যে ব্যক্তি পৃথিবীতে অন্ধ, সে পরকালেও হবে অন্ধ ও ভয়াবহ বিভ্রান্ত
পৃথিবীতে চরম উদাসীনতা ও অবহেলার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করে দেওয়া যায়। কিন্তু এজন্য কিছুদিন পরেই চরম মূল্য দিতে হবে। এ নিয়মটি সাধারণভাবে সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
আজকে যে কৃষক উত্তমরূপে জমিতে চাষাবাদ করবে না, কাল সেই কৃষক ভালো ফলন পাবে না।
আজকে যে শিক্ষার্থী ভালোভাবে লেখাপড়া করবে না, কাল তার ফলাফল ভালো হবে না।
আজকে যে কিছু অর্থ-সম্পদ যোগাড় করবে না, কাল সে বাড়ি বানাতে পারবে না।
এটাই সাধারণ নিয়ম।
অথচ, যখন মানুষের চূড়ান্ত পুরষ্কার এবং অলঙ্ঘনীয় গন্তব্য ‘পরকাল/ আখিরাত/ হাশর/ জান্নাত/ জাহান্নামের’ কথা আসে- তখনই বিরাট একদল মানুষ নিছক উদাসীন হয়ে যায়। এমনকি মুসলিম জাতিও এক্ষেত্রে একই রকম বিবেচনা-হীন উদাসীনতায় ভোগে। তা চরম আশ্চর্য নয় কী?!
মহাগ্রন্থ আল কুর’আন বার বার আমাদেরকে সতর্ক ও সচেতন হতে বলছে। আর এই সতর্কতার প্রথম ধাপ হলো সচেতন হওয়া। উদাসীনতা ও অজ্ঞানতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে সচেতন হওয়ারও ভিত্তি হলো কুর’আন; সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের মানদণ্ড হলো কুর’আন।
যে মানুষ এই সচেতনতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে- আর মাত্র কিছুকাল পরই সে অন্ধ-বোবা-বধির হয়ে হাশরের যমিনে পুনরুত্থিত হবে!
আর যে এখানে হবে অন্ধ, ফলস্বরূপ পরকালেও হবে অন্ধ (اَعْمٰ) ও অধিকতর পথভ্রষ্ট। {১৭:৭২}
আর যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে, ফলস্বরূপ নিশ্চয়ই তার জীবনযাপন (مَعِيشَةً) সংকুচিত হবে এবং আমরা তাদের জড়ো করবো (نَحْشُرُهُۥ) কিয়ামত দিবসে অন্ধ করে (أَعْمَىٰ)। সে বলবে, হে আমার রব কেন আমাকে অন্ধ করে (أَعْمَىٰ) উঠালেন, নিঃসন্দেহে আমি দেখতে পেতাম/ দৃষ্টিক্ষমতা-সম্পন্ন (بَصِيرًا) ছিলাম। {২০:১২৪,১২৫}
আর সেদিন আমরা জাহান্নামকে পেশ করবো অস্বীকারকারীদের (لِّلْكَٰفِرِينَ) সামনে। আমার স্মরণে যাদের চোখগুলোতে ছিল আবরণ এবং তারা শুনতেও (سَمْعًا) সক্ষম ছিল না।।…. {১৮:১০০, ১০১}
….আর আমরা তাদের সমবেত করবো কিয়ামত দিবসে মুখগুলো উপুর করে অন্ধ, বোবা, বধির অবস্থায়; তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম; যখনই তেজ কমবে বাড়িয়ে দেবো উত্তাপ (سَعِیْرًا)। {১৭:৯৭}
অর্থাৎ, পৃথিবীর জীবনে সত্য থেকে বিমুখ থাকলে পরকালীন জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ শুরু হবে অন্ধ হয়ে। অন্ধত্বের শেষ কোথায়- এর পরিণতিই বা কী- তা আমরা জানি না। তবে, যা বোঝা যায় তা হলো- অন্ধভাবে কাউকে রাস্তায় ছেড়ে দিলে তার জন্য সুখকর কিছু থাকে না।
তাই মৌলিক জ্ঞানার্জন খুবই জরুরি। মৌলিক এই জ্ঞানটুকু হলো পৃথিবীর জীবনে যে পরিমাণ জ্ঞান দরকার- সেটুকুই মৌলিক জ্ঞান। যেমন, একজন মানুষকে জানতে হয়, কোনটি ভালো কাজ, আর কোনটি মন্দ কাজ। কোন কাজ করলে সৎভাবে অর্থ উপার্জন করা যায়; তাকে চিনতে হয়- এটা হলো টাকা- আসল টাকা, নকল টাকা নয়। তাকে টাকা গণনা শিখতে হয়। এভাবে বিয়ে করা, সন্তান জন্মদান, তাদের বৃদ্ধি, পরিবার গঠন করা, সামাজিক দায়িত্ব পালন করা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে মানুষের পৃথিবীর জীবন সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। আখিরাতের জীবনের ধারাবাহিকতাও তেমনভাবে এগিয়ে যাবে সামনে। কিন্তু তার জন্য মৌলিক তথ্যটুকু জেনে নিতে হবে।
আর সেজন্যে মহান রব্বুল আলামিন মানুষকে খুব বেশি কিছু দাবি করেন নি। তিনি স্রেফ বলেছেন- তাঁকে বিশ্বাস করতে এবং আখিরাত বা পরকাল নামে যে অংশটুকু আছে তাতে বিশ্বাস করতে। আর এই বিশ্বাসের ওপর অটল বা দৃঢ় থাকতে। এর ওপর ভিত্তি করেই পৃথিবীতে যাবতীয় ভাল কাজ করতে।
খুব কঠিন মনে হয় কি? অবশ্যই না!
মহান সৃষ্টিকর্তা এবং তাঁর তৈরি- মানুষের জন্য ‘ভবিষ্যত সময়’ বা ‘আখিরাত’ কেউ যদি অবিশ্বাস করে- তাতে তার পৃথিবীর কাজে তেমন কোনও পার্থক্য হয় না। একজন বিশ্বাসী মানুষ যেভাবে নিজের দুনিয়ার জীবনে কল্যাণ অর্জনের জন্য চেষ্টা করে; সেভাবেই একজন অবিশ্বাসী মানুষ নিজের ও তার পরিবারের জন্য চেষ্টা করে থাকে। এটাই সাধারণ দৃশ্য। অথচ অবিশ্বাসী ও বে-খেয়াল মানুষটি যদি ‘বিশ্বাসের শক্তিতে’ বলীয়ান হতো, তাহলে স্রষ্টার ইচ্ছায় পরকালীন জগতে তার সামনে চলার পথ খুলে যেত। সে কথাই বার বার বলছেন মহান রব্বুল আলামিন। তিনি পৃথিবীতে মানুষের জন্য কঠিন কোনও কাজ দিয়ে পাঠান নি। বরং “বিশ্বাস করো ও ভালো কাজ করো- তাহলেই তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাত- যা তলদেশে ঝর্নাধারা উৎসারিত”- এমন কথাই বার বার বলছেন তিনি।
তাই আমাদের শুধু সচেতন হতে হবে। একজন বিশ্বাসী মানুষ তাঁর বিশ্বাসের তাড়নায় আরও বেশি- আরও কিছু জানার চেষ্টা করবে। তারা আখিরাত সম্পর্কে বোঝার চেষ্টা করবে এই দুনিয়ার উপায় উপকরণকে ব্যবহার করেই। একজন অবিশ্বাসী কখনওই তা করবে না। আর যে নিজেকে বিশ্বাসী (মু’মিন) বলে দাবি করে, কিন্তু কথা ও কাজে অবিশ্বাসীর মতো আচরণ করে- দিন শেষে সে অবিশ্বাসী মানুষ বা কাফির বলেই চিহ্নিত হবে। নামে নয়- কাজে পরিচয়।
তাদের সম্পর্কেই আল্লাহ সতর্ক করে বলছেন-
বরং বিলুপ্ত হয়েছে তাদের পরকালের জ্ঞান; বরং তারা সে বিষয়ে সন্দেহ করে; বরং তারা সে বিষয়ে অন্ধ (عَمُونَ)। {২৭:৬৬}
তারা বধির,অন্ধ; তাই তারা ফিরে আসবে না। {২:১৮}
…..এবং যারা বিশ্বাস করে না তাদের কানগুলো বধিরতার মধ্যে ও তাদের ওপর অন্ধত্ব; ঐসব লোকদের ডাকা হচ্ছে যেন বহুদূরের স্থান থকে!. {৪১:৪৪}
তাই এই অন্ধত্ব ঘোঁচাতে জানার চেষ্টা করতে হবে- জানতে হবে এবং সাধ্যানুযায়ী মানতে হবে। এটাই নির্দেশনা। আপনার যা সাধ্যে কুলায়- তাই করুন; এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু মহাসত্য জানা থেকে বিমুখ হবেন না। যত জানবেন, ততই আপনার মন-মনন উন্নত হবে; ততই আপনার (রব ও আখিরাতের প্রতি) ঈমান/ বিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে। এটাই মৌলিক কাজ। এই ওয়েবসাইটের মৌলিক কাজ- নিজেরা জানা, মহাসত্য প্রকাশ করা ও সবাইকে জানানো।
যে ব্যক্তি জানে তোমার প্রভুর নিকট থেকে তোমার কাছে মহাসত্য নাযিল হয়েছে সে কি ঐ ব্যক্তির মতো অন্ধ (أَعْمَىٰٓۚ)! নিশ্চয়ই উপদেশ নেয় বোধশক্তি সম্পন্নরা (اُولُوا الْاَلْبَابِۙ)। {১৩:১৯}
তাদেরকে যখন রবের নিদর্শন (بِـَٔايَٰتِ) দিয়ে উপদেশ দেওয়া হয়, তখন তারা অন্ধ ও বধির হয়ে পড়ে থাকে না। {২৫:৭৩}
তিনিই তাঁর আবদের ওপর অবতীর্ণ করেন সুস্পষ্ট নিদর্শনগুলো (اٰیٰتٍۭ) তোমাদের অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনার জন্য এবং অবশ্যই আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি পরম করুণাময় পরম দয়ালু। {৫৭:৯}
আর তুমি অন্ধদের পথভ্রষ্টতা থেকে পথ দেখাতে পারবে না; তুমি শোনাতে পারো শুধুমাত্র যে বিশ্বাস করে আমাদের নিদর্শনসমূহ (بِـَٔايَٰتِنَا), অতঃপর তারাই আত্মসমর্পণকারী বা মুসলিম (مُّسْلِمُونَ)। {২৭:৮১}
আলিফ লাম রা; আমরা তোমার প্রতি ‘কিতাব’ নাযিল করেছি, যাতে করে তুমি মানুষকে বের করে আনো অন্ধকার থেকে আলোর দিকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে মহাপরাক্রমশালী সপ্রশংসিত পথে। {১৪:১}
মহান রব উদাহরণ দিয়ে বলছেন:
আর যারা অস্বীকারকারী তাদের দৃষ্টান্ত (مَثَلُ) এমন কেউ জোরে বলছে সেটা তারা শোনে না– শুধুমাত্র ডাকাডাকি ও শব্দ ছাড়া; বধির, বোবা, অন্ধ; কাজেই তারা বোঝে না। {২:১৭১}
আর যারা আমাদের নিদর্শনগুলো (بِـَٔايَٰتِنَا) দিয়ে মিথ্যা বলে- অন্ধকারে থাকা বধির ও বোবা;.. {৬:৩৯}
গহীন অন্ধকারের মধ্যে বধির ও বোবার দুর্ভোগ কী স্বপ্নেও ভাবা যায়? এই বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হলো সত্য সম্পর্কে জানা। যারা আল্লাহর হুদা বা পথনির্দেশ অনুসন্ধান করে, তারাই হিদায়াত বা গাইডলাইন পায় এবং আল্লাহ তাদের হিদায়াত দেখা ও শোনার সুযোগ দেন।…
নিশ্চয়ই তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে সুস্পষ্ট প্রমাণ (بَصَاۤىِٕرُ) সুতরাং যে দেখে, তা নিজের জন্যই; আর অন্ধ থাকলে তার বিরুদ্ধে যাবে; এবং আমি তোমাদের রক্ষাকারী নই। {৬:১০৪} আয়াতের (بصائِر) শব্দটি (بصيرة) এর বহুবচন। এর অর্থ বুদ্ধি ও জ্ঞান।
এটা দিয়ে আল্লাহ পথ দেখান যে অনুসরণ করে তাঁর সন্তুষ্টি শান্তির পথে এবং তাঁর অনুমতিক্রমে তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করেন আলোর দিকে এবং তাদের পরিচালিত করেন সিরাতল মুস্তাকিমের দিকে। {৫:১৬}
নিঃসন্দেহে এই অন্ধত্ব চর্ম-চোখের নয়; বরং মনের চোখের।
আল্লাহ বিশ্বাসীদের অভিভাবক- তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আনেন; আর যারা অস্বীকার করেছে তাগুত (ٱلطَّٰغُوتُ) তাদের পৃষ্ঠপোষক, সে তাদেরকে আলো থেতে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। {২:২৫৭}