লাইলাতুল কদর; আঁধার থেকে আলো
১. নিশ্চয়ই আমি এটা পাঠিয়েছি কদরের রাতে/আঁধারে।
২. তুমি কি জানো- কদরের রাত/আঁধারটি কী?
৩. সেই আঁধার/রাতটি হাজার মাসের (ঘটনার) চেয়েও উত্তম।
৪. পাঠানো হয়েছিল মালাইকা ও রুহ রবের নির্দেশে- সব কাজের জন্য।
৫. প্রশান্তি- ফজর উদ্ভাসিত হওয়া পর্যন্ত।
বি.দ্র: Qadar (Arabic: قدر, transliterated qadar, meaning “fate”, “divine fore-ordainment“, “predestination,” but literally “power”)
‘কদর’ শব্দ (قدر) থেকেই ‘তাকদির’ শব্দ এবং ‘পূর্ব-নির্ধারিত ভাগ্যের’ আরোপিত ধারণাটি তৈরি করা হয়েছে। এবার প্রচলিত অনুবাদের গড়মিল ও মিথ্যাচারগুলো দেখুন।
মহান আল্লাহ তাঁর কোনও সৃষ্টির জন্য মন্দ, অশুভ, অকল্যাণ চান না- চাইতে পারেন না। তাঁর অবাধ্য হওয়ায় ইবলিসকে তিনি ‘মানুষের চিরশত্রু‘ বলে জানিয়ে দিলেন, পথভ্রষ্ট ও জাহান্নামি বলে ঘোষণা করলেন। কিন্তু, মহাবিশ্বের জীবনে, কিয়ামতের আগ-পর্যন্ত ইবলিস, জিন-শয়তান ও তার অনুসারী মানুষদের ধ্বংস করে দেননি, মন্দ-ভাগ্য চাপিয়ে দেননি। বরং কুর’আন-জুড়ে বার বার তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে এবং সৎপথে ফিরে আসতে বলা হয়েছে। মৃত্যুবরণ করার আগে সবার জন্য এ সুযোগ খোলা আছে। ইবলিস তার অবাধ্যতার জন্য ক্ষমাও চায়নি। বরং সে মানবজাতির বিরুদ্ধে শত্রুতা করার প্রার্থনা করেছিল। সেই প্রার্থনাও কবুল করেছিলেন আল্লাহ।
মহান আল্লাহ নিজে ঘোষণা করেছেন- তাঁর রহমত, দয়া ক্রোধের চেয়েও শক্তিশালী, সবকিছুকে ঘিরে রেখেছে। তিনি তাঁরই সৃষ্ট জীব-জন্তু-বস্তুকে দুর্ভাগ্যের বোঝা চাপিয়ে দেবেন- এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা না। তাত্ত্বিকভাবেও এটা গ্রহণযোগ্য নয়। তাই, মহান রব যখন আল-কদর বলেন, সেটা ‘সুন্দর ও সুনির্দিষ্ট গতিপথ’ এবং মানুষ-সহ সব প্রাণীর জন্য সঠিক গতিপথ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। তিনিই জানিয়েছেন–সেই অন্ধকার সময়ে কী পাঠানো হয়েছিল। কেন ‘সেই আঁধার রাত’ বিশেষ বৈশিষ্ট্যময় হয়ে গিয়েছিল!
লাইলাতুল কদর কী?
কদরের সেই আঁধার সময়ের খবর একমাত্র তিনিই জানাতে পারেন। কারণ, তিনিই সেই সময় ‘কদর নির্ধারণকারী রুহ’ পাঠিয়েছেন। তিনি বলছেন, এই রাতের ঘটনাটি (সংক্ষেপে- রাতটি) হাজার ঘটনার চেয়েও উত্তম।
প্রভু নিজেই বলেছেন, তুমি কীভাবে জানবে সেই লাইলাতুল কদর সম্পর্কে?
তার কারণ কী?
সেই বিশেষ নীরব, প্রশান্ত, গভীর অন্ধকারে পাঠানো হয়েছিল “আর-রুহ”। সেই রুহ বয়ে এনেছিলেন মালাইকা বা ফেরেশতাগণ।
“আর-রুহ” কী? রুহের কাজ কী?
মহাগ্রন্থে আল্লাহ বলেছেন- রুহ হলো মহান প্রভুর আদেশ/ অর্ডার/ কমান্ড। অর্থাত্, রুহ হলো নিয়ম-বিধান, যা অলঙ্ঘনীয়। ‘নফস ও রুহ’ অধ্যায়ে ‘রুহ’ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হয়েছে। পড়ুন এখানে
আর রুহের কাজ– মহাজগতের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। তারা কীভাবে কাজ করবে- তার নিয়ম। একটি অ্যাটম কীভাবে কাজ করবে, কীভাবে অণু-পরমাণু ভূমিকা রাখবে, কীভাবে একটি কোষ গঠন হবে, কীভাবে লক্ষ, কোটি, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন বছর ধরে বিস্ময়কর বিবর্তনের নানা ঘটনা ঘটবে, কীভাবে পৃথিবীর মতো ভূপৃষ্ঠ তৈরি হবে, ধীরে ধীরে সেখানে প্রাণ বিকাশের উপযোগী হবে; কীভাবে মহাশূন্যের বিশাল শূন্যতা ক্রমেই প্রসারিত হবে, কীভাবে আলো ছুটে চলবে, তার গতি কেমন হলে মহাশূন্যে অন্ধকার সাম্রাজ্য বজায় থাকবে ইত্যাদি বিষয় হলো প্রতিটি বস্তুর ‘কদর’।
৪ নং আয়াতে “প্রত্যেক কাজের জন্য” মানে কি?
‘প্রত্যেক কাজের জন্য’ মানে ‘প্রত্যেক সৃষ্টির সব ধরনের ভূমিকা’। বস্তুর সৃষ্টি থেকে ধ্বংস পর্যন্ত পথ। ‘সামাওয়াত ওয়াল আরদ’ বা মহাবিশ্বের ডাইমেনশনে (বহু স্তরে সজ্জিত আকাশমণ্ডলী) মহান প্রভুর অর্ডার বা নিয়মকানুন নিয়ে এসেছিলেন সম্মানিত মালাইকাগণ। ধারণার অতীত সেই সময় আগে, মহা-বিশ্বজগত সৃষ্টির সূচনালগ্নে সবকিছুর নিয়ম সুন্দরভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তার ফলাফল হলো ‘ফাইন টিউন ইউনিভার্স’ বা নিখুঁত মহা-বিশ্বজগত। সাধারণ মানুষ বলে প্রাকৃতিক নিয়ম। বিজ্ঞানীরা বলেন- মহাবিশ্বের প্রাথমিক নিয়মবিধি (initial configuration of universe)। এই নিয়মের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে কিয়ামতের প্রবল ধ্বংসযজ্ঞের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মহাবিশ্ব। এর কোনও পরিবর্তন হবে না। দৃশ্যমান ও অদৃশ্য প্রতিটি বিষয়ের অলঙ্ঘনীয় নিয়মাবলী বা নির্দেশ-সমূহ হলো “আর-রুহ”।
মহাজগতের নিয়ম-কানুন বেঁধে দেওয়ার সেই সময় পর্যন্ত সব কিছু ছিল প্রশান্ত, নীরব, নিস্তব্ধ! স্তরে স্তরে সজ্জিত সাত আকাশ জুড়ে বিরাজ করছিল প্রশান্তিময় নীরবতা!
তারপর সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া নতুন নিয়ম-বিধানের ওপর ভিত্তি করে দেখা দিল নতুন সময়, একটি নতুন ভোর…। প্রশান্তির নীরবতা ভেদ করে ফুটে উঠল নতুন জীবনের আলো!
লক্ষ্যণীয় যে, এই সুরার কোথাও বলা হয়নি, কদরের রাতে নাযিল হয়েছিল “আল-কুর‘আন”। বরং মালাইকা নাযিল হয়েছিলেন “আর-রুহ” নিয়ে।
সেটা নবীর জীবদ্দশায় “কদরের রাত”- সে কথাও বলা হয়নি। প্রতি বছর ঘুরে ফিরে আসে “কদরের রাত”; এটা একটা “নির্দিষ্ট মাস”–এমন কোনও ইঙ্গিতও দেওয়া হয়নি! কারণ তা অসম্ভব!
বরং, বলা হয়েছে- এমন একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল সুদূর অতীতে একবার, যখন কোনও দিন, মাস, আলো- কিছুই ছিল না! প্রত্যেক বিষয়ের ‘রুহ’ সংযুক্ত করে দেবার পর দেখা দিয়েছিল নতুন আলো- একটি নতুন মহাবিশ্বে। জেগে উঠেছিল সুপ্ত, ঘুমন্ত মহা-বিশ্বজগত।
যেমন, প্রতি রাতে ঘুমের সময় মহান প্রভু আমাদের রুহ নিয়ে যান। অন্ধকারে প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে মানুষ। যাদের হায়াত আছে, তাদের রুহ ফেরত আসে। সে তখন জেগে ওঠে, দিনের আলো দেখে।
ঠিক এভাবেই জেগে উঠেছিল বিপুল মহাবিশ্ব– সৃষ্টির সূচনালগ্নে। অবিশ্বাসী বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত তা স্বীকার করতে বাধ্য হন। তা ছাড়া, বিজ্ঞানের কোনও তত্ত্বই দাঁড় করানো যায় না।
এই সুরার মধ্যে “ধর্মীয় আবেগের” চেয়ে ঢের বেশি আছে মহা-জ্ঞান ও মহা-বিজ্ঞান, মহা-জ্ঞানী স্রষ্টার বিস্ময়কর ক্ষমতার সামান্য ঝলকানি, যা তাঁর অসীম শক্তিমত্তার একটি নিদর্শন।
শ্বাসরুদ্ধকর মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য তিনি মানুষের সামনে উন্মোচন করেছেন তাঁর অসীম দয়া ও অসীম জ্ঞান থেকেল
প্রথম প্রকাশ: ৭ এপ্রিল ২০২২
কদরের রাত সম্পর্কে সবখানে একই বর্ননা পাচ্ছি। এখানে কি আমাদের সৃষ্টি জগতের সুচনা এবং এ ধরনের কথা বলান হয়েছে? বিস্তারিত জানতে চাই।
ধন্যবাদ।
মহাবিশ্বের সুচনার কথা বলা হয়েছে। বিস্তারিত দেখতে পারেন এখানে
https://islamofquran.com/human_destiny/
Pingback: তকদির বা পূর্ব-নির্ধারিত ভাগ্য !?! -২,, – Islam Religion