মানুষের ইতিহাস (৪)

মানুষের ইতিহাস (৪)

কুর'আন রিসার্চ সেন্টার- কিউআরসি

৪. একটি বাস্তব পরীক্ষা

  • আর তিনি শিক্ষা দিলেন আদমকে নাম; আর সেগুলো উপস্থাপন করলেন ফেরেশতাদের সামনে; তাদের বললেন- এই জিনিসগুলোর নাম আমাকে বলো যদি তোমরা সত্য বলে থাকো; তারা বললো- আপনি মহান, আমাদের তো কোনো ঈলম নেই আপনি যা শিক্ষা দিয়েছেন- তা ছাড়া; নিশ্চয়ই আপনি মহাজ্ঞানী এবং মহা প্রজ্ঞাময়। {২:৩১,৩২} (প্রচলিত অনুবাদ)

দেখা যাচ্ছে- মহান আল্লাহ মানুষকে কিছু জিনিসের নাম আগেভাগে শিখিয়ে দিলেন। তারপর সেসব বস্তু মানুষ ও ফেরেশতাদের সামনে এনে পরীক্ষা নিলেন। বলো এসবের নাম। ফেরেশতারা আত্মসমর্পণ করলো আর মানুষ (আদম) সেসবের নাম বলে দিলেন।

এটি কি ন্যায্য পরীক্ষা হলো? এতো প্রশ্ন ফাঁস করে একদল শিক্ষার্থীর হাতে আগেভাগে প্রশ্ন ধরিয়ে দেওয়ার মতো হলো! মহান আল্লাহ কীভাবে এ কাজ করতে পারেন।

তিনি অবশ্যই এমন কাজ করবেন না। এখানে সুস্পষ্টভাবে অনুবাদকগণের বোঝার ঘাটতি ও সুস্পষ্ট ভুল অনুবাদ হয়েছে।

আমরা আবারও সঠিক অনুবাদ উপস্থাপন করছি।

  • এবং তিনি শেখালেন মানুষকে (اٰدَمَ) নাম-করণ (আল-আসমা الْاَسْمَآءَ) তিনি উপস্থাপন করলেন ফেরেশতাদের সামনে; বললেন- এসবের নাম বলো (আসমা اَسْمَآءِ) যদি তোমরা সদিকিন (সত্যবাদী) হও। {২:৩১}     [আল-আসমা الْاَسْمَآءَ– নাম-করণ পদ্ধতি ]

এখানে ‘আল-আসমা’ শব্দ দিয়ে নাম-করণের পদ্ধতি আল্লাহপাক মানুষকে শিখিয়ে দিয়েছেন। কীভাবে একটি জিনিসের নাম দেয় মানুষ? চলার পথে সামনে একটি চার পায়ের প্রাণী দেখা গেল- তার নাম দিলাম ‘গরু’। কেন ‘গরু’- কেন সেটি ‘পাখি’ নয়? এর পেছনে কি কোনও যুক্তি নেই? মানুষ যে কোনও বস্তুর স্বভাব-চরিত্র-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে- তার নামকরণ করে। নাম-করণের জন্য যুক্ত হয়- শব্দ, বাক্য, ধ্বণি, চিন্তা ও যুক্তির শক্তি ইত্যাদি। এখনও দেখা যায়- ভিন্ন ভাষায় একই জিনিসের আলাদা নাম হলেও, বৈশিষ্ট্যের বিচারে তার অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই কাছাকাছি হয়।

যেমন আধুনিক যুগে মোবাইল ফোন আমাদের নিত্যসঙ্গী। মোবাইল ফোন‘ একটি ইংরেজি শব্দ। কিন্তু, বাংলা ভাষায় এর নামকরণের চেষ্টা করেছে জাতীয় দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো। তারা বলেছে- এর নাম মুঠোফোন। অর্থাৎ, যেই ফোন বা কথা বলার যন্ত্রটি হাতের মুঠোয় ধরা যায়। বাংলা ভাষার বর্ণমালা দিয়ে এই বস্তুর নামকরণ করা হয়েছে।

এবার চলুন চীনা ভাষার দিকে তাকাই। যাদের কোনও বর্ণমালাই নেই! তাদের আছে শব্দ-মালা। হাজার-লক্ষ শব্দ! (তুঘলকি কাণ্ড!) তারা শব্দ দিয়ে সবকিছুর নাম-করণ করে। তারা মোবাইল ফোনকে কী বলে? তারা বলে শও চিশওমানে হাতের মুঠ বা ৫ আঙ্গুল ও হাতের তালুএবং চিমানে যন্ত্র।

দুই দেশের বিপরীতধর্মী ভাষার মানুষ একই জিনিসের নাম-করণকরছে ঠিক একই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে। অর্থাৎ মুখের ভাষা ভিন্ন হলেও তাদের মন-মগজের কাজ করার ভাষা বা পদ্ধতি একই রকম। ভাষা ভিন্ন হলেও ভিন্ন জাতিভিন্ন সভ্যতার মানুষের মধ্যে হরহামেশা ভালোবাসা-প্রেম-বিয়ে হয়ে আসছে। কারণ, ভালোবাসার ভাষা একই। এ বিষয়টিই মহাজগতের প্রভু সেই আদি সময় শিখিয়ে দিয়েছিলেন বা প্রোগ্রাম করে দিয়েছিলেন আদমকে

ফেরেশতারা তাৎক্ষণিক তা বুঝতে পেরে বলেছিলেন- আপনি পবিত্র আপনি মহান, আমাদের কোনও জ্ঞান নেই আপনি যা শিখিয়েছেন তা ছাড়া; অবশ্যই আপনি আল-আলিম আল-হাকিম।

এরপর মহান রব্বুল আলামিন আদমকে সেসব জিনিসের নাম বলতে বললেন। আদম জিনিসগুলোর নামকরণ করে নাম বলে দিলো। এরপর আল্লাহ নিজের সম্পর্কে বললেন- নিশ্চয়ই আমি জানি সামাওয়াত ওয়াল আরদের অদৃশ্য বিষয়এবং আমি জানি তোমরা যা প্রকাশ করো আর যা গোপন করো। {২:৩৩}

তবে ধারণা করা যায়গোপনকারী মূলত মানুষ। কারণ, কুরআনে অবিশ্বাসীদের গোপন নানা কথাবার্তা আল্লাহ ফাঁস করে দিয়েছেন। আর ফেরেশতাগণ এই গোপনীয়তার বিষয় থেকে মুক্ত বলেই মনে হয়। তাঁরা তাঁদের বিস্ময়ের কথা মুখ ফুটে বলে দিয়েছেন। তাঁরা চিন্তাভাবনা করলেও গোপনীয়তার ঝুঁকিমুক্ত।

এখানে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হলো- ঘটনার এই পর্যন্ত কিন্তু ইবলিস বা জিন-শয়তানের আবির্ভাব ঘটেনি। কিন্তু, মানব চরিত্র বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ফেরেশতারা ফ্যাসাদ ও রক্তপাতের আশঙ্কা করে ফেলেছেন। বিষয়টি একটু বিস্ময়করও বটে। অর্থাৎ, জিন-শয়তান না হলেও মানুষ দুনিয়াতে ফ্যাসাদ (বিপর্যয়/ বিশৃঙ্খলা) ও রক্তপাত (যুদ্ধ/ হত্যাকাণ্ড) ঘটাবে।

পরবর্তীতে জিন-শয়তান এলে আগুনে ঘি ঢালার মতো অপকর্ম আরও বৃদ্ধিতে উসকানি দেবে। এর বাইরে জিন-শয়তান (ইবলিস) কী করে? কিছু পরে আমরা তা দেখবো।

ধারণা করা যায়ফেরেশতাদের সঙ্গে কথোপকথনের সময় জিন‘ সেখানে ছিল। সেও চিন্তাভাবনা করা বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে সব পর্যবেক্ষণ করছিল। কারণ, যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মানুষের (আদমের) শ্রেষ্ঠতম বৈশিষ্ট্যের দিকে আল্লাহ দৃষ্টি দিলেন এবং তাকে মেনে নেওয়ার নির্দেশ (উসজুদু اسْجُدُوْا) দিলেন, তখন বেঁকে বসে জিন-ইবলিস (اِبْلِیْسَ)বোঝা যাচ্ছে- ইবাদত বা স্বাধীনতার শক্তি ইবলিসের ছিল এবং আছে। সে চাইলে অবাধ্যও হতে পারে; এবং সে কাজটিই সে করেছে।

  • যখন আমরা ফেরেশতাদের বলেছিলাম- (উসজুদু আদামা, ফা সাজাদু ইল্লা ইবলিসা) আদমকে মেনে নাও- সবাই মেনে নিলো ইবলিস্ ছাড়া। সে অস্বীকার করলো, অহংকার করলো এবং অস্বীকারকারীদের দলভুক্ত হলো। {২:৩৪}
এখানে আরেকটি বিষয় দেখা যায়। তা হলো সিজদা বা সাজাদা এর বিপরীত কাজ হলো- ‘অহঙ্কারের সঙ্গে অস্বীকার করা’। মানুষ মূলত দুইভাবে অস্বীকার করে; মূর্খতা বা না-জানার কারণে এবং ঔদ্ধত্য বা অহঙ্কার ক’রে। সুস্পষ্টভাবে আল্লাহ বলছেন- অস্বীকার করলো- অহংকার করলো- কাফির হয়ে গেলো। ঠিক এর বিপরীত কাজটিই হলো- সুজুদ / সিজদা / উসজুদু। যার বাংলা অনুবাদ- বিনয়ের সঙ্গে মেনে নেওয়া। এটাই মূলত সিজদার প্রকৃত দাবি। অন্তর থেকে পূর্ণ ইখলাস (আন্তরিকতা)-এর সঙ্গে নিঃশর্তভাবে, প্রশান্ত চিত্তে মেনে নেওয়া।

পরবর্তী পর্বে, মানুষের প্রতি জিন-শয়তান বা ইবলিস ও তার অনুসারীদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমরা জানার চেষ্টা করব। কীভাবে সে মানুষকে বিপথগামী করে- তা বোঝার চেষ্টা করব। জিনজাতির বৈশিষ্ট্য ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানার জন্য এখানে পড়ুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *