জাহান্নাম কী ও কোথায় (তৃতীয় পর্ব)
৪. জাহান্নামের অধিবাসী ও তাদের কথোপকথন
৪ ক). জাহান্নামের অধিবাসী
সাধারণভাবে আমরা জানি- যারা অবিশ্বাসী ও আল্লাহ আয়াত/নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করে, আল্লাহ-রসুলের বিরুদ্ধাচরণ করে, পৃথিবীতে বড় ধরনের পাপ ও মন্দ কাজ করে, যুদ্ধ-সংঘাত ও নিষিদ্ধ কাজ করে—তারাই জাহান্নামে থাকবে। সঙ্গে থাকবে জিন। তবে, মহাগ্রন্থে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে- কোন জাহান্নামে কোন ধরনের অপরাধী থাকবে। সে কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। নিচের আয়াতগুলো দেখা যাক।
- আমি অবশ্যই জিন ও ইনসানকে দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করবো– তোমার প্রভুর এ ঘোষণা পূর্ণ হবেই। {১১:১১৯}
- আমি অবশ্যই পরিপূর্ণ করবো জাহান্নামকে জিন ও মানুষ উভয়কে দিয়ে। {৩২:১৩}
- আর নিশ্চয়ই জাহান্নামের জন্য বহুগুণে বেড়েছে জিন ও ইনসানের অনেকে। তাদের অন্তর আছে, তবে তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করেনা। তাদের চোখ আছে, তবে তা দিয়ে তারা দেখে না। তাদের কান আছে, তবে তা দিয়ে তারা শোনে না। এরা হলো পশুর মতো, বরং তারা আরো অধিক বিভ্রান্ত এবং তারা অচেতন। {৭:১৭৯}
- তোমার প্রভুর শপথ! আমরা অবশ্যি তাদেরকে এবং শয়তানদেরকে হাশর করব, তারপর নতজানু করে জাহান্নামের চারদিকে হাজির করবোই। {১৯:৬৮}
নিঃসন্দেহে জিন ও মানুষ হবে জাহান্নামের অধিবাসী। সব ধরনের জাহান্নামে মানুষ যাবে; কিন্তু, সব জাহান্নামে কি জিন যাবে?
বলা হয়েছে- নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের শত্রু, তাই তাকে শত্রু হিসেবেই গ্রহণ করো; সে শুধু তার দলকে আহ্বান করে যাতে তারা আল-সায়িরের অধিবাসী হয়। {৩৫:৬}
জিনদের মধ্যে যারা শয়তান তারা সায়িরের অধিবাসী হবে। সুস্পষ্টভাবে এ কথাই বলা হয়েছে।
কিছু জিন ঈমান এনেছিল এবং তারা সৎকর্ম করে। তারা পুরস্কৃত হবে।
জিনরা মূলত সামাওয়াত ওয়াল আর্দের অধিবাসী। কিয়ামতের পর নতুন করে সৃষ্ট মহাবিশ্বে জিনেরা সায়িরে যাবে বলেই জানা যাচ্ছে। শয়তান জিনগুলো সেখানে শাস্তি পাবে, কিন্তু ভালো জিন নিশ্চয়ই শাস্তিমুক্ত থাকবে এবং মহাবিশ্বে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াবে বলেই ধারণা করা যায়।

৪.খ) জাহান্নামিদের কথোপকথন
জাহান্নামিদের কথোপকথন কুর’আনে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা কথা বলবে জাহান্নামের প্রহরীদের সঙ্গে, তারা নিজেরা কথা-বার্তা বলবে, তাদেরকে যারা পথভ্রষ্ট করেছিল- তাদের সঙ্গে কথা বলবে, কখনও কখনও জান্নাতিদের সঙ্গেও কথা বলার সুযোগ হবে, চিৎকার করে মহান রবের কাছে প্রার্থনা করবে—ইত্যাদি নানা ঘটনার আগাম উল্লেখ পাওয়া যায় মহাগ্রন্থে।
এসব অগ্রীম উল্লেখ করা ঘটনার মধ্যে শিক্ষণীয় নানা বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো—ঠিক কোন কোন অপরাধ করে তারা জাহান্নামে যাবে, তা জানা যায় অপরাধীদের বক্তব্যে।
এখানে কেউ কেউ মহান রব ও তাঁর আয়াতকে প্রশ্নবিদ্ধ করে উল্লেখ করেন যে—কে জাহান্নামে যাবে, তা রব্বুল আলামিন নির্ধারণ করে রেখেছেন বা জাহান্নামিদের কদর/তকদির পূর্বনির্ধারণ করে রেখেছেন! অর্থাৎ, নির্ধারিত ওই ব্যক্তিবর্গ ভালো হতে চাইলেও তাদের জাহান্নামে যেতেই হবে এবং নির্ধারিত খারাপ কাজ স্রষ্টার ইচ্ছাতেই পৃথিবীতে করতে হবে (নাঊযুবিল্লাহ!)। মহান আল্লাহর প্রতি দোষারোপ ছাড়া এটা আর কিছুই নয়।
মহান আল্লাহ তাঁর অসীম জ্ঞানের আলোকে জানেন—জাহান্নামিরা কোন ধরনের কথা বলবে। সেটাই তিনি উল্লেখ করেছেন এসব আয়াতে। তিনি কোনও দেশ বা শ্রেণী-পেশার মানুষের নাম-বংশ পরিচয় উল্লেখ করেন নি। নিঃসন্দেহে তিনি তাঁর অসীম জ্ঞানের (ঈলম) আলোকে জানেন কে বা কারা জাহান্নামী। তিনি এটাও জানেন- তাঁর আয়াত
শুনে কে বা কারা সত্য পথে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি কাউকে জোর জবরদস্তি করেন নি। মহান রব্বুল আলামিনের বিরুদ্ধে এমন প্রশ্ন করে থাকে সেইসব মানুষ—যারা মূলত (জেনে বা না-জেনে) মুশরিক হয়ে গেছে। তারা আল্লাহকে মান্য করে, সেই সঙ্গে শিরকও করে।
মোহাম্মদ রসুলাল্লাহর সময়ও মুশরিকদের এমন অযৌক্তিক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন— এসব কথা মনগড়া, অনুমান ও বাহানাবাজি। তাঁর রসুল রবের সুস্পষ্ট বার্তা সুষ্ঠুভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। ৬:১৪৮; ১৬:৩৫
আল্লাহ চাইল পৃথিবীর সব মানুষ ঈমান আনতো ১০:৯৯; তিনি চাইলে সবাই হতো এক উম্মত ১১:১১৮; সবাই পেত হিদায়াত ৩২:১৩ ও সিরাতুল মুস্তাকিম ১৬:৯।
এমন বাধ্য ও অনুগত হবার জন্য আল্লাহ কাউকে বাধ্য করেন নি। আর কাউকে আগে থেকেই মন্দ-ভাগ্য দিয়ে পূর্ব নির্ধারণ করে দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না! তিনি জিন ও মানুষকে সেই পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর সেই বক্তব্য সুস্পষ্ট করেছেন ৫১:৫৬ নং আয়াতে।
তাই জাহান্নামিদের কথোপকথন মানে, যারা সেখানে যাবে- তারা সেখানে কী কী কথা বলবে, তা আগে থেকেই আমাদেরকে জানিয়ে দিয়ে আরও বেশি সতর্ক হতে পরামর্শ দিচ্ছেন আল্লাহ।
এরপরও কি মানুষ দেখতে পায় না?
এবার আমরা জাহান্নামিদের কথোপকথনের দিকে মনোযোগ দেব।
- তারা আরো বলবে আমরা যদি (তাদের আহবান – উপদেশ) শুনতাম এবং আকল খাটাতাম, তাহলে আজ আমরা সায়ীরের (জাহান্নামের) অধিবাসী হতাম না।’ ৬৭:১০
- আল্লাহ বলবেন- তোমাদের আগে যেসব জিন ও মানব সম্প্রদায় গত হয়েছে তাদের সাথে জাহান্নামে দাখিল হও। যখনই একটি দল তাতে প্রবেশ করবে তখনই অপর দলকে তারা লানত দেবে। যখন সবাই তাতে একত্র হবে; তখন পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের বলবে আমাদের প্রভু! এরাই আমাদের গোমরাহ করেছিল; সুতরাং তাদের আগুনের আযাব দ্বিগুণ করে দাও। তিনি বলবেন- প্রত্যেকের জন্যেই রয়েছে দ্বিগুণ, তবে তোমরা তা জানোনা।’ ৭:৩৮
- তারা বলবে- আমাদের প্রভু! যে আমাদেরকে এর (জাহান্নামের) সম্মুখীন করেছে তাকে জাহান্নামে দ্বিগুণ শাস্তি বাড়িয়ে দাও। তারা আরো বলবে- কী হলো, পৃথিবীতে আমরা যাদের খারাপ লোক বলে গণ্য করতাম তাদেরকে যে (জাহান্নামে) দেখছি না! এতো নিশ্চিত ব্যাপার; জাহান্নামীদের মধ্যে এই বাকবিতন্ডা হবে। ৩৮:৬১-৬৪
জাহান্নামিদের আরও কথোপকথন দেখুন:
- কথোপকথন ১. সুরা আল মুদ্দাসির ৪২-৪৯
- কথোপকথন ২. সুরা মুলক ১০
- কথোপকথন ৩. সাফ্ফাত ২৮,২৯
- কথোপকথন ৪. আহযাব ৬৪-৬৭
- কথোপকথন ৫. হাদীদ ১৪
- কথোপকথন ৬. ইবরাহিম ২২
- কথোপকথন ৭. মু’মিন/গাফির ৪৭, ৪৮
এসব আয়াতে জাহান্নামীদের বিবৃতি থেকে জাহান্নামে শাস্তির মধ্যে পড়ার যেসব কারণ জানা যায়, তা হলো-
১. মৃত্যুর সময় পর্যন্ত কেউ যদি মুসল্লিদের অন্তর্ভুক্ত না হয়, অভাবগ্রস্তকে/ ক্ষুধার্তকে খাবার না দেয়, বিভ্রান্তিমূলক/ বেহুদা কথাবার্তায় ব্যস্ত থাকে এবং কর্মফল দিবসকে অস্বীকার করে।
২. কুর’আনের সতর্কতা না-শোনা এবং যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে না-বোঝা
৩. অবিশ্বাস করা, নবী/ রসুলদের মিথ্যাবাদী বলা এবং আল্লাহর আয়াতকে মিথ্যা বলা বা অস্বীকার করা।
৪. এতিমদের খাবারের ব্যবস্থা করা/ উৎসাহ না দেওয়া।
৫. এবং আল্লাহর আয়াতগুলো অস্বীকার করা
৬. মু‘মিন বা বিশ্বাসী না হওয়া।
৭. আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে মান্য না করা এবং সমাজ/ দেশের নেতা এবং বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালীদের আনুগত্য করা।
জাহান্নামিদের বিস্তারিত কথোপকথন দেখুন এখানে: জাহান্নামে যাওয়ার কারণ
- তারা বলবে- আমাদের প্রভু! যে আমাদেরকে এর (জাহান্নামের) সম্মুখীন করেছে তাকে জাহান্নামে দ্বিগুণ শাস্তি বাড়িয়ে দাও। তারা আরো বলবে- কী হলো, পৃথিবীতে আমরা যাদের খারাপ লোক বলে গণ্য করতাম তাদেরকে যে (জাহান্নামে) দেখছি না! এতো নিশ্চিত ব্যাপার; জাহান্নামীদের মধ্যে এই বাকবিতন্ডা হবে। ৩৮:৬১-৬৪
- আল্লাহ বলবেন- তোমাদের আগে যেসব জিন ও মানব সম্প্রদায় গত হয়েছে তাদের সাথে জাহান্নামে দাখিল হও। যখনই একটি দল তাতে প্রবেশ করবে তখনই অপর দলকে তারা লানত দেবে। যখন সবাই তাতে একত্র হবে; তখন পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের বলবে আমাদের প্রভু! এরাই আমাদের গোমরাহ করেছিল; সুতরাং তাদের আগুনের আযাব দ্বিগুণ করে দাও। তিনি বলবেন- প্রত্যেকের জন্যেই রয়েছে দ্বিগুণ, তবে তোমরা তা জানোনা।’ ৭:৩৮

৫. মহাকাশের জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের তথ্য-প্রমাণ
৫ (ক) সামাওয়াত বা মহাবিশ্বের গঠনপ্রকৃতি
আগেই বলা হয়েছে যে, সামাওয়াত ওয়াল আরদ হলো মহাকাশ ও যমিন-সমূহ। বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণ দিয়ে আমরা দেখব মহাকাশের কতটুকো দেখা যায় ও ধারণা করা যায়।
আমরা মূলত সুন্দরভাবে সুরক্ষিত এক পৃথিবীতে বাস করি। অথচ, এই মহাবিশ্ব (সামাওয়াত) হিংস্র ও ভয়ঙ্কর স্থান! মহাবিশ্বে (সামাওয়াতে) ধ্বংসাত্মক কোয়াসার এবং জ্বলন্ত ছায়াপথ-সহ গোটা মহাকাশে ছড়িয়ে রয়েছে প্রচণ্ড ক্ষতিকর বিকিরণ! মহাকাশে কোনও কিছুই অক্ষত থাকতে পারে না; সত্যিই ভয়াবহ বিপজ্জনক এই স্থান। একটি রেডিও সেট বা টিভি টিউন করলে মহাকাশের কোনও-না-কোনও গ্যালাক্সি ও কোয়াসারে বিশাল বিস্ফোরণের সিগনাল শোনা যায়! বিরামহীনভাবে সেই তরঙ্গ ধরা পড়ে রেডিও সিগনাল হিসেবে! নিরবচ্ছিন্ন প্রচণ্ড সব বিস্ফোরণের তরঙ্গায়তি ধ্বনি!
মূলত, এই মহাবিশ্ব হলো জিনদের (অনুরূপ প্রাণীদের) আরামদায়ক বাসস্থান; যাদেরকে অ্যান্টি-ম্যাটার (‘গর্তের আগুন’ / ব্ল্যাক হোল) থেকে তৈরি করা হয়েছে। তারা পৃথিবী-বান্ধব প্রাণী নয়; তারা মহাকাশে উড়ে বেড়ায়—ঘুরে বেড়ায়। জিনরাই মূলত এই মহাবিশ্বের সন্তান! জিনদের সম্পর্কে পড়ুন এখানে।
এই সামওয়াতে (এই মহাবিশ্ব), একটি আকাশের ভিতরে আরেকটি আকাশ রয়েছে। যেভাবে একটি সিদ্ধ ডিমের খোসার ভিতরে থাকে সাদা অংশ, আবার তার ভেতরে থাকে হলুদ অংশ।
সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে দুই স্তর আকাশ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
ছবিতে দেখুন।
এই স্তরে স্তরে বিন্যস্ত আকাশের উপাদানগুলো ক্রমশ- আলোর গতির চেয়েও বেশি গতিতে সরে যাচ্ছে দূরে- বহুদূরে! শুধু তাই নয়- সবকিছুই ছুটে চলছে ‘গ্রেট অ্যাট্রাকটরের’ দিকে! নির্দিষ্ট কেন্দ্রে পড়ে ধ্বংস হবার জন্য উন্মুখ এই মহাবিশ্ব বা সামাওয়াত। বিজ্ঞানী হাবল (হাবল টেলিস্কোপ যার নামে নামকরণ করা হয়) প্রথম লক্ষ্য করেন যে, একটা গ্যালাক্সি থেকে আরেকটি গ্যালাক্সি ক্রমশঃ দূরে সরে যাচ্ছে। এই দূরে সরে যাওয়া ও গতিবেগ নির্ধারণে তিনি আলোক রশ্মির বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। বিজ্ঞানের ভাষায় ডপলার ইফেক্ট (doppler effect)। এর মাধ্যমে জানা যায় যে, কোনও গ্যালাক্সি যদি আমাদের সাপেক্ষে ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে, তবে তার আলোর তরঙ্গ বিস্তৃত হতে থাকবে। একে বলে রেড শিফট।
[‘Red shift’ is a key concept for astronomers. The term can be understood literally – the wavelength of the light is stretched, so the light is seen as ‘shifted’ towards the red part of the spectrum. Something similar happens to sound waves when a source of sound moves relative to an observer.]

৫.খ) মহাকাশের (সামাওয়াতের) মৌলিক স্থাপনা এবং গঠনপ্রকৃতি
মহাকাশে রয়েছে উপগ্রহ<গ্রহ<নক্ষত্র<কৃষ্ণগহ্বর<গ্যালাক্সি ক্লাসটার<লোকাল গ্রুপ<অসংখ্য লোকাল গ্যালাক্সি গ্রুপ<মহাবিশ্ব।
চাঁদ হলো উপগ্রহ। সূর্য হলো নক্ষত্র। খালি চোখে তারা ভরা রাতে যত তারা বা নক্ষত্র দেখা যায় তা সূর্যের চেয়েও বৃহদাকার ও প্রচণ্ড শক্তিধর নক্ষত্র। এরকম কয়েক বিলিয়ন (১ বিলিয়ন=১০০ কোটি) নক্ষত্র নিয়ে গঠিত হয় গ্যালাক্সি। মহাবিশ্বে এখন পর্যন্ত ৪ ধরণের গ্যালাক্সির দেখা পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গ্যালাক্সিতে থাকা নক্ষত্রগুলো গ্র্যাভিটি (মহাকর্ষ বা অভিকর্ষ বল) একে অপরের সঙ্গে কাছাকাছি থেকে ছুটে চলছে এবং গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা প্রচণ্ড শক্তিধর ব্ল্যাকহোলকে কেন্দ্র করে ঘুরছে ও সেখানে গিয়ে পড়ছে।
আমাদের সূর্য যে গ্যালাক্সিতে রয়েছে- তার নাম মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা। সূর্যের সবচেয়ে কাছে যে নক্ষত্র রয়েছে তার নাম আলফা সেন্টুরি (মূলত কাছাকাছি তিনটি নক্ষত্রের জোট)। এর দূরত্ব ৪.৫ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ আলো সাড়ে ৪ বছরে যতটুকু দূরত্বে যেতে পারবে ঠিক তত দূরে রয়েছে আলফা সেন্টুরি। উল্লেখ্য, আলো এক সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে। তাহলে সাড়ে ৪ বছরে আলো কতটুকু দূরত্ব যাবে বলে মনে করেন?
নিকটবর্তী নক্ষত্রপুঞ্জেরই যদি এই অবস্থা হয়, বাকি হিসাব কে কবে শুরু করবে?
আমরা এবার সূর্যের মতো নক্ষত্র একটু চিন্তা করি। নক্ষত্র (স্টার) আসলে কী?
নক্ষত্র হলো বৃহদাকার গ্যাসের বল। সেখানে নিউক্লিয়ার ফিউসন বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। এতে করে প্রচুর তাপ ও আলো তৈরি হয় ও দাউ দাউ করে জ্বলে। খালি চোখেও লক্ষ-কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বের তারাকে আমরা মিটমিট করে জ্বলতে দেখি। আসলে তা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা গ্যাসীয় দানবের মুহুর্মুহু বিস্ফোরণ।
পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একটি নক্ষত্রের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কয়েকটি ধাপ জানতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। নক্ষত্র ধ্বংস হয় কয়েকটি পন্থায়—সেটাও জানা গেছে।
এ ছাড়া, অনেকটা স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়ায় গ্রহাণু, ধুমকেতু।
পাশাপাশি বিশাল যে শূন্যস্থান দেখা যায়- তা কিন্তু মোটেও শূন্য নয়। প্রায় সম্পূর্ণ মহাবিশ্ব জুড়ে আছে ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটার এবং সাধারণ পদার্থ। আরও আছে শক্তিশালী ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন (মহাবিশ্বের মোট ভর-শক্তির ০.০০৫% থেকে ০.০১% হতে পারে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা) এবং অ্যান্টিম্যাটার বা প্রতিপদার্থ।

৬. জাহান্নাম ও জাহান্নামিদের স্থায়িত্ব
- হতভাগারা থাকবে জাহান্নামে। সেখানে তাদের জন্যে থাকবে কেবল চিৎকার আর আর্তনাদ। সেখানেই স্থায়ীভাবে পড়ে থাকবে তারা যতদিন মহাকাশ ও যমিন-সমূহ বিদ্যমান থাকবে, যদি না তোমার প্রভু অন্য কিছু চান। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু যা চান তাই করেন।
আর যারা হবে ভাগ্যবান, তারা থাকবে জান্নাতে। চিরকাল তারা সেখানে (উপভোগ করতে) থাকবে, যতদিন বিদ্যমান থাকবে মহাকাশ ও যমিন-সমূহ, যদি না তোমার প্রভু ভিন্ন কিছু চান। এ এক অনন্ত অবিরাম পুরস্কার। {১১:১০৬,১০৭,১০৮}
এই দুই আয়াতে যে সুস্পষ্ট বার্তা পাওয়া যায়, তা হলো- যতদিন সামাওয়াত-আরদ থাকবে, ততদনি জান্নাত ও জাহান্নাম থাকবে। তবে, এর বাইরে মহাপ্রভু ভিন্ন কিছু চাইলে সেটাও হবে। তিনি বলছেন-
- যারা ঈমান আনে এবং আমলে সালেহ্ করে তাদের আতিথ্যের জন্যে প্রস্তুত রাখা হয়েছে জান্নাতুল ফেরদাউস।
চিরদিন থাকবে তারা সেখানে। তারা সেখান থেকে স্থানান্তর হতে চাইবে না। {১৮:১০৭,১০৮}
প্রশ্ন হলো- জান্নাত তো অনন্ত অবিরাম অফুরন্ত পুরস্কার। সেখান থেকে স্থানান্তরের কথা আসল কেন?
রব্বুল আলামিন একটি শব্দও অপ্রয়োজনে বলেন না। এই ঘটনাটিও ঘটবে। নিশ্চয়ই জান্নাত পরবর্তী জীবনে ভিন্ন কোনও ব্যব্স্থা করবেন তিনি। কিন্তু নেয়ামত প্রাপ্তরা সেখান থেকে বের হতে চাইবে না। দুনিয়ার সুখ শান্তি ও স্বচ্ছন্দের জীবন থেকেই মানুষ বের হতে চায়না। আর সেই অকল্পনীয় বিস্ময়কর জান্নাত থেকে বের হবার চিন্তা করার চিন্তাও মানুষের থাকার কথা না।
কিন্তু আল্লাহ চিন্তা করার খোরাক দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে কি?
আরকেটি বিষয় হলো- দুনিয়াতে অপকর্মের জন্য অপরাধীদের জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। কিন্তু, সেটার মেয়াদ কতদিন? দুনিয়াতে সীমিত সময়ের অপরাধের জন্য জাহান্নামে অসীম সময়ের শাস্তি ভোগের বিষয়টি কেমন? মহান আল্লাহর মতো ন্যায়পরায়ণ প্রভু কি তা করবেন? সেটা তিনিই ভালো জানেন।
যদি, দুনিয়াতে সীমিত সময়ের ভালো কাজের জন্য আখিরাতের জান্নাতিরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের পুরস্কার পায়; জাহান্নামীরাও ঠিক তেমন নির্দিষ্ট সময়ের শাস্তি পাবে বলেই ওপরের আয়াতগুলো থেকে মনে হচ্ছে।
এক্ষেত্রেও আল্লাহ-পাক দুই পক্ষের জন্য ভারসাম্য বা আদল বজায় রেখেছেন।
কারণ, জান্নাত ও জাহান্নাম ততদিন থাকবে- “যতদিন মহাকাশ ও যমিন-সমূহ বিদ্যমান থাকবে”। এ অবস্থায় মহাকাশ ও যমিনের গঠন ও স্থায়িত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানার্জন জরুরি।
এখানে আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে। জান্নাত থেকে আসলে কি বের হওয়া যায়?
অবশ্যই যায়। কারণ, একবার তো এমন ঘটনা ঘটেছিল।
- তখন আমরা বলেছিলাম, হে আদম! নিশ্চয়ই এ (ইবলিস) তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু। সে যেনো তোমাদের জান্নাত থেকে বের করে না দেয়। দিলে তোমরা পড়বে দুর্ভোগে। {২০:১১৭}
সেই জান্নাতে ইবলিসেরও প্রবেশাধিকার ছিল এবং তার ষড়যন্ত্রে পড়ে মানুষ জান্নাত থেকে বেরও হয়েছিল একবার। তাহলে আবার সেই জান্নাত পরবর্তী জীবন অসম্ভব কেন হবে? আল্লাহ ইচ্ছায় সম্মানের সঙ্গেই হবে নিশ্চয়ই।
আর জাহান্নামীরা ? তাদের কী অবস্থা হবে?
তারা জীবন বাজি রেখে জাহান্নাম থেকে বের হতে চাইবে। কিন্তু পারবে না।
- তারা আগুন থেকে বের হতে চাইবে, কিন্তু তারা তা থেকে বেরুতে পারবে না এবং তাদের জন্যে রয়েছে স্থায়ী আযাব। ৫:৩৭
- যখনই যন্ত্রণার জ্বালায় তারা জাহান্নাম থেকে বের হতে চাইবে, তখনই তাদের ফিরিয়ে দেয়া হবে তাতে। বলা হবে: আস্বাদন করো দগ্ধ হবার যন্ত্রণা। ২২:২২
- আর যারা ফাসেকি করে, তাদের আবাস হবে জাহান্নাম, যখনই তারা সেখান থেকে বের হতে চাইবে, তখনই তাদের সেখানে ঠেলে দেওয়া হবে….. ৩২:২০

তবে চূড়ান্তভাবে জাহান্নামীদের ভাগ্যে কী ঘটবে? ট্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন, জিলিয়ন ইয়ন কষ্ট ভোগ করার পর তাদের কপালে ভিন্ন কিছু কি জুটবে না?
সেরকম একটা ইঙ্গিতও কিন্তু কুর’আনে আছে ! দেখুন-
- যারা আমাদের আয়াতের প্রতি মিথ্যারোপ করে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তার বিরুদ্ধে অহংকার করেছে, তাদের জন্যে আসমানের দুয়ার খোলা হবেনা এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না- যতক্ষণ পর্যন্ত সুচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ না করে। এমন প্রতিফলই আমরা অপরাধীদের দিয়ে থাকি। {৭:৪০}
এতদিন আমরা দেখলাম, যারা আল্লাহর আয়াতকে মিথ্যারোপ করে, প্রত্যাখ্যান করে, বিরুদ্ধাচরণ করে—তারা কাফের এবং তারা জাহান্নামী। তবে, তারপরও আল্লাহ শর্ত দিয়ে বলছেন, “সুচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করার” শর্ত পূর্ণ হলেই কেবল সেসব জাহান্নামিদের জন্য আকাশের বাধা/দুয়ার খুলে দেওয়া হবে। যা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।
মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ যে গাফুরুর রহীম, রহমানুর রহীম- তা দেখা যাচ্ছে কি? তিনি তাঁর সৃষ্টির কথা কখনও ভোলেন না।
আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামিন…..।
এখন আরেকটি প্রশ্ন আসে। কীভাবে সুচের ছিদ্র দিয়ে উটের মতো বিরাট প্রাণী প্রবেশ করতে পারে?
এর উত্তরের জন্য আমাদের মহাকাশের গ্যালাক্সি এবং বিশেষ করে কৃষ্ণ-গহ্বরের গঠন ও কার্যপ্রণালী সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত ও প্রমাণিত তথ্যগুলো জানতে হবে। (এখানে দেখুন)
সার কথা হলো- শুধু উটই নয়, ব্ল্যাক হোলের গ্রাভিটেশনাল ফোর্সেরস (মহাকর্ষীয় বলের) টানে বিশালাকার কঠিন-পাথুরে বস্তু/ গ্রহ-নক্ষত্র- প্রচণ্ড চাপে ও তাপে- ভর (mass) সংকুচিত হয়ে- সরু ও সুতার মতো দীর্ঘ হয়ে- ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ-গহ্বরে গিয়ে পড়ে এবং সেখানে হারিয়ে যায় চিরতরে; চলে যায় অন্য কোথাও; অন্য এক জগতে!
এরকম ঘটনা মহাকাশে ঘটছে! ব্ল্যাক হোলগুলো অস্তিত্ব যুগ যুগ ধরে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের সেই রহস্যের দিকেই ইঙ্গিত করে।
আর মহান আল্লাহ বলছেন- ‘সুচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ না করা’ পর্যন্ত জাহান্নামিদের মুক্তি নাই। তাদের শাস্তির মেয়াদ জাহান্নামের শেষ দিন পর্যন্ত। যেদিন একটির পর একটি জাহান্নাম ভয়ঙ্কর ও প্রচণ্ড শক্তিশালী ব্ল্যাকহোলের কবলে পড়ে দুমড়ে-মুচড়ে চিরে-চ্যাপটা হয়ে, সরু হয়ে সুচের ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে যাবার মতো পর্যায়ের চলে যাবে…সেদিন অপরাধীদের শাস্তির মেয়াদ পূর্ণ করে- তাদের জন্য খুলে দেওয়া হবে বারযাখের দরজা। তাদের জন্য আসবে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ।
মহান রব্বুল আলামিন তাঁর সৃষ্টির জন্য রহমানুর রাহীম গফুরুর রাহীম—তা বহুবারের মতো আবারও প্রমাণিত হবে।
প্রথম প্রকাশ: ১১ মার্চ, ২০২২