনাহ বা Major Sin

বাস্তবতা হলোপবিত্র কুরআনে বড় গুনাহ বা কবিরা গুনাহর কোনও তালিকা দেওয়া হয়নি। তবে, এমন কিছু গুনাহর কথা উল্লেখ আছে, যা করলে জাহান্নামের শাস্তির ঘোষণা এসেছে; অথবা সরাসরি বলা হয়েছেকবিরা গুনাহ। সেসব অপরাধ বা গুনাহকেই বড় গুনাহ, কবিরা গুনাহ বা Major Sin বলা হয়।

পাশাপাশি, এসব গুনাহ সম্পর্কে আল্লাহপাক জানিয়ে দিয়েছেন যে-

তোমদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে সেসব কবিরা গোনাহ্‌ থেকে দূরে থাকলে আমরা তোমাদের ছোট পাপগুলো ক্ষমা করব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব।(৪:৩১)

সার্বিকভাবে এটিই হলো কুরআনিক মূলনীতি। এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই বড় পাপ বা বড় অপরাধগুলো সম্পর্কে জানা যায়।

  ১. আর তোমরা ইয়াতিমদের ধন-সম্পদ ফিরিয়ে দাও, ভালোর সঙ্গে মন্দ বদল করো না এবং তোমাদের সম্পদের সাথে তাদের সম্পদ মিশিয়ে গ্রাস করো না; নিশ্চয় এটা কবিরা গুনাহ। (সুরা নিসা: ০২)

  ২. নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করেন; আর যেই আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে এক মহাপাপ রটনা করে। (সুরা নিসা: ৪৮)

  ৩. আর কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনককে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লানত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন। (সুরা নিসা: ৯৩)

  ৪. নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে। আর তুমি কখনও তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী পাবে না। (সুরা নিসা: ১৪৫)

  ৫. ধ্বংস-দুর্ভোগ এমন প্রতিটি ব্যক্তির জন্যে, যে মানুষকে বিদ্রুপ করে এবং নিন্দা করে। খনও না, তাকে অবশ্যই নিক্ষেপ করা হবে ‘হুতামায়’;  আল্লাহর আগুন, যা জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। (সুরা হুমাযা: ১,,৫,৬)

উপরোক্ত পাঁচ বাক্যে ৫টি কবিরা গুনাহ বা বড় ধরনের গুনাহ পাওয়া যায়। 

  • মহান আল্লাহ্‌র সঙ্গে শরিক করা বা শিরক্‌ করা
  • স্বেচ্ছায় কোনও মুসলিমকে হত্যা করা 
  • মুনাফেকি আচরণ করা
  • এতিমদের সম্পদ আত্মসাৎ করা
  • মানুষকে বিদ্রুপ ও নিন্দা করা

বি.দ্র.: ২.১ যে আত্মহত্যা করে, সে মূলত নিজেকেই হত্যা করে-যা হত্যারই শামিল বলে মনে হয়।

এবার প্রাসঙ্গিক আরও কিছু গুনাহ্‌র কথা তুলে ধরব, যা বনি ইসরাইল বা ইহুদিদের জন্য আল্লাহ্‌র নির্ধারিত গুনাহ বা নিষিদ্ধ কাজের তালিকা ছিল। ইহুদিদের জন্য পাপএমন কাজের তালিকা সম্পর্কে জানতে পারলে বোঝা যাবে যে, আমরা ইহুদিদের বিধান কতটুকো মেনে চলছি! ( আস্‌তাগফিরুল্লাহ!)

উল্লেখ্য, মহান আল্লাহ মুসা (আ)-কে তুর পাহাড়ে ডেকে নিয়ে দুটি পাথর খণ্ডে এই দশটি নিষেধের আদেশ খোদাই করে দিয়েছিলেন। মুসা (আ) এই পাথর খণ্ড দুটি নিয়ে ইহুদিদের কাছে ফিরে আসেন।

 তাওরাতের এ বিধান বাইবেলের [Exodus] এক্সোডাস ২০ অধ্যায়ের ১-১৭ অনুচ্ছেদ এবং [Deuteronomy] ডিউটরনমি ৫ অধ্যায়ের ৬-২১ অনুচ্ছেদেও পাওয়া যায়। তাই খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে খোদাভীরু লোকজন একে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে

 এখানে বলা হয়েছে যে- শিরক করবে না, ছবি আঁকবে না, মূর্তি বানাবে না/খোদাই করবে না, সাবাথ ডে (শনিবার) পবিত্র দিন, পিতা-মাতাকে মান্য করো, মানুষ হত্যা করবে না, ব্যাভিচার করবে না, চুরি করবে না, প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না এবং প্রতিবেশীর সম্পদের প্রতি লোভ করবে না।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এই টেন কমান্ডমেনট্স বা ১০ নির্দেশিকা শুধুমাত্র ইহুদি ও পরবর্তী খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারীদের জন্য প্রযোজ্য ছিল এবং এখনও আছে।

এর মধ্যে থেকে যেসব নিষেধ মুসলিমকে মানতে হবেআল্লাহ তা কুরআনেই উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্‌র নির্দেশের বাইরে গিয়ে ইহুদিদের জন্য নিষিদ্ধ কাজ কেউ যদি নিজের ওপর চাপিয়ে নেয়তা কি গ্রহণযোগ্য হবে??

মহান আল্লাহ্ উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ইহুদিদের জন্য অবাধ্যতার শাস্তি হিসেবে অনেক কিছুই নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। (তাদের অবাধ্যতার কারণে আমরা এই শাস্তি দিয়েছিলাম: আনআম ১৪৬)

তাওরাতে নাযিল করা এসব নির্দেশিকার ব্যাপারে কুর’আনেও সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। এখানে তা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হলো। কারণ, এই আয়াতসমূহের কিয়দাংশ উল্লেখ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শাসন করে থাকেন মুসলিম আলেম-ওলামাগণ। তাই গোটা অনুচ্ছেদের সরল বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা জরুরি। সুরা আন’আমের এই অনুচ্ছেদগুলো ইহুদি জাতির অবাধ্যতা ও তাদের সঙ্গে প্রিয় রসুলের কথোপকথন তুলে ধরেছে। মহান আল্লাহ তাঁর রসুল সা-কে শিখিয়ে দিচ্ছিলেন যে- ইহুদিদের সঙ্গে বিশেষ কোন্‌ শব্দ ও বাক্য দিয়ে কথা বলতে হবে! যেভাবে কথা বললে ইহুদিরা বুঝবে যে- মোহাম্মদ রসুল-আল্লাহ প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহ্‌র রসুল ও নবী। যাঁর আগমনের অপেক্ষা তারা করছিল হাজার হাজার বছর ধরে!

সুরা আনআম ১৪৬-১৫৩                                                  অনুবাদক:   মাওলানা আব্দুস শহীদ নাসিম

         আমরা ইহুদিদের জন্যে নখরধারী সব পশুই হারাম করে দিয়েছিলাম। গরু এবং ছাগলের চর্বিও তাদের জন্যে হারাম করেছিলাম, তবে পিঠের, অন্ত্রের কিংবা হাড়ের সাথের চর্বি ছাড়া। তাদের অবাধ্যতার কারণে আমরা তাদের এই শাস্তি দিয়েছিলাম। অবশ্যি আমরা সত্যবাদী।

         তারপরও যদি তারা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করে, তুমি বলো: তোমাদের প্রভু অসীম দয়ার মালিক এবং অপরাধী লোকদের উপর থেকে তাঁর শাস্তি রদ করা হয়না।

         শিরকে লিপ্ত লোকেরা অচিরেই তোমাকে বলবে: ‘আল্লাহ চাইলে আমরা শিরক করতামনা এবং আমাদের পূর্ব পুরুষরাও, আর আমরা কিছু হারামও করতামনা।’ এভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছিল তাদের আগের লোকেরাও, অবশেষে তারা ভোগ করেছিল আমার শাস্তি। হে নবী! বলো: ‘তোমাদের কাছে কোনো এলেম আছে কি? থাকলে বের করো আমাদের সামনে। আসলে তোমরা অনুমান ছাড়া আর কিছুরই অনুসরণ করোনা, আর মনগড়া কথা ছাড়া কোনো কথা বলোনা।’

         হে নবী! বলো: চূড়ান্ত প্রমাণের মালিক হলেন আল্লাহ। তিনি চাইলে অবশ্যি তোমাদের সবাইকে হিদায়াত করতেন।

         হে নবী! তাদের বলো এগুলো হারাম হবার ব্যাপারে যারা সাক্ষ্য দেবে তোমাদের সেসব সাক্ষীদের হাজির করো।’ তারপর তারা সাক্ষ্য দিলেও তুমি তাদের সাথে স্বীকার করোনা। যারা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করে, যারা আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখেনা এবং যারা তাদের প্রভুর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে, তুমি তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করোনা।

          হে নবী! বলো: ‘এসো, তোমাদের প্রভু তোমাদের জন্যে যা হারাম করেছেন তা তোমাদের তিলাওয়াত করে শুনাই। সেগুলো হলো: তোমরা তাঁর সাথে কোনো কিছুকেই শরিক করবেনা, পিতা – মাতার প্রতি ইহ্সান করবে, দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবেনা, কারণ আমরাই তাদের এবং তোমাদেরও রিযিক দেই, প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে অশ্লীল কাজের কাছেও যেয়োনা। আল্লাহ যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন তোমরা তাকে হত্যা করোনা, তবে যথার্থ কারণ ও হক পন্থায় হলে ভিন্ন কথা। আল্লাহ তোমাদের এসব অসিয়ত (নির্দেশ) করছেন যাতে করে তোমরা আকল খাটাও।

          এতিমরা বয়োপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত উত্তম পন্থায় ছাড়া তাদের মাল সম্পদের কাছেও যেয়োনা। পরিমাণ ও ওজন নায্যভাবে পূর্ণ করে দাও। আমরা কোনো ব্যক্তির উপর তার সাধ্যের বেশি বোঝা চাপাই না। তোমরা যখন কথা বলবে, নায্য কথা বলবে নিকটজনের বিপক্ষে গেলেও। আল্লাহকে দেয়া অংগীকার পূর্ণ করো। আল্লাহ এসব অসিয়ত (নির্দেশ) তোমাদের প্রদান করছেন যাতে করে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।

          এটাই আমার সিরাতুল মুস্তাকিম (সরল সঠিক পথ), সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ করো। তোমরা বিভিন্ন পথের অনুসরণ করোনা, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। আল্লাহ তোমাদের এসব অসিয়ত (নির্দেশ) প্রদান করছেন যাতে করে তোমরা সতর্ক হও।

          তারপর আমরা মূসাকে দিয়েছিলাম কিতাব, যা ছিলো কল্যাণ পরায়ণদের জন্যে পরিপূর্ণ, সবকিছুর বিশদ বিবরণ, হিদায়াত এবং রহমত, যাতে করে তারা তাদের প্রভুর সাথে সাক্ষাতের প্রতি ঈমান আনে।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এসব কথা হলো রসুল-আল্লাহকে শিখিয়ে দেওয়া আল্লাহর ব্ক্তব্য- যা ইহুদিদেরকে বলতে বলা হয়েছে। কুর’আনে এগুলো বিশেষ ধরনের কথা (কোড ওয়ার্ড); যা কিছু ক্ষেত্রে আরবী শব্দই নয় (!); বরং, আরামাইক বা প্রাচীন কোনও ভাষার শব্দ! যা শোনামাত্র ইহুদিরা বুঝতে পারে যে- নিঃসন্দেহে এই ব্যক্তি (মোহাম্মদ সা.) আল্লাহর মেসেঞ্জার (নাহলে এই শব্দ ও বাক্যগুলো কোনোভাবেই তাঁর জানার কাথা না!) এবং তাঁর কথা আমাদের অবশ্যই মান্য করা উচিত। তবুও তারা অহঙ্কার/রাগ/জিদের কারণে কুরাইশদের মধ্য থেকে কোনও ব্যক্তিকে (মুহাম্মদ সা.কে) নবী ও রসুল হিসেবে মানতে অস্বীকার করে।

এসব আয়াতের অর্থ অনুধাবনের ক্ষেত্রে যে মূলনীতিটি বিবেচনায় রাখতে হবে, তা হলো- পবিত্র কুর’আনের যে আয়াতসমূহ যাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, সেসব নির্দেশ তাদের জন্যই প্রযোজ্য।

 –Quran Research Center- QRC

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *