আল্লাহর আনুগত্য ও রসুলের আনুগত্য- কুর’আনিক দৃষ্টিকোণ
১. ভূমিকা:
যারা ইসলামের পথে চলতে চান, তাদের জন্য আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্য অপরিহার্য। মহান আল্লাহ কুর’আনে অসংখ্যবার উল্লেখ করেছেন- আতিউল্লাহ ওয়া আতিউর রসুল। তাঁর নির্দেশ শিরোধার্য।
তবে, নির্দেশ পালনের জন্য- নির্দেশ অনুধাবন করা জরুরি।
তিনি কি নির্দেশ দিলেন? তিনি কাকে নির্দেশ দিলেন? এই নির্দেশ কি আপনার-আমার জন্য? এই মৌলিক বিষয়গুলো বোঝা জরুরি। তারপর সেই নির্দেশ পালন করা কর্তব্য।
অন্ধ আনুগত্য, অন্ধ বিশ্বাস, ধর্মান্ধতা- কোনোটাই আল্লাহ পছন্দ করেন না। গোটা কুর’আন-জুড়ে তিনি অসংখ্যবার যুক্তি প্রমাণ দিয়ে নবী রসুলদের পথ দেখিয়েছেন, প্রজ্ঞা ও হিকমত শিক্ষা দিয়েছেন। চোখ বন্ধ করে কোনও পথ চলার শিক্ষা ইসলাম দেয় না। বরং ঠিক তার বিপরীত শিক্ষাই ইসলাম দেয়! চোখ খোলো- দেখো, বোঝো, যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করো এবং পথ চলো।
আমরা ইবরাহিমকে তার জাতির মোকাবিলায় এসব যুক্তি-প্রমাণ দিয়েছিলাম। আমরা যাকে চাই উঁচু মর্যাদা দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু প্রজ্ঞাবান সর্বজ্ঞানী। {৬:৮৩}
আল-কিতাবে বার বার বলা হয়েছে- তোমরা কি বোঝো না? তোমরা কি বিচার-বিশ্লেষণ করো না? তোমরা কি দেখো না? তোমরা কি আকল খাটাও না?
কত-শত বার মহাপ্রভু তাঁর ইবাদ-দের এভাবে প্রশ্ন করে জাগ্রত করতে চাইছেন তার শেষ নেই।
কিন্তু আমরা জাগ্রত হই না। আমরা কুর’আনের নির্দেশের চেয়ে সমাজের তথাকথিত আলেম-ওলামার নির্দেশ বেশি পছন্দ করি। আমরা কুর’আনিক অর্ডারের চেয়ে অ্যারাবিক কালচার বেশি ভালোবাসি। আমরা আল্লাহর বিধানের চেয়ে মানুষের মনগড়া বিধি-বিধান বেশি অনুসরণ করি।
তবে যারাই প্রকৃত অর্থে কুর’আনের নির্দেশ মানতে চান; তাদের জন্য ‘আতিউল্লাহ ওয়া আতিউর রসুল’-এর ভিত্তিতে রচিত এই প্রবন্ধ।
২. সমাজের প্রচলিত ধারণা:
সাধারণ-ভাবে বলা হয়, আল্লাহর আনুগত্য হলো- কুর’আনের অনুসরণ এবং রসুলের আনুগত্য হলো হাদিস ও সুন্নাহর অনুসরণ। তাই, হাদিস ও সুন্নাহর অনুসরণ না করলে ‘রসুলের আনুগত্য’ বা ‘আতিউর রসুল’ হয় না। এটাই সুন্নি, শিয়া, হানাফি, হাম্বলি সালাফি, ওয়াহাবি, তরিকতি, সুফি—সবার মত ও পথ। সবাই একমত কিন্তু সবার পথই আলাদা! কী আশ্চর্য! যাই হোক…।
বোঝানো হয়, আল্লাহর আনুগত্য ও রসুলের আনুগত্য দু’টি ভিন্ন কাজ। তাই আল্লাহর নির্দেশ পালনের পাশাপাশি রসুলের হুকুম-আহকাম-নির্দেশ পালন করতে হবে।
রসুল যেভাবে কথা বলেছেন, যেভাবে পোশাক পরেছেন, যেভাবে ওঠাবসা, চলাফেরা করেছেন- তাই করতে হবে। হাদিসের বইয়ে তিনি যা বলেছেন- তা শুনতে হবে, মানতে হবে। এটাই রসুলের আনুগত্য। দাবি করা হয়- এটাই হলো কুর’আনের ব্যাখ্যা। রসুল যা করেছেন- তা হলো কুর’আনের ব্যাখ্যা। তা মান্য করা ছাড়া ভিন্ন কোনও পথ নাই।
আর আমরা দেখতে পাই, এই দাবির প্রতি অটল থেকে বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজ আজ শত-দলে বিভক্ত হয়েছে- প্রত্যেকের পথই আলাদা!
৩. মৌলিক নির্দেশ:
কুর’আনে বলা হয়েছে- “أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ” ‘আল্লাহর আনুগত্য করো ও রসুলের আনুগত্য করো’ ‘Obey Allah and Obey Messenger’।
বিস্তারিত আলোচনার শুরুতে ২টি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি।
ক) মনে রাখা দরকার যে- কুর’আনের টার্গেট-অডিয়েন্স দু’টি। প্রথমত, যারা কুর’আন নাযিল প্রত্যক্ষ করছিলেন। অর্থাৎ তারা ছিলেন প্রিয়নবী মোহাম্মদুর রাসুলাল্লাহর সমসাময়িক লোকজন।
দ্বিতীয়ত, প্রিয় নবীর ওফাতের পর কিয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানুষ। সবার জন্যই কুর’আনে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং তা সংরক্ষণ করছেন স্বয়ং মহাজগতের প্রতিপালক।
খ) একটি উদাহরণ খেয়াল করুন। কেউ আপনাকে বললো- আমাকে অনুসরণ করো (Follow me)। আপনি তাকে অনুসরণ করবেন। সে যে কাজটি যেভাবে করে—আপনিও সেই কাজ সেভাবেই করবেন। এটাই অনুসরণ বা Following। আরবি ভাষায় একে বলে ইত্তিবা।
যেমন, মৃত কোনও মানুষের স্মরণে আমরা যদি তারই মতো পোশাক-আশাক পরি, তারই পছন্দের কোনও কাজ করি- সেটা হলো অনুসরণ বা Following।
কিন্তু কেউ যদি বলেন- আমার আনুগত্য করো (Obey me)। তাহলে, তিনি আপনাকে যা কিছু করার আদেশ/নির্দেশ করবেন- আপনি তাই করবেন। তিনি নিজে সেই কাজটি না করলেও, আপনাকে নির্দেশ করলে এবং আপনি তা মান্য করলে, তাকেই বলে Obeying বা আনুগত্য করা। আরবি ভাষায় এটি হলো ত্বয়া বা ইত্বয়াত। কারও নির্দেশ মান্য করে অন্যের জমির গাছ কাটলে, অন্যের ঘরে আগুন জ্বালালে—যে মামলা হবে, তার প্রধান আসামী হয় নির্দেশদাতা মানুষটি।
আর সুদূর অতীতের বাজে কোনও ঘটনার (উদাহরণ) অনুসরণ করে কেউ মন্দ কাজ করলে- তার জন্য দায়ী থাকে অপকর্ম করা বর্তমানের খারাপ মানুষটি।
এসব উদাহরণ থেকে স্পষ্ট যে- মৃত ব্যক্তির অনুসরণ করা যায় কিন্তু আনুগত্য করা যায় না। কারণ, মৃত মানুষ কখনও নির্দেশ দিতে পারে না। তাই তার নির্দেশ পালন করার সুযোগ থাকে না, আনুগত্য করার পথও বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি মৃত মানুষকে আনুগত্য করতে বলাও যায় না। তা হাস্যকর পাগলামি; তাই নয়কি?
নিশ্চয়ই বলবেন, এই দাবি কি কুর’আন সমর্থন করে? এরকম উদাহরণ কি কুর’আনে আছে? চলুন দেখা যাক।
আমরা বরং বলতে চাই—মহাগ্রন্থ আল-কিতাব যদি শুধুমাত্র এই ধারণার ব্যাপারেই কথা বলে- তাহলে আপনি কী করবেন? মহাগ্রন্থ আল-কুর’আন থেকে কতগুলো (?) উদাহরণ পেলে আপনি এই দাবি মেনে নেবেন? নিজেকেই উত্তর দিন।
নিঃসন্দেহে আমরা তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছি কিতাব যাতে আছে তোমাদের কথা/উপদেশ (ذِكْرُكُمْ); তোমরা কি বুঝবে না? {২১:১০}
৪. কুর’আনের আয়াত ও বাস্তবতা
আল-কুর’আনের বিভিন্ন আয়াতে বলা হয়েছে যে ‘আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্য কর।‘ খেয়াল করলেই দেখা যায়- কুর’আনে কখনোই ‘নবীর আনুগত্য করো’ বা ‘মোহাম্মদের আনুগত্য করো’ বলা হয়নি।
কারণ কি? বলা হয়েছে ‘রসুলের আনুগত্য’।
এর একটি কারণ ‘রসুল’ মর্যাদা বা খেতাবের সঙ্গে জড়িত- মহাজগতের প্রভুর রিসালা বা বার্তা। রসুলের আনুগত্য মানে- রিসালা, বার্তা বা কিতাব থেকে তিনি যে আদেশ করেন- সেই নির্দেশের আনুগত্য।
এর আরেকটি কারণ আনুগত্য ত্ব’আ/ আত্বয়া’ (أطاع) এবং অনুসরণ ইত্তিবা (إتبع)-শব্দ দু’টির পার্থক্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
আমরা বেশিরভাগই এই বিষয়টি বুঝি। কিন্তু যখনই আল্লাহ প্রসঙ্গে এ বিষয়টি আসে- তখনই আমরা অন্ধ হয়ে যাই। আফসোস! যাই হোক…।
বাস্তবতা হলো- মহাগ্রন্থে যতবার “أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ” “আল্লাহর আনুগত্য করো ও রসুলের আনুগত্য করো” নির্দেশটি এসেছে— ততবারই তা বলা হয়েছে- মোহাম্মদুর রসুলুল্লাহর বেঁচে থাকার সময় তাঁর সমসাময়িক লোকদেরকে (প্রথম অডিয়েন্স)।
স্বয়ং রসুলুল্লাহকে বলা হয়েছে- তুমি পথভ্রষ্ট কাফির ও মুনাফিকদের আনুগত্য (تُطِعِ তুত্বিয়ি) কোরো না {৩৩:১}। (সেসময় যারা জীবিত)।
শুধু তাই নয়, মোহাম্মদ রসুলুল্লাহকে বলা হয়েছে অনুসরণ বা ইত্তিবা করতে। কার অনুসরণ (ইত্তাবি ٱتَّبِعۡ)? হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া নবী ও রসুল জনাব ইবরাহিম আ.-এর অনুসরণ {১৬:১২৩}। যেহেতু তিনি মৃত; তাঁর আনুগত্য করা সম্ভব না। করতে হবে অনুসরণ।
এবার কুর’আনের কিছু আয়াত দেখা যাক। অন্যান্য আয়াতের নম্বরও উল্লেখ করা হলো। আগ্রহীগণ নিজ দায়িত্বে কিতাব থেকে পড়ে নিতে পারেন।
- নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন আমানত তার হকদারকে দিয়ে দিতে। তিনি আরো নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচার ফায়সালা করবে, ন্যায় ও ইনসাফের সাথে সুবিচার করবে। আল্লাহ তোমাদের অতি উত্তম উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
- হে লোকেরা যারা ঈমান এনেছো! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, আনুগত্য করো এই রসুলের, আর তোমাদের মধ্যে সেইসব লোকদের- যারা দায়িত্বশীল ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত। আর তোমরা যখনই কোনো বিষয়ে মতভেদ ও মতবিরোধ করবে, তা উপস্থাপন করো আল্লাহ ও রসুলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখো। এটিই কল্যাণকর পন্থা এবং পরিণতির দিক থেকেও সর্বোত্তম। {৪:৫৮,৫৯}
- তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং এই রসুলের আনুগত্য করো আর সতর্ক থাকো। কিন্তু তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে জেনে রাখো, আমাদের রসুলের দায়িত্ব শুধু সুস্পষ্টভাবে বার্তা পৌঁছে দেওয়া। {৫:৯২}
- হে নবী! বলো- তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো এই রসুলের। যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তার উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্যে সেই দায়ী হবে, আর তোমরা দায়ী হবে তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্যে। তোমরা যদি আনুগত্য করো, তবেই সঠিক পথ পাবে। স্পষ্টভাবে বার্তা পৌঁছে দেওয়া ছাড়া আমাদের রসুলের উপর আর কোনো দায়িত্ব নেই। {২৪:৫৪}
- হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রসুলের এবং তোমরা বিনষ্ট করোনা তোমাদের আমল। {৪৭:৩৩}
- তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো এই রসুলের, যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে জেনে রাখো, আমাদের রসুলের দায়িত্ব কেবল স্পষ্টভাবে বার্তা পৌঁছে দেওয়া। {৬৪:১২}
৫. অন্যান্য রসুল ও তাঁদের জাতি
‘আল্লাহর আনুগত্য ও রসুলের আনুগত্য’ নির্দেশ কিন্তু শুধুমাত্র মোহাম্মদ রসুলুল্লাহর ক্ষেত্রেই বলা হয়নি। বরং অতীতের অন্যান্য রসুলদের জাতির মানুষদেরকেও বলা হয়েছে। যারা সেসব রসুলদের সময় তাঁদের সমাজের জীবিত মানুষ ছিলেন। দেখুন..।
রসুলের আনুগত্য করা- কুর’আনের ভাষায় আতিউর রসুল। যখন রসুল বলেন ‘আমার আনুগত্য করো’ তখন তিনি বলেন- আতিঊ-নি (أَطِيعُونِ / wa-ati’uni / and obey me)
যেমন- ২৬ নং অধ্যায় সুরা শুয়ারা।
এই সুরায় মোট ৮বার বিভিন্ন রসুল বলেছেন- আল্লাহকে ভয় করো এবং আতিউ-নি, আমার আনুগত্য করো (আমার কথা শোনো)।
এ-কথাটি বলেছেন নুহ, হুদ, লুত ও শুয়াইব আলাইহিমুস সালাম। এ ছাড়া ৪৩:৬৩ আয়াতে ঈসা আ., ৭১:৩ আয়াতে নুহ আ. এবং ৩:৫০ মোহাম্মদ রসুলুল্লাহ বলেছেন আতিউ-নি أَطِيعُونِ ।
তাঁরা রসুল হিসেবে নিজদের জাতিকে বলেছেন- আতিউ-নি….আমাকে মান্য করো। দুই পক্ষই জীবিত।
সম্মানিত এসব নবী যখন রসুল বা বার্তাবাহকের ভূমিকায় রয়েছেন- তখনই মূলত আতিউ-নি–আমাকে মান্য/আনুগত্য করো বলেছেন।
উল্লেখ্য, কুর’আনে কোথাও ‘আতিউন-নাবি’ (নবীর
আনুগত্য করো/ obey the Prophet) বলা হয়নি।
মোহাম্মদুর রসুলুল্লাহকে আনুগত্যের নির্দেশটি সুস্পষ্টভাবে তাঁর রিসালাত বা রসুল হিসেবে ভূমিকার সঙ্গে জড়িত।
আর, হাজার বছর পরে আমাদের করণীয় কী? সেটাও কুর’আনে বহুবার সুস্পষ্ট করেছেন আলাহ্ রব্বুল আলামিন।
আর যারা বিশ্বাস করে, আমলে সলেহ করে এবং মোহাম্মদের ওপর যা নাযিল হয়েছে- তা মহাপ্রভুর পক্ষ থেকে মহাসত্য বলে মেনে নেয়—তিনি দূর করে দেবেন (তাদের) মন্দকাজ ও অবস্থা ভালো করে দেবেন।
আর যারা ঈমান আনে তারা ইত্তেবা (অনুসরণ) করে তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ মহাসত্যের।
এভাবেই আল্লাহ দৃষ্টান্ত দেন মানুষের জন্যে। {৪৭:২,৩}
আমি অনুসরণ করছি আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহিম, ইসহাক, ও ইয়াকুবের মতাদর্শ। {১২:৩৮}
এ ছাড়া, নিচের আয়াতগুলোতেও আতিউল্লাহা ওয়ার রসুল (أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُول) বলা হয়েছে। আগের পরের আয়াতগুলো পড়ে দেখুন।
৩:৩২, ১৩২; ৪:৫৯; ৫:৯২; ৮:১, ২০, ৪৬; ২৪:৫৪, ৫৬; ৪৭:৩৩; ৫৮:১৩; ৬৪:১২
আবারও উল্লেখ করা দরকার যে ত্ব’আ শব্দটি ইত্তিবা থেকে সুস্পষ্টভাবে থেকে ভিন্ন।
ত্বয়া (আত্বিউ) সবসময় জীবিত সত্তার জন্য। মৃত কাউকে ত্বয়া (আত্বিউ) করা যায় না। মহান আল্লাহ চিরঞ্জীব- শাশ্বত। তাই সর্বক্ষণ শুধুমাত্র তাঁরই ত্বয়া/ আনুগত্য করা যায়।
অন্যদিকে, কোনও একজন যা করছে- হুবহু তাই করাই হলো ইত্তিবা বা অনুসরণ করা।
যেমন প্রিয়নবী মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ সবসময় কুর’আনে ইত্তিবা/ অনুসরণ করেছেন। তাই, আমরা যদি শেষ-নবীর অনুসরণ করতে চাই, তাহলে তিনি যা যা করেছেন- আমাদেরকেও তাই করতে হবে।
- যথার্থই তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে নিদর্শনাবলী এসেছে; তাই যে দেখবে- তা নিজের জন্যই; আর যে অন্ধ থাকবে- সেটা তার জন্য ক্ষতিকর; এবং আমি তোমাদের অভিভাবক নই।
- আর এভাবে আমরা আয়াতগুলো ব্যাখ্যা করি, যাতে তারা বলে- তুমি অধ্যয়ন করেছো এবং এভাবে আমরা পরিষ্কার করি মানুষের জন্য- যারা জানে।
- তুমি অনুসরণ (ٱتَّبِعۡ) করো- যা তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে ওহি করা হয়; তিনি ছাড়া কোনও ইলাহ নেই; আর মুশরিকদের থেকে মুখ ঘুরাও। {৬:১০৪-১০৬}
দু’টি উদাহরণ।
উদাহরণ ১:
মনে করুন আপনার শহরের সবচেয়ে বড় গহনার দোকান থেকে সবচেয়ে দামী এক সেট গহনা অর্ডার করেছেন। দাম ৩ কোটি টাকা। বাজারমূল্য অনুযায়ী ৩ কোটি টাকা অনেক বেশি।
এত দামী ও মূল্যবান সম্পদ পাঠানোর জন্য দোকানের মালিক নিশ্চয়ই সাধারণ ডেলিভারি ম্যান (উবার/পাঠাও) বাছাই করবেন না। তিনি তাঁর কোম্পানির (বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য) ম্যানেজারকে বলবেন, অফিসের গাড়িতে করে তুমি নিজেই যাও- ক্লায়েন্টকে এই গহনা সেট দিয়ে আসো।
পণ্যের গুরুত্বের ওপর ভিত্তি করে সর্বোচ্চ মর্যাদার কর্মকর্তাকে নির্বাচন করা হয়।
মহাজগতের প্রভুর বাণী, যা দিয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, যোগাযোগ করেছেন…সেই বাণী পাঠানোর জন্য মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদার (নবী) মানুষকে তিনি বেছে নিয়েছেন। মানবজাতির মধ্যে শুধুমাত্র নবী মর্যাদার মানুষরাই মহান আল্লাহর সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ করার অধিকার লাভ করেছে। এজন্যই তাঁরা নবী। নবী শব্দটি এসেছে ‘নাবা’ শব্দ থেকে। যার অর্থ উঁচু করা, উন্নত করা। নুবুওয়া শব্দের অর্থ ‘উচ্চ বা উঁচু স্থান‘।
উদাহরণ ২:
মনে করুন, আপনি একটি কোম্পানির মার্কেটিং টিমে কাজ করেন। আপনার বস বললেন- আজ কিছু কাগজপত্র দূরের প্রতিষ্ঠানে দিয়ে আসো।
আপনি অবশ্যই সেই কাজ করবেন।
মনে করুন- টিম লিডার/ বস আপনাকে বললো, আজ তার বাসায় বাজার করে দিতে হবে, ছোট ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসতে হবে ইত্যাদি।
আপনি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হলে নিশ্চয়ই বলবেন, মার্কেটিং টিমের সদস্য হিসেবে আপনার ব্যক্তিগত বিষয়ে- আমার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই; আপনার ব্যক্তিগত চাহিদা/ প্রয়োজনের আনুগত্য করতে আমি বাধ্য না।
তাই নয় কি?
ঠিক একইভাবে আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন একাধিকবার- আতিউর রসুল, আতিউর রসুল, আতিউর রসুল….! রসুলদের আনুগত্যের সঙ্গে সম্পর্ক- রসুলদের সঙ্গে থাকা রিসালা’র (বার্তার)। সে নির্দেশ সমসাময়িক জীবিত লোকদের জন্য। যা মহাজগতের প্রভুর বার্তা বা মহাগ্রন্থ আল-কিতাবের সঙ্গে জড়িত; মানুষ নবীর ব্যক্তিগত চাহিদা বা পছন্দের সঙ্গে নয়।
যদি একবারও বলা হতো- ‘আতিউন নাবি’ তখন বিষয়টি ভিন্ন হতো। একেবারে ভিন্নরকম। অথচ তা কিন্তু একবারও বলা হয়নি!
৬. রসুল কী কী করতেন?
এ অবস্থায় স্বাভাবিক যে প্রশ্ন আসে তাহলো- এখন আমরা কী করব? আমরা যেহেতু রসুলের আনুগত্য করতে পারছি না- কারণ তিনি আমাদের মাঝে উপস্থিত নেই এবং আমাদের কোনও নির্দেশ দিতে পারছেন না; তাহলে আমাদের করণীয় কি?
সহজ উত্তর- আমরা এবং কিয়ামত পর্যন্ত সব মানুষকে তাঁর অনুসরণ করতে হবে। যেমন, শেষ নবী নিজেই অনুসরণ করেছেন কুর’আন এবং মিল্লাতা ইবরাহিমা হানিফা (ইবরাহিমের একনিষ্ঠ আদর্শ-মত-পথ) সেটাই সুপ্রতিষ্ঠিত দীন- সিরতল মুস্তাকিম।
সংক্ষেপে দেখা যাক, আল-কিতাব অনুযায়ী রসুল কী কী করতেন? আল্লাহ তাঁকে কী কী করার জন্য নির্দেশ
দিয়েছিলেন? আমাদের জন্য কী কী শিক্ষণীয় বিষয় লিপিবদ্ধ করেছেন মহান রব্বুল আলামিন।
- আমরাই পর্যায়ক্রমে তোমার প্রতি এ কুর’আন নাযিল করছি। সুতরাং ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে তোমার প্রভুর নির্দেশ পালন করে যাও। আর তাদের মধ্যে কোনো পাপিষ্ঠ কিংবা অবিশ্বাসীর আনুগত্য করোনা। {৭৬:২৩,২৪}
- তাই, তোমাকে যা ওহি করেছি, তা দৃঢ়ভাবে ধরো; অবশ্যই তুমি সিরাতিম্ মুস্তাকিমের উপর আছো। {৪৩:৪৩}
- কোনো ব্যক্তির জন্যে এটা সংগত নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমাহ ও নবুয়্যত দেবেন, অতপর সে মানুষকে বলবে- তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমার দাস হও। বরং সে বলবে- তোমরা আল্লাহর দাস হও। এর কারণ, তোমরা কিতাব শিক্ষা করতে এবং তা অধ্যয়ন করতে। {৩:৭৯}
- আল্লাহ মুমিনদের প্রতি বড়ই অনুগ্রহ করেছেন, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তাদের কাছে একজন রসুল পাঠিয়েছেন, সে তাদের প্রতি তিলাওয়াত করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদের ইউঝাক্কিহিম করে, তাদের শিক্ষা দান করে আল-কিতাব এবং আল-হিকমাহ; ইতোপূর্বে তারা নিমজ্জিত ছিলো সুস্পষ্ট গোমরাহিতে। {৩:১৬৪}
- হে রসুল, পৌঁছে দাও- যা তোমার প্রতি তোমার রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে; আর যদি তুমি তা না করো- তাহলে তুমি তাঁর বার্তা পৌঁছে দিলে-না। {৫:৬৭}
- …সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া ছাড়া রসুলের উপর আর কোনও দায়িত্ব নেই…{২৪:৫৪}
- … এ কুরআন আমার কাছে অহি করা হয়েছে যেনো আমি তোমাদেরকে এবং যাদের কাছে তা পৌঁছায়- তাদেরকে এর মাধ্যমে সতর্ক করি।…{৬:১৯}
এসব আয়াত এবং এরকম অসংখ্য আয়াতের মাধ্যমে এটাই সুস্পষ্ট যে, মোহাম্মাদ রসুলুল্লাহ কী কী করতেন এবং রসুল হিসেবে তাঁর মিশন কী ছিল।
রসুল সা.এর অনুসরণকারী হিসেবে আমাদের মিশনও তাই হওয়া উচিত নয় কি? আর তা হলো- দৃঢ়ভাবে আল-কিতাব আঁকড়ে ধরা, ব্যক্তি থেকে বিশ্ব পর্যন্ত কুর’আনের বিধান প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা।
মহান আল্লাহ বলেছেন: যে রসুলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল…{৪:৮০}
আমরা যখন শেষ নবীকে রসুল হিসাবে বিশ্বাস করি, তখন তাঁর ওপর অদৃশ্য জগত থেকে নাযিল হওয়া রিসালা বা মহাপ্রভুর ওহিকে সত্য বলেই মেনে নেই এবং সেই কিতাবের হুকুম-বিধানের আনুগত্য করি। অর্থাৎ আমরা রসুল সা.কে বিশ্বাস করার মাধ্যমেই মূলত আল্লাহর আনুগত্য করা শুরু করি। আর তাইতো- যে রসুলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল.. {৪:৮০}।
ঠিক যেমনটি সাহাবিরা করেছিলেন। সাহাবিরা তো ওহি নাযিলের কোনও কিছু দেখেন নি, তাঁরা ফেরেশতা জিবরাইল অথবা রুহুল কুদুসকে দেখেন নি! তাঁরাও বিশ্বাস করেছেন যে- মোহাম্মাদ সা. একজন নবী এবং তাঁর মস্তিষ্কে মহাপ্রভুর ‘ওহি’ নাযিল হয়।
এইসব আয়াতের শিক্ষা হলো- ‘আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্য করা। যা মূলত সর্বাবস্থায় একটি উৎস- মহাগ্রন্থ আল-কিতাব, আল-ফুরকান, আল-কুরআন মেনে চলা।
আসুন, ধরে নেই যে, কুর’আন আমাদেরকে রসুলের আনুগত্য করার কথা না-ব’লে, শুধুমাত্র ‘আল্লাহর আনুগত্য করো’ কথাটি বলছে। আমরা কীভাবে তা করবো?
কারণ, কেউ যদি রসুল সা.কে ‘নবী ও রসুল’ হিসেবে বিশ্বাসই না-করে, কুর’আনের প্রতিও বিশ্বাস করার কোনও সুযোগ থাকে না! বেশ সহজ যুক্তি। তখন স্বয়ং আল্লাহকে পৃথিবীতে নেমে আসতে হবে এবং আমাদের হাতে হাতে সরাসরি কুরআন ধরিয়ে দিতে হবে! অথবা, তাঁর ফেরেশতাদেরকে পৃথিবীতে হেঁটে হেঁটে ঘরে ঘরে আল-কুর’আন বিলি করতে হবে।
খুবই অযৌক্তিক কথা; তাই নয় কি?
তবে এ দাবিটিও তৎকালীন অবিশ্বাসী ও মুনাফিকরা করেছিল। তার জবাব আল্লাহ রব্বুল আলামিন প্রিয় নবীর মাধ্যমে জবাব দিয়েছিলেন।
- কিংবা, তুমি যেমন বলে থাকো, সে মতে আকাশকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে আমাদের উপর ফেলবে, অথবা আল্লাহ এবং ফেরেশতাদের আমাদের সামনে এনে উপস্থিত করাবে।{১৭:৯২}
- মানুষের কাছে যখন আল-হুদা আসে, তখন তাদেরকে ঈমান আনা থেকে বিরত রাখে তাদের এই কথা- আল্লাহ্ কি একজন মানুষকে রসুল বানিয়ে পাঠিয়েছেন?
বলো- পৃথিবীতে যদি ফেরেশতারা স্বচ্ছন্দে/ নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতো, তবে আমরা অবশ্যই আকাশ থেকে তাদের জন্যে কোনও ফেরেশতাকেই রসুল বানিয়ে পাঠাতাম। {১৭:৯৪,৯৫}
এজন্য কুর’আনের আনুগত্য করার মাধ্যমেই আমাদের রসুলের যত বেশি সম্ভব- অনুসরণ (ইত্তিবা) করতে হবে। আর একমাত্র এভাবেই হাজার লক্ষ বছর পরও ‘আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্য’ করার দাবি পূরণ হয়ে যায়।
এখন কেউ যদি জানতে চায়- ব্যক্তি মোহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সা. কি (নবী হিসাবে) ভুলের ঊর্ধ্বে ছিলেন?
কুর’আনের এই দুটি আয়াতেই তার জবাব আছে।
- হে নবী! আল্লাহ্ তোমার জন্যে যা হালাল করেছেন, তুমি কেন তা হারাম করছো? তুমি কি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাও! আল্লাহ্ পরম ক্ষমাশীল দয়াবান। {৬৬:১}
- অতএব, তুমি সবর করো, নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। তোমার গোনাহ্র জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং সকাল-সন্ধ্যায় তোমার রবের প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করো। {৪:৫৫} (অনুবাদ: মুহিউদ্দীন খান)
এই দুটি আয়াতের মাধ্যমেই মুসলিম বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগ ‘শিয়া মুসলমানদের’ ১২ ইমামের নিষ্পাপ হবার অদ্ভুত-অযৌক্তিক ধারণা এবং গোটা ‘শিয়া মাজহাবের’ প্রাসাদ ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়!
আর অবশ্যই প্রিয়নবী মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা. আমাদের কাছে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। কোনও কিছুতেই আমাদের কাছে তাঁর বিরাট সম্মান একবিন্দু নড়বে না। তিনিই শেষ নবী এবং আমাদের কাছে মহান আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ। তাঁকেই উন্নীত করা হয়েছে মাকামে মাহমুদে (প্রশংসিত স্টেশনে)। তাঁর সম্মানহানী করে সাধ্য কার!
শেষ কথা:
সহিহ হাদিস দিয়ে প্রবন্ধ শেষ হবে। হাদিসের কথাগুলো বলেছেন শেষ নবী মোহাম্মদ রসুলুল্লাহ এবং বর্ণনা করেছেন স্বয়ং মহাজগতের প্রভু। তাঁর চেয়ে অধিক সহিহ হাদিস বর্ণনাকারী আর কে আছে?
ঘোষণা করো, আমি রসুলদের মধ্যে নতুন না, আর আমি এও জানি না যে, আমাকে কী করা হবে- এমনকি তোমাদের সঙ্গেও! আমি শুধু তাই মেনে চলি- যা আমাকে ওহি করা হয়; এবং আমি স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র। {৪৬:৯}
আর যেদিন দীর্ঘ এ মিশন শেষ হবে, সেদিন সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-
আমরা দূর করে দেবো তাদের অন্তরের সব ঈর্ষা। তাদের নিচে দিয়ে বহমান থাকবে নদ-নদী-নহর। তারা বলবে- সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের এই জান্নাতের পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহ আমাদের পথ না দেখালে আমরা কখনও পথ পেতাম না। আমাদের কাছে আমাদের প্রভুর রসুলগণ সত্য নিয়ে এসেছিলেন। তখন তাদের ডেকে বলা হবে- তোমাদের আমলের কারণেই তোমাদের এই জান্নাত দেওয়া হয়েছে। {৭:৪৩}