কুর’আন- প্রচলিত অনুবাদ 
বিভিন্ন বিষয়ের আয়াত

২৭. দৃষ্টান্ত বা উদাহরণ ২৮. মুনাফিক ২৯. প্রভুকে বিশ্বাস করো ৩০. সাত স্তরের আকাশ ৩১. মানুষ প্রতিনিধি ৩২. ফেরেশতা ৩৩. মানুষের ইতিহাস ৩৪. নামকরণ

২৭. দৃষ্টান্ত বা উদাহরণ (example)

পবিত্র মহাগ্রন্থে মহান রব্বুল আলামিন অসংখ্য উদাহরণ (মেছাল- مَثَلًۭا ) দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- এই কুর’আনে আমরা মানুষের জন্যে সব ধরনের উদাহরণ / দৃষ্টান্ত দিয়েছি যাতে করে তারা মনোযোগ দেয় {৩৯:২৭}। কোনও কিছু উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া অনেকটা- চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মতো। এরপরও যারা অস্বীকার করবে তারাই ‘ফাসিক’। তাই তিনি বলেছেন- ফাসিকরা এতে বিপথগামী হয় এবং বাকিরা সঠিক পথের দিশা পায়।যেসব শিক্ষক কঠিন বিষয় সহজ উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেন, তাদের শিক্ষার্থীরা বিষয়বস্তু সহজে আয়ত্ত করতে পারে। মহান রব আমাদের শিক্ষক। মহাগ্রন্থ আল-কিতাব আমাদের সব কিছু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

২৮. মুনাফিক (the hypocrites)

মুনাফিক (ٱلْمُنَـٰفِقِين) কে? কিছু বাজে বৈশিষ্ট্যের কারণে সমাজের মানুষ একে অন্যকে মুনাফিক বলে থাকে। অথচ মহান আল্লাহর বক্তব্য অনুযায়ী মুনাফিকের সংজ্ঞা ভিন্ন। তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী মুনাফিক সরাসরি জাহান্নামের অতল গহ্বরে থাকবে। অর্থাৎ, কাফির-মুশরিকের মতোই খারাপ হলো- যারা মুনাফিক। কারা তারা?
আল্লাহ বলছেন মুনাফিক-
১. পৃথিবীতে বিপর্যয় ঘটায়, নিজস্ব পদ্ধতিতে নিয়ম বানায়,
২. তারা ঈমানদারদের সঙ্গে থাকে ও তাদেরকে বোকা বলে,
৩. তারা প্রকাশ্যে ঈমানদার, কিন্তু অন্তরে বিশ্বাস করে না,
৪:১৪২ আয়াত থেকেও দেখা যায়- মুনাফিকরা ঈমানদারদের কার্যক্রমে (সালাতে) অংশ নেয়; শুধুই প্রতারণার জন্য!

২৯. প্রভুকে বিশ্বাস করো (do believe)

মহাজগতের পরাক্রমশালী প্রভু তাঁকে বিশ্বাস করার জন্য যুক্তি দিয়েছেন। তিনি চ্যালেঞ্জও জানিয়েছেন কুর’আনের বিভিন্ন জায়গায়। প্রতিটি মানুষ জন্মগ্রহণের আগে কোথায় ছিল? একমাত্র তিনিই দাবি করছেন- সেই মৃত অবস্থা থেকে তিনি মানুষকে জীবন দিয়েছেন। 
এরপর প্রতিটি মানুষকে তিনিই মৃত্যু দেন। ঠিক একইভাবে তিনি মানুষকে আবারও জীবন দেবেন।
যিনি এই কাজগুলো করেন- তিনিই আমাদের মহান স্রষ্টা। যিনি এই কাজগুলো করার ক্ষমতা রাখেন, তাঁকে আন্তরিকভাবে মেনে নিন। তাঁকে বিশ্বাস করার জন্যই যৌক্তিক আহ্বান জানাচ্ছেন মহান আল্লাহ।

৩০. সাত স্তরের আকাশ (seven skies)

মহাকাশের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। রেড শিফট পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায় যে, মহাকাশের মহা-শূন্যতা আলোর গতির চেয়েও দ্রুত বেগে প্রসারিত হচ্ছে। দৃশ্যমান আকাশের গ্যালাক্সি ক্লাস্টার বিশ্লেষণ করলে দূরবর্তী গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের মাঝে ফাঁক বোঝা যায়। এই ফাঁকা স্থান বা ভয়েডকে প্রথম আকাশে সীমারেখা ধরলে দ্বিতীয় আকাশের কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে অন্য আকাশগুলোও আরও ভালোভাবে দেখা যাবে। বোঝা যায় আকাশগুলো পেঁয়াজ বা ডিমের মতো জড়িয়ে রয়েছে। একটির ভেতর আরেকটি স্তর। এটাই হলো ‘সামাওয়াত ওয়াল আরদ’।  

৩১. মানুষ প্রতিনিধি (The vicegerent)

রব্বুল আলামিন মানুষকে যমিনে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তিনি সর্বময় ক্ষমতার উৎস। তাঁর নির্দেশে সব পরিচালিত হয়। তাঁর প্রতিনিধিরও একেবারে কম হলেও তেমন ক্ষমতা থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা হয় না। এ থেকে বোঝা যায়, পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব সম্পূর্ণ পালন করা যায় না। অর্থাৎ, প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা ব্যবহারের জন্য দ্বিতীয় জীবন দরকার; ২৮ নং আয়াতে দ্বিতীয় জীবনের কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীর জীবন কোনও মানুষই মুখের হুকুমে গাছের পাতাটিও নড়াতে পারে না। এ থেকেই বোঝা যায়- সবাই এক ধরণের পরীক্ষা বা ট্রেনিংয়ের মধ্যে আছে। সময়টুকু পার হলেই পরীক্ষা বা ট্রেনিংয়ের ফলাফলের ভিত্তিতে মূল কাজ শুরু হবে।

৩২. মালাইকা (The Angles)

এই আয়াতে মালাইকাদের কথা এসেছে। মালাইকা সম্পর্কে আল-কুর’আনে অসংখ্য কথা বিভিন্ন প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের প্রতি বিশ্বাস মুসলিমের মৌলিক বিশ্বাসের অন্যতম। তাঁরা মানুষের বন্ধুর মতো মানুষের জন্য কাজ করেন। মানুষের ক্ষমতায়নের শুরুতেই মালাইকাদেরকে মানবজাতি সম্পর্কে অবগত করছেন আল্লাহ-তা’আলা। মালাইকারা বিভিন্নভাবে মানুষকে রক্ষা করে। তাঁরা আল্লাহর আদেশে মানুষের নফসকে জিন-শয়তানের কবল থেকে রক্ষা করে। ফেরেশতারা দেখতে কেমন? তাঁরা কি দিয়ে তৈরি? তাঁরা কি খাবার-দাবার, জীবন-যাপন কেমন? বিশাল এই সৃষ্টিজগতে তাঁদের ভূমিকা কি? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর আছে ফেরেশতা প্রবন্ধে। 

৩৩. মানুষের ইতিহাস (History of Human)

এই আয়াতে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও ইতিহাস একসঙ্গে উঠে এসেছে। পৃথিবীতে মানুষ পাঠানোর আগেই তাদের ‘দাঙ্গা-হাঙ্গামার’ আশঙ্কা করে তারা। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে তারা আগে থেকেই জানলেন? তবে, এটাই শেষ কথা নয়। মহান রবের প্রশংসা ও তসবিহ বর্ণনা করাই যদি চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়- সে কাজ ফেরেশতাদের চেয়ে আর কে ভালো করতে পারবে। রব্বুল আলামিন জানিয়ে দিলেন- “আমি যা জানি তোমরা তা জানো না”। সুস্পষ্ট যে, মানুষ সম্পর্কে ফেরেশতাদের জানা অংশটুকু ছিল পৃথিবীর জীবন পর্যন্ত। কিন্তু পৃথিবীর জীবন মানুষের প্রথম ধাপমাত্র। মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস বলে দেয়- যেতে হবে বহুদূর! হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে!

৩৪. নামকরণ (Naming Process)

এই আয়াতগুলোতে ফেরেশতাদের তুলনায় মানুষের একটি বিষয়ে দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তা হলো নামকরণ বা নাম দেওয়ার পদ্ধতি। আদম আ.কে মহান রব এই বিষয়টি শিখিয়েছিলেন– কীভাবে বিভিন্ন বস্তুর নামকরণ করতে হয়। এভাবে শিক্ষাগ্রহণ এবং তা প্রয়োগ করে নতুন কিছু বানাতে পারেন না ফেরেশতারা। তাঁরা তাই করেন- যা তাদের শেখানো হয় এবং তাদের দায়িত্বও ‘যা শিখেছে- তা পালন করার’ মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু মানবজাতি এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। পূর্বপুরুষদের জ্ঞানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পরের ধাপটি তৈরি করে জীবিত প্রজন্ম। গুহাবাসী থেকে মহাকাশের স্পেস-স্টেশনবাসী ধারাবাহিক জ্ঞানার্জন ও প্রয়োগ-প্রক্রিয়ার অংশ।

৩৫. আল-আরহাম (الْاَرْحَامُ) বা জরায়ু

সব নারী কি ধারণ বা বহন করে? যা বলা হচ্ছে পরের অংশে। আল-আরহাম (الْاَرْحَامُ) বা জরায়ু/the Womb/the Uterus।গর্ভ/জরায়ু যা কমায় ও যা বৃদ্ধি করে (وَمَا تَغِيْضُ الْاَرْحَامُ وَمَا تَزْدَادُ)! কি কমায়? কি বাড়ায়? তা হলো জরায়ুস্থ নানাবিধ হরমোন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইউটেরাস থেকে কিছু হরমোন কমে। যাকে বলা হয় মাসিক বা পিরিয়ড (Period)। নারীদেরই ইউটেরাস আছে; আর মেয়ে/কন্যা/নারীদের জরায়ু থেকে নিয়মিত এই কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। আর যা বাড়ে (وَمَا تَزْدَادُ)! গর্ভাবস্থার একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে যা বাড়ে, তা হলো এসব হরমোন। যেমন, ল্যাকটোজেন, ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন, রিল্যাক্সিন হরমোন ইত্যাদি

৩৬. রুকু (ارْكَعُوْا) ও সিজদা (اسْجُدُوْا)

✅রুকু (ارْكَعُوْا): ধাবিত হওয়া, ঝুঁকে পড়া, সচেতন হৃদয়-মন-মনন দিয়ে তীব্রভাবে আগানো। ক্রিয়াবাচক শব্দ। শারীরিক কর্মসূচি নয়। বরং, আল-কুর’আন অনুযায়ী এই কাজ মানুষের ওজুহা বা সত্ত্বা/অন্তরাত্মার সঙ্গে জড়িত। ✅সিজদা (وَاسْجُدُوْا): ক্রিয়াবাচক শব্দ; আল-কুর’আন অনুযায়ী যার অর্থ বিনয়ের সঙ্গে মেনে নেওয়া, বিনয়ীভাবে মান্যকরা, ঔদ্ধত্য-অহংকার বর্জন করে প্রশান্ত হৃদয়ে মেনে নেওয়া। ✅আ’বুদু (وَاعْبُدُوْا): এটাও ক্রিয়াবাচক শব্দ। আল-কুর’আন অনুযায়ী অর্থ স্বাধীন দাসত্ব করা, স্বাধীন কর্মী হওয়া, স্বাধীনভাবে চিন্তা ও কাজ করার সক্ষমতাই হলো ইবাদত। তারাই আবদ। অর্থাৎ, জিন ও মানুষ সবাই ইবাদ। তারা সবাই আলো-বাতাস-পানি, আরামদায়ক পৃথিবীর পরিবেশ পায়- বেতনভুক্ত স্বাধীন কর্মচারী। ✅খইর (وَافْعَلُوا الْخَيْرَ): আফ্‌আলু আল-খইর বা The Good deeds বা ভালো কাজগুলো করা। নিজের চিন্তা ও কর্মশক্তি দিয়ে (اعْبُدُوْا) ভালো কাজগুলো করলে (افْعَلُوا الْخَيْرَ) একজন ইবাদ তুফলিহুন (تُفْلِحُوْنَ) বা সফল হতে পারবে। তা নাহলে, একজন ইবাদ (জিন ও মানুষ) জাহান্নামে যাবে।