মহান আল্লাহর কথা বলার একটি পদ্ধতি
কুর’আন রিসার্চ সেন্টার- কিউআরসি
ভূমিকা
মহাগ্রন্থ আল-কুর’আন থেকে আমরা জানতে পারি, পৃথিবী ও মহাবিশ্ব পরিচালনায় আল্লাহ কিছু নিয়ম বা পদ্ধতি তৈরি করেছেন। তিনি যখন জান্নাত বা জাহান্নামের কথা বলেছেন, তখনও কিছু পদ্ধতির কথা জানিয়ে দিয়েছেন। এমনকি, মহান আল্লাহ যখন জিন ও মানুষের ব্যাপারে কথা বলেছেন- তখনও তিনি কিছু নিয়ম-কানুন, বিধি-বিধানের বা পদ্ধতির কথা বলেছেন। সর্বোপরি আল্লাহ বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি তাঁর অসীম ক্ষমতাবলে যে কোনও কিছু পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখেন। এর এখতিয়ার সম্পূর্ণ আল্লাহ রব্বুল আলামিনের।
যেমন, তিনি বলেছেন- নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করা ক্ষমা করবেন না। এটা ছাড়া অন্য সব যাকে ইচ্ছা মাফ করবেন; এবং যে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করল, সে এক মহা অপবাদ আরোপ করল। {৪:৪৮}
তার মানে কি? তিনি শিরকের অপরাধ ক্ষমা করতে পারেন না? এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন মানুষের মনে উদয় হয়।
বিষয়টি হলো- তিনি পারেন কি পারেন না- তা নয়। বিষয়টি হলো- তিনি ইচ্ছা করেছেন বা নিয়ম তৈরি ও ঘোষণা করেছেন যে, শিরকের অপরাধ ক্ষমা করবেন না।
তাই, অসংখ্য ভালো কাজ থাকা স্বত্বেও শিরকের অপরাধ করে ফেললে ওই বাঁধা নিয়মে পরে যেতে হবে এবং নির্ধারিত পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ভুল করে শিরকের অপরাধ করেও কিছু মানুষ আশা করে যে, আল্লাহপাক নিশ্চয়ই তা ক্ষমা করতে পারেন এবং তা করবেন! যেখানে তিনি তাঁর সব নবী ও রসুলকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে-
- তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদেরকে এই ওহিই করা হয়েছিল যে- তুমি যদি আল্লাহর সঙ্গে শিরক করো, তোমার সব আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। {৩৯:৬৫}
নবী রসুলগণ যদি এই ভুল করতেন, তাঁরা তো জেনে শুনে করতে না; নিশ্চয়ই মনের ভুলেই করতেন। আর মহান এসব মানুষকেই এভাবে ফয়সালা জানিয়ে দিয়েছেন রব্বুল আলামিন। তাহলে, আপনি ও আমি ভুল করলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে?
এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় আল্লাহর একটি বিশেষ পদ্ধতি বা সুন্নাতুল্লাহ নিয়ে। গোটা কিতাবজুড়ে নানা বিষয়ে আল্লাহর সুন্নাত আমরা দেখতে পাই। আরবি শব্দ সুন্নাহ বা সুন্নাত (سُنَّةَ) অর্থ- কাজ করার পথ বা পদ্ধতি (way of doing things or methodology)।
তিনি মানুষকে যেসব সুন্নাত জানাতে চেয়েছেন, সেসব সুন্নাত লিখে দিয়েছেন কিতাবে। তার অনেকগুলোর মধ্যে একটি হলো- কথা বলার পদ্ধতি। অনেকগুলো স্টাইল বা ধরণে আল্লাহ কথা বলেছেন; একটু অধ্যয়ন করলেই আমরা তা বুঝতে পারি।
মহান আল্লাহর বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি বা সুন্নত সম্পর্কে জানলে মানুষের চিন্তা ও কাজে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। মানুষ বিভিন্ন কাজে রব্বুল আলামিনের সুন্নত অনুসরণ করার চেষ্টা করবে। ঠিক যেভাবে অনুসরণ করেছিলেন জগতের সব নবী-রসুল। কারণ, সব নবী রসুলের ক্ষেত্রে আল্লাহর সুন্নত একই রকম ছিল।
- আল্লাহ্ নবীর জন্যে যা ফরয করেছেন তা বাস্তবায়নে তার কোনো বাধা নেই; অতীত নবীদের ক্ষেত্রেও এটাই ছিলো আল্লাহর সুন্নত; আর আল্লাহর নির্দেশ অবশ্যই একটি সুনিশ্চিত ফায়সালা। {৩৩:৩৮}
- …এটাই আল্লাহর সুন্নত (سُنَّةَ), প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। তুমি আল্লাহর সুন্নতে কোনো পরিবর্তন পাবে না। {৪৮:২৩}
অর্থাৎ, বিভিন্ন বিষয়ে মহান আল্লাহর সুন্নত বা কর্মপদ্ধতি একটি বিরাট হিকমা’ বা প্রজ্ঞাময় জ্ঞানগর্ভ বিষয়। মহাজগতের প্রভু তা কুর’আনে লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন- মানুষ যেন অনুসন্ধান করে প্রজ্ঞা লাভ করতে পারে।
মহান রবের বাছাইকৃত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ অর্থাৎ, নবী-রসুলগণ এই প্রজ্ঞা লাভ করেছিলেন। তাঁরা আল্লাহর দরবারে সম্মানিত হয়েছিলেন। যে মানুষ কিছুটা প্রজ্ঞা লাভ করে- নিঃসন্দেহে তার অন্তর্দৃষ্টি ও অনুধাবন ক্ষমতা বেড়ে যায় বহুগুণ। কুর’আনে অসংখ্যবার আল্লাহ জানিয়েছেন- তিনি এই কুর’আনে নাযিল করেছেন ‘হিকমা’ বা প্রজ্ঞা (প্রজ্ঞাময় জ্ঞান)। বেশ কিছু স্থানে বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে জানিয়েছেন- এগুলো হলো প্রজ্ঞা- যা মহান রব তাঁর বান্দাহদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন।
যাই হোক, রব্বুল আলামিন বিভিন্ন পরিস্থিতি ও প্রসঙ্গে তাঁর কর্মপদ্ধতি ও সুন্নত সম্পর্কে বলেছেন। এসব সুন্নত অপরিবর্তনীয় বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা প্রভুর স্টাইল।
মহান আল্লাহ এবং তাঁর বাণী বুঝতে হলে, তাঁর কথা বলার পদ্ধতিগুলো আমাদের জানতে হবে। তিনি কোন কোন পদ্ধতিতে বা স্টাইলে মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন- তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
যেমন, আমরা জানি জগতের বিভিন্ন মানুষের ভাব প্রকাশের নিজস্ব পদ্ধতি আছে। সব কবি- ছন্দময়, আকর্ষণীয়, নিগুঢ় অর্থময় বাক্য দিয়ে ভাব প্রকাশ করে। কাজী নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, শেক্সপিয়ার… প্রত্যেকের সাহিত্যের নিজস্ব ঢং বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিভিন্ন ধরণের প্রাণীর ভাব প্রকাশের পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য থাকলেও সম-জাতের মধ্যে তাদের পদ্ধতি একই রকম। এমনকি প্রাণহীন বস্তু, যেমন- গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, কৃষ্ণগহ্বর… সবারই নিজস্ব কর্মপদ্ধতি বা সুন্নত রয়েছে।
এভাবে যত উদাহরণই দেওয়া হোক না কেন- সবার বা সবকিছুর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তৈরি ও নির্ধারণ করে দিয়েছেন মহান আল্লাহ।
মানুষ যেহেতু কথা বলে ভাব প্রকাশ করে থাকে, তাই মানুষকে কথা বলার জন্য বিভিন্ন জিনিসের নামকরণ এবং বর্ণ, শব্দ, বাক্য ও ভাব তৈরি করা শিখিয়ে দিয়েছেন রব্বুল আলামিন। এ এমন একটি জ্ঞান, যার কারণে আদম পেয়েছিল খলিফার মর্যাদা এবং চিন্তা-ভাবনা-জ্ঞান-গবেষণার মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি।
মহান রব্বুল আলামিন সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কথা বলার পদ্ধতি বাছাই করেছেন। তিনি মানুষকে তাঁর বক্তব্য বা কথা লিখে দিয়েছেন। যেমন দিয়েছিলেন, সব রসুলদের।
রব্বুল আলামিন, তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির খোঁজ খবর রাখেন, প্রয়োজনে তাদেরকেও হুকুম আহকাম দেন। কিন্তু তাদের কাছে আমরা কোনো লিখিত কিতাব পাই না। তবে মানুষের সঙ্গে তিনি ‘ভাষাগত যোগাযোগ’ স্থাপন করেছেন।
কিন্তু কেন? তিনি প্রতিটি মানুষের অন্তরে নির্ধারিত হুকুম দিলেই হয়ে যেতো! কোনও মানুষ তখন হুকুমের বাইরে যেতে পারতো না। তিনি তা করেন নি। তিনি ভাষার মাধ্যমে বা কথার মাধ্যমে মানবজাতির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু, তিনি মানুষকে বাধ্য করেন নি।
এজন্য, যেসব মানুষ স্বেচ্ছায় মহান আল্লাহকে তার রব, তার জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে; সেসব মানুষের জন্য অত্যন্ত জরুরি বিষয় হলো: মহান রবের কথা বলার পদ্ধতি (সুন্নত) সম্পর্কে জানা।
এর একটিই উদ্দেশ্য, তা হলো- মহান প্রতিপালকের কথা আরও ভালোভাবে বোঝা বা অনুধাবন করা। তাঁর কথা বলার স্টাইল বা ধরণ, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা করার ধরণ কুর’আনেই লিপিবদ্ধ আছে।
খেয়াল রাখতে হবে যে, আমরা যেন মানুষের কথা বলা বা ভাব প্রকাশের পদ্ধতিকে ‘আল্লাহর কথার পদ্ধতির’ ওপর চাপিয়ে না দেই। আল্লাহপাক ঠিক যেভাবে বলেছেন- আমাদেরকে সেভাবেই বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কারণ, সেই সামান্য যোগ্যতা তিনি মানুষকে দিয়েছেন।
১.
প্রথমে আমরা ছোট একটি সুরা দেখব। কারণ, ছোট সুরাগুলোতে সাধারণত একটি বিষয়-কেন্দ্রিক বক্তব্য দিয়েছেন আল্লাহ।
সুরার শুরুতে আল্লাহ বলছেন- তিনি কিছু একটা পাঠিয়েছেন সৌভাগ্যের রাতে। তিনি যা পাঠিয়েছেন তার গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। ঠিক ৩টি আয়াত পরেই জানিয়ে দিয়েছেন- তিনি পাঠিয়েছিলেন ‘মালাইকা’; তাদের সঙ্গে ছিল কার্যাদেশ সম্বলিত ‘রুহ’।
অর্থাৎ, আগে গুণ-বৈশিষ্ট্য-গুরুত্ব বর্ণনা করে, সেই ধারাবাহিকতায় জিনিসটির নাম বলে দিয়েছেন। (পড়ুন লাইলাতুল কদর)
এভাবে তিনি আর কোথাও বলেছেন কি?
অনেক জায়গায় বলেছেন। আমারা আরও একটি উদাহরণ দেখি।
২.
বিখ্যাত সুরা ইসরা (বনি ইসরাইল বা রাতের ভ্রমণ)-এর প্রথম ৩টি আয়াত দেখুন।
পবিত্র ও মহীয়ান তিনি যিনি তাঁর বান্দাহকে রাতের বেলা ভ্রমণ করিয়েছেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চারপাশকে আমি কল্যাণময় করেছি। তাকে আমার নিদর্শনাবলী দেখানোর জন্য, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
আর আমরা মুসাকে দিয়েছিলাম কিতাব; সেটাকে বানিয়েছিলাম বনি ইসরাইলদের জন্য হুদা- আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে কর্মবিধায়ক গ্রহণ করো না।
(তোমরা তো) তাদের সন্তান! যাদেরকে আমি নুহের সঙ্গে নৌকায় চড়িয়েছিলাম, সে ছিল এক কৃতজ্ঞ দাস। {১৭:১-৩}
খেয়াল করলেই বোঝা যায়- এই সুরা শুরু হয়েছে একটি বিষয়ে এবং সেই বিষয়েই কথা বলা শুরু করেছেন আল্লাহ। ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গ বা খাপছাড়া কোনও কথা বলেন নি রব্বুল আলামিন।
কথাগুলো হলো- ইসরাইলের বংশধরদের একজনকে রাতের আঁধারে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তাকে নানা রকম বিস্ময়কর নিদর্শন দেখানো হয়েছিল। প্রশ্ন হলো- কে তিনি?
বাক্যের গঠন ও বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন আল্লাহ। তিনি পরের বাক্য শুরু করেছেন এবং / আর ( وَ ওয়া ) দিয়ে। যে মানুষটিকে তিনি এই সম্মান দিয়েছিলেন- সেই মুসাকেই দিয়েছিলেন কিতাব। সেই কিতাবে ছিল গাইডলাইন বা পথের নির্দেশ। কী সেই নির্দেশ? তা হলো- এক আল্লাহ ছাড়া তারা যেন আর কোনও কর্মবিধায়ক ( وَكِيلًاওয়াকিলান) গ্রহণ না করে। এই ‘তারা’ কারা? ‘তারা’ হলো তাদের বংশধর যারা নুহের সঙ্গে নৌকায় চড়েছিল।
প্রতিটি বিষয় একটির সঙ্গে আরেকটি মালার মতো জড়িত। কোনও ফাঁক রাখেননি আল্লাহ। সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন বিস্তারিত- যা মানুষের জানা প্রয়োজন।
কিন্তু, প্রচলিত অনুবাদগুলোতে দেখা যায়, অনুবাদের ফাঁকে প্রথম উদাহরণে ‘আংযালনা হু’ বা ‘এটা নাযিল’ এর জায়গায় ‘কুর’আন’ লিখে দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় উদাহরণে তাঁর বান্দাহকে রাতের বেলা..” এর জায়গায় ‘নবী মোহাম্মদ রসুলাল্লাহর’ নাম ব্র্যাকেট-বন্দী করে অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে। অর্থাৎ, আল্লাহ যা বলেছেন, তা গোপন করা হয়েছে এবং তিনি যা বলেন নি, তা যুক্ত করে নতুন ধারণা তৈরি করা হয়েছে। পাঠকগণ নিশ্চয়ই তা দেখতে ও বুঝতে পারছেন।
যাই হোক, আমরা বলছিলাম আল্লাহর কথা বলার স্টাইল বা বৈশিষ্ট্য নিয়ে।
এখানে যে পদ্ধতি, সুন্নত বা স্টাইল আমরা জানতে পারলাম, তা হলো- তিনি যদি প্রথমে কোনও বিষয়ের নাম না-বলেন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই না-বলা সেই বিষয়ের/ ব্যক্তির /বস্তুর নাম উল্লেখ করে দেন। তাই আমাদের নিজেদের মতো করে কোনও নাম বসানো বা ধারণা করা দরকার নেই।
আরও চমৎকার একটি উদাহরণ দেখি।
৩.
সুরা বাকারা ১৮৩-১৮৭ নং আয়াতে মহান আল্লাহ সিয়াম-সাধনা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি অতীতের লোকদের মতো আমাদের জন্যও সিয়ামের বিধান দিয়েছেন। এই সিয়ামের জন্য তিনি কুর’আন নাযিল করেছেন এবং তিনি কুর’আনের বিভিন্ন গুণাবলী বর্ণনা করেছেন। ১৮৩, ১৮৪, ১৮৫, ১৮৬ পর্যন্ত তিনি একই বিষয়ে ধারাবাহিক কথা বলে গেছেন- কিন্তু একবারও বলেন নি, ‘সিয়াম’ কাকে বলে! তাই, ১৮৭ নং আয়াতে এসে সিয়ামের পদ্ধতি সুস্পষ্টভাবে বলে দিলেন এবং সিয়ামের সংজ্ঞাও দিয়ে দিলেন। বড় এই আয়াতটির সংশ্লিষ্ট অংশ তুলে ধরা হলো। যথারীতি লাল রং দিয়ে প্রচলিত ভুল অনুবাদ ও জোর করে ঢুকানো শব্দ চিহ্নিত করা হলো।
আল্লাহ বলছেন- স্ত্রীর কাছে গিয়ে সুসংবাদ দাও। কুর’আনে লিখে দেওয়া বিষয় নিয়ে কথাবার্তা আলাপ আলোচনা করো। তা ছাড়া, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনও একটি বিষয়ে সাদা ও কালো আলাদা হয়ে ফজরের মতো সুস্পষ্ট না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত চিন্তা-ভাবনা-গবেষণা করো। কিন্তু, এই কাজের সময় রাত পর্যন্ত। কারণ, রাতের বেলা ঘরে ফিরে স্ত্রীকে বিভিন্ন বিষয়ের সু-সংবাদ দিতে বলা হয়েছে (যা কুর’আন থেকে জানা গেছে)। তবে, গবেষণা চলতে থাকা অবস্থায় লোকজনের কাছে ছুটে গিয়ে সুসংবাদ দেওয়া– কথাবার্তা বলা নিষেধও করা হয়েছে।
এভাবেই “পূর্ণ করো সিয়াম”।
মহান আল্লাহ কুর’আন নিয়ে ঘরে ও বাইরে যেসব গবেষণা-কাজ করতে বলেছেন— তাকেই বলেছেন “সিয়াম ٱلصِّيَامَ”।
প্রচলিত অনুবাদগুলোতে দেখা যায়, এই একটি আয়াতেই ٱلرَّفَثُ মানে স্ত্রীর সঙ্গে যৌনকর্ম করা, بَٰشِرُوهُنَّ মানে (২বার) স্ত্রীর সঙ্গে যৌনকর্ম করা; وَٱشْرَبُوا۟ كُلُوا۟ মানে আক্ষরিক অর্থে খাওয়া ও পান করা, eat and drink অনুবাদ করা হয়েছে। পাশাপাশি এই আয়াতের ব্যাখ্যায় দিন থেকে রাত না খেয়ে থাকা, গভীর রাতে সেহেরি খাওয়া, সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে ইফতারি খাওয়া– ইত্যাদি নানা ধারণা ও ব্যাখ্যা ঢুকিয়ে নতুন একটি বিধান তৈরি করা হয়েছে। অথচ ঠিক পরের আয়াতেই (১৮৮) আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছেন- তোমরা একে অপরের সম্পদ খেয়ো না كُلُوٓا۟। একই كُلُوٓا۟ কুলু শব্দ-–এখানে যার আক্ষরিক অর্থ ‘খাওয়া’ নয়। মানুষ অন্যের সম্পদ চিবিয়ে খায় না। তা ছাড়া, চিবিয়ে খাওয়ার কোনও বিষয় থাকলে তার আগে নানা খাদ্যবস্তুর কথা উল্লেখ করেন আল্লাহ। এখানে আগের আয়াতগুলোতে বলেছেন ‘নাযিল হওয়া মহাবিস্ময়কর কুর’আনের কথা’। সবসময় প্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তুই বলে দেবে- كُلُوٓا۟ মানে মুখে নিয়ে খাওয়া? নাকি আত্মস্থ করা, অনুধাবন করা, consume and absorb..। ধারাবাহিক এসব আয়াতে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে ‘সিয়াম/ সাওম’ এবং তার পদ্ধতি ও কুর’আনের বিষয়বস্তু নিয়ে। যার সঙ্গে আক্ষরিক খাওয়া ও পান করা, দিন, রাত, সূর্যোদয়, সূর্যান্ত ইত্যাদির সম্পর্ক নেই, তেমন শব্দগুলোও বলা হয়নি।
এটাই হলো আল্লাহর কথা বলার একটি স্টাইল। তিনি ১ ও ২ নং উদাহরণের মতো ৩ নং উদাহরণেও জানিয়ে দিলেন- এই ধরণের কর্মসূচি হলো আস-সিয়াম ٱلصِّيَام বা সাওম। বাংলা ভাষায় ফারসি (Persian) শব্দ দিয়ে যাকে বলা হয় রোজা। বিশুদ্ধ বাংলায় উপবাস।
সিয়াম-সংক্রান্ত এসব আয়াতে আমরা আবারও আল্লাহ রব্বুল আলামিনের একই ধরনের কথা বলার ধরণ (সুন্নত) দেখতে পেলাম।
আরও কি আছে? চলুন দেখি।
৪.
সুরা হুদে দেখা যায়:
আর আমরা মাদায়ানে পাঠিয়েছিলাম তাদেরই ভাই শুয়াইবকে। সে তাদের বলেছিল: ‘‘হে আমার কওম! তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ্ নেই। তোমরা মাপে ও ওজনে কম করোনা। আমি তো তোমাদের সচ্ছল দেখছি। আমি তোমাদের উপর আশংকা করছি এক সর্বগ্রাসী দিনের আযাবের।
হে আমার কওম! ইনসাফের সাথে পূর্ণ করে দাও মাপ ও ওজন। মানুষকে তাদের প্রাপ্য সামগ্রী কম দিও না এবং দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।
আল্লাহর অনুমোদিত বাকিটাই (লাভটাই) তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তুমি মু’মিন হও। আমি তোমাদের উপর পাহারাদার নই। {১১:৮৪-৮৬}
এখানে আল্লাহর নবী শুয়াইব মাদায়েনের অধিবাসীদেরকে আল্লাহর সামাজিক হুকুম-নিয়ম-বিধান জানিয়ে দিচ্ছিলেন। জবাবে, তারা বলেছিল-
হে শুয়াইব! তোমার ‘সালাত’ কি তোমাকে এই নির্দেশ দেয় যে, আমাদের পূর্বপুরুষ যার ইবাদত করতো- আমরা তা ছেড়ে দেই? অথবা, আমাদের ধন-সম্পদ দিয়ে যা ইচ্ছা তাই না-করি? নিশ্চয়ই তুমি ধৈর্যশীল সৎ মানুষ। {১১:৮৭}
এই কয়েকটি আয়াতে দেখা যাচ্ছে- নবী ও রসুল শোয়াইব তাঁর জাতির লোকদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে হুকুম-নিয়ম-রীতি জানাচ্ছেন। আর সেসব নিয়ম-কানুন-হুকুম-গুলোকে তাঁর জাতির লোকজন একশব্দে ‘সালাত’ বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে। আর সেই ‘সালাত’ শব্দটি আল্লাহপাক কুর’আনে উল্লেখ করে জানিয়ে দিলেন।
অর্থাৎ, আল্লাহ তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে জানিয়ে দিলেন ‘সালাত’ কি?
যখন আমরা বনি ইসরাঈল থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম যে- তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করবে, আত্মীয়স্বজন, এতিম ও মিসকিন ও মানুষের সঙ্গে ভালো কথা বলবে এবং সালাত কায়েম করবে পরিশুদ্ধি অর্জন করবে (আকিমুস সালাত ওয়া আতুয যাকাত); তারপর অল্প কয়েকজন ছাড়া তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছো। {২:৮৩}
এখানেও দেখা যাচ্ছে- আল্লাহ কিছু সংখ্যক নির্দেশাবলী উল্লেখ করে তারপর বলছেন- আকিমুস সালাত ওয়া আতুয যাকাত (সালাত কায়েম করবে যাকাত অর্জন করবে)। আল্লাহপাকের কথা বলার ধরণ অনুযায়ী- ওই সব সুষ্ঠু পারিবারিক-সামাজিক নির্দেশাবলীই হলো “সালাত”; আর তা বাস্তবায়ন করাই হলো “আকিমুস সালাত”; এবং তার ফলাফল হলো- পরিশুদ্ধতা বা “যাকাত”। যেই সালাত অর্থ আল্লাহর হুকুম-আহকাম, সেই সালাত প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কোনও পদ্ধতিতে বিশ্ব, দেশ ও সমাজে পরিশুদ্ধতা অর্জন করা যায় কি? পৃথিবীতে যেসব রাষ্ট্রে এই ধরনের সামাজিক আইনকানুন সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত আছে, সেসব রাষ্ট্রে যাবার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতেও দ্বিধা করে না লোকজন। ভেবে দেখুন। যে সমাজে আইনের শাসন বজায় আছে, কাজ-কর্ম-ব্যবসা-বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিবেশ আছে, মান-সম্মানের গ্যারান্টি আছে, ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা আছে—সেসব দেশের নাম কে না জানে!
সুরা মুযাম্মিলের ২০ নং আয়াতাংশে আল্লাহ বলছেন-
- …অতএব কুরআন থেকে পাঠ করো- যা সহজ আর সালাত প্রতিষ্ঠা করো ও পরিশুদ্ধতা অর্জন করো (আতুয্ যাকাত)।
মানবজাতিকে কুর’আনের কথা জানানো হলো- সালাত কায়েম ও শুদ্ধতা অর্জনের পদ্ধতি।
কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, কুর’আন পড়ে শোনানো এবং সালাত কায়েম ২টি ভিন্ন কাজ। তাহলে, প্রথম কাজের মতো দ্বিতীয় কাজটির পদ্ধতিও মহান আল্লাহ আলাদা করে বলে দিতেন। যেভাবে তিনি বলেছেন, ফজরে কুর’আন পড়ো, যতটুকু সহজ ততটুকু পড়ো, ধীরে ধীরে পড়ো, বিন্যাস করে পড়ো, যখন কর’আন পড়া হবে- তখন নীরব থাকো ও শোনো এরকম নানা নির্দেশ। কিন্তু সালাতের এমন কোনও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আল্লাহ দেন নি। তার একটাই কারণ, সালাত- আল্লাহর ঘোষিত বিধি-বিধান ছাড়া অন্য কোনও কাজ নয়।
সহজ উদাহরণ দেখুন:
ক. তোমরা খাবার খাও এবং ক্ষুধা নিবারণ করো।
খ. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করো এবং দেশে শান্তি ও কল্যাণ কায়েম করো।
গ. রাসায়নিক সার দেওয়া বন্ধ করো এবং মাটির উর্বরতা রক্ষা করো।
এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। এটাই সুস্পষ্ট যে, ‘এবং’-এর পরে কোনো বাক্যাংশ থাকলেই তা সবসময় নতুন কোনও কাজ হয়ে যায় না। বরং, আগের কাজের ফলাফল হয় ‘এবং’-এর পরের অংশটি। খাবার খেলেই ক্ষুধা নিবারণ হয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করলেই দেশে শান্তি ও কল্যাণ কায়েম হয়।
তেমনি, আল্লাহর হুকুম আহকাম নিয়ম কানুন মানুষের কাছে প্রচার করার মাধ্যমেই ‘আকিমুস সালাত’ বা সালাত কায়েম হয়। f
সালাতের এসব উদাহরণে দেখা যাচ্ছে- আল্লাহপাক প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন হুকুম, নিয়ম-কানুন জানিয়ে দিচ্ছেন এবং ঘোষণা করছেন- যে এটাই হলো আকিমুস সালাত বা সালাত প্রতিষ্ঠা। অন্যকথায়, কুর’আনের এসব ব্যক্তিগত পারিবারিক-সামাজিক নিয়মকানুন সমাজে প্রতিষ্ঠা করলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাকেই বলা হচ্ছে সালাত প্রতিষ্ঠা বা আকিমুস সালাত। একমাত্র এভাবেই দেখা দেবে প্রশান্তি ও বিশুদ্ধতা (যাকাত)।
৫.
সুরা মু’মিনুনের ১-৯ আয়াত দেখুন।
- নিশ্চয়ই মু’মিনগণ (বিশ্বাসীরা) সফল হয়েছে। তারা- যারা সালাতে বিনীত/ বিনম্র থাকে। তারা- যারা পরিশুদ্ধতা অর্জনের কাজ করে। তারা- যারা যৌনাঙ্গ হিফাজত করে; দম্পতিদের অথবা অধীনস্থদের ছাড়া- অবশ্যই এজন্য তারা তিরস্কৃত হবে না। এখন যে কেউ এর বাইরে কিছু খুঁজবে- তারা হবে সীমালঙ্ঘনকারী। আর তারা- যারা বিশ্বাস ও অঙ্গীকার রক্ষা করে; এবং তারা- যারা তাদের ওপরে সালাওয়াত রক্ষা করে। {২৩:১-৯}
মহান আল্লাহর কথা বলার একই বৈশিষ্ট্য এই আয়াতগুচ্ছেও দেখা যাচ্ছে। রব্বুল আলামিন তাঁকে বিশ্বাস করে- এমন মানুষদের কিছু দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন। তাদের সফলতার ঘোষণা দিলেন। তারপর কিছু হুকুমের কথা জানালেন। এরপর স্বাভাবিকভাবেই বলা উচিত ছিল- সফল হতে হলে এসব হুকুম যেন মানুষ পালন করে। সে কথাই তিনি বলছেন, সফল হলো “তারা- যারা তাদের ওপরে ‘সালাওয়াত’ রক্ষা করে।” এসব হুকুমের সমষ্টিকে তিনি বলছেন ‘সালাওয়াত’।
ঠিক যেমন, সুরা বাকারায় ২১৯ থেকে ২৩৭ আয়াতে মদ, জুয়া, শিশুদের দেখাশোনা, বিয়ে-তালাক ইত্যাদি নানা জটিল বিষয়ের অসংখ্য মানবিক বন্ধন-সংক্রান্ত হুকুম দিয়েছেন আল্লাহ। তারপর তিনি বলছেন-
- হাফিযু আ’লাস্ সালাওয়াতি ওয়াস সালাতিল উস্তা…
অর্থাৎ, এখানে আল্লাহ যেসব পারিবারিক-সামাজিক বন্ধনের হুকুমগুলো দিলেন, সেই সবগুলোকে একত্রে বলে দিলেন- সালাওয়াত (الصلوات)। এটাও বললেন যে- পারিবারিক, সামাজিক বন্ধনের হুকুম (الصلاة) বাস্তবায়ন যেনো ভারসাম্যপূর্ণ (وسطى) হয়।
মূল কথা:
মহান আল্লাহ যা বলছেন, সেই কথাগুলো সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করেছিলেন তাঁর রসুল, শেষ নবী মোহাম্মদ সা.। তিনি যথাযথভাবে তা বাস্তবায়ন করে গেছেন।
তিনি কী কী হুকুম-আহকাম, নির্দেশ, বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করেছেন তা হুবহু আমাদের সামনে আল-কুর’আনে সংরক্ষিত আছে। রসুলের অনুসরণকারী সব মানুষের জন্য করণীয় এখন সুস্পষ্ট।
মহান আল্লাহ কুর’আনে বলেছেন, ‘সালাত’, ‘সালাওয়াত’, ‘সিয়াম’ ইত্যাদি নানা শব্দ। এসব শব্দ মানে কি এবং কীভাবে তা করতে হয়, তা নিশ্চয়ই রব্বুল আলামিনকেই বলে দিতে হবে। আর মানুষ আল্লাহর ব্যাখ্যা অনুসরণ না করলে, নিজেদের মনগড়া বিষয়বস্তু তৈরি করে- তাকে ‘সালাত’, ‘সিয়াম’ ইত্যাদি নামে প্রচলন করবে এবং তাই এখন বেশিরভাগ মানুষ করেছে।
এ অবস্থায় সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য মানুষকে আল্লাহর কথা বলার পদ্ধতি বুঝতে হবে এবং তাঁর কথা বুঝতে হবে।
সুন্দর উপস্হাপনের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ