সাজাদা বা সিজদা কী

সাজাদা বা সিজদা: কী, কেন ও কীভাবে?

সাজদা- বহুল আলোচিত একটি শব্দ। আরবি এই শব্দটির বাংলা অর্থ কী? কুর’আন অনুসারী এবং প্রচলিত ধর্মের অনুসারীদের কথা থেকে এ বিষয়ে মৌলিক যে পার্থক্য পাওয়া যায় তা হলো- 
কুর’আন অনুসারীরা বলেন সাজদা বা সিজদা হলো
Submission to Allah মহান আল্লাহর হুকুম আহকামকে নিঃসঙ্কোচে মেনে নেওয়া। এর সঙ্গে শারীরিক অঙ্গভঙ্গীর সম্পর্ক নেই। 

পাশাপাশি প্রচলিত ধর্মচর্চা-কারীদের মতে সাজদা বা সিজদা হলো- মাটিতে নাক ও কপাল ঠেকিয়ে মহান আল্লাহর তসবিহ করা। 

আমরা বোঝার চেষ্টা করব- ১. মৌলিক এই পার্থক্যের ভিত্তি কী? ২. আমাদের যৌক্তিক বোধ কী বলে? ৩. মহাগ্রন্থ আল-কুর’আন এ বিষয়ে কী বলে? 

অবশ্যই আল-কিতাবের সিদ্ধান্তই সবার জন্য চূড়ান্ত।

১. মৌলিক এই পার্থক্যের ভিত্তি কী?

কুর’আন অনুসারী: সিজদা কোনও শারীরিক কার্যক্রম নয়। এর ভিত্তি আল-কিতাব বা মহাগ্রন্থ। সাজাদা মানে ‘অবনত চিত্তে মেনে নেওয়া’।

প্রচলিত ধর্ম অনুসারী: এর ভিত্তি পূর্বপুরুষদের আচার কার্যক্রম; যা এসেছে ‘শেষ নবীর সুন্নাহ’ থেকে। নবীকে আমরা দেখিনি- তাতে কোনও সমস্যা নেই। আমরা দেখেছি আমাদের বাপ-দাদা এবং সমাজ ও বিশ্বের বেশিরভাগ মুসলিমকে। এটাই হলো ভিত্তি।

২. আমাদের যৌক্তিক বোধ কী বলে?

কুর’আন অনুসারী: যুক্তি বলে- সাজাদার মূল উদ্দেশ্য হলো মেনে নেওয়া বা Submission. কেউ যদি অন্তর থেকে বা হৃদয় দিয়ে আল্লাহকে না-মানে, তাহলে তার শারীরিক কার্যক্রমের (মাটিতে মাথা ঠেকানোর) কোনও মূল্য নেই। যেমন, যে কোনও যুগের মুনাফিক অথবা ছদ্মবেশী মুসলিম। যারা ষড়যন্ত্রের জন্য মুসলিমদের মধ্যে মুসলিম হিসেবে থাকে এবং মুসলমানদের মতো সব কাজই করে। কিন্তু তাদের ‘সিজদা’ কখনওই ‘সিজদা’ হয় না। মন থেকে মেনে নেওয়াই প্রকৃত উদ্দেশ্য; আর এটাই সিজদা।

তাই, সর্বাবস্থায় সাজাদা বা সিজদা মানে- ‘অবনত চিত্তে আল্লাহর কথা মেনে নেওয়া’

প্রচলিত ধর্ম অনুসারী: শরীর অবনত করে মাটিতে কপাল মাথা ঠেকানোই সিজদা। অবশ্যই অন্তর থেকেও মেনে নিতে হবে। অন্তর থেকে না-মানলে সিজদা হবে না। তাকে মুনাফেকি বা প্রতারণা বলে। তবে, মাটিতে কপাল ঠেকানোর শারীরিক কাজ করতেই হবে।

৩. মহাগ্রন্থ আল-কুর’আন এ বিষয়ে কী বলে?

সাজদা নিয়ে মহাগ্রন্থ আল-কুর’আনে অসংখ্য আয়াত আছে। কারণ মহান আল্লাহ বার বার তাঁকে মেনে নেওয়ার জন্য মানবজাতিকে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে মেনে নেওয়া বা সাজদা মানে কী? সেটাও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন- উদাহরণ ও উপমা দিয়ে বলেছেন। চলুন প্রচলিত অনুবাদ থেকেই তা দেখি ও বোঝার চেষ্টা করি।

১৩:১৫ এবং আল্লাহকেই নিঃসঙ্কোচে মেনে নেয় (يَسْجُدُ) যা কিছু আছে আকাশ ও যমিনগুলোর মধ্যে ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় (طَوْعًا وَّكَرْهًا) আর তাদের ছায়াগুলো (ظِلَٰلُهُم) সকাল-সন্ধ্যায় (بِالْغُدُوِّ وَالْاٰصَالِ)।

১৬:৪৮ তারা কি দেখে না— আল্লাহ  যা কিছু সৃষ্টি করেছেন সেগুলোর ছায়া ডানে ও বামে ঢলে পড়ে আল্লাহর প্রতি সাজদাবনত হয়?

২২:১৮ তুমি কি দেখছো না— আল্লাহকে সাজদা করছে সবাই, যারা মহাকাশে ও পৃথিবীতে, সূর্য, চাঁদ, নক্ষত্ররাজি, পাহাড় পর্বত, বৃক্ষলতা, জীব-জন্তু; এ ছাড়া মানুষের মধ্যেও অনেকেই…

এখানে, ১৩:১৫ আয়াতে অনিচ্ছায় সাজাদা করার কথা বলা হয়েছে। সেটা কীভাবে? তা নিচে উল্লেখ করা হলো। পাশাপাশি সূর্য, চাঁদের সাজাদা কী? আল্লাহ বলছেন- আমরা তা দেখতে পাই। অর্থাত্, চাঁদ-সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্রের যে বিষয়গুলো আমরা দেখতে পাই সেগুলোই হলো সাজাদা বা সিজদার পদ্ধতি।

আমরা কী দেখতে পাই? তারও জবাব কিতাবেই দেওয়া হয়েছে!

৭:৫৪ সূর্য, চাঁদ ও তারকারাজি তাঁরই নির্দেশের অধীন। সাবধান, সৃষ্টিও তাঁর, নির্দেশও তাঁর।

১৪:৩৩ তিনি তোমাদেরই কল্যাণে নিয়োজিত করে দিয়েছেন সূর্য ও চাঁদকে; তারা অবিরাম একই নিয়ম মেনে চলে; তিনি তোমাদের কল্যাণে আরো নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিনকে।

৩৯:৫  তিনি সূর্য ও চাঁদকে নিয়মের অধীন করেছেন; এরা প্রত্যেকেই ভ্রমণ করে একটি নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত।

৫৫:৫ সূর্য আর চাঁদ হিসাব মতো চলে।

অর্থাত্, আল্লাহর নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি বস্তুর স্বাভাবিক কার্যক্রমই হলো তার ‘নিয়ম মেনে চলা বা সাজাদা’

পাশাপাশি,
১৬:৪৮ ও ২২:১৮ নং আয়াতে বস্তুর ছায়া এবং আল্লাহর অনুগতরা “মহাকাশে ও পৃথিবীতে সূর্য
, চাঁদ, নক্ষত্ররাজি, পাহাড় পর্বত, বৃক্ষলতা, জীব-জন্তু; এ ছাড়া মানুষের মধ্যেও অনেকেই..” আল্লাহর নিয়ম সচেতনভাবে মেনে চলছে বা সাজাদা করছে। আর আমরা এই নিয়ম অনুসরণ দেখতে পাচ্ছি। এটাই আল্লাহ চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলেছেন “তারা কি দেখে না, তুমি কি দেখছো না ”। অর্থাত্, আপনি ও আমি তা দেখতে পাচ্ছি।

এবার আমরা দেখি- ১৩:১৫ আয়াতে অনিচ্ছায় সাজাদা করার কথা বলা হয়েছে। কে বা কারা অনিচ্ছায় সাজাদা করে। মহান রব একটি শব্দও বিনা-কারণে উল্লেখ করেন নি। তিনি বলছেন-

১৩:১৫ মহাকাশ ও পৃথিবীতে যারাই আছে, সবাই ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, আল্লাহকে সাজদা (ইয়াসজুদু) করে এবং তাদের ছায়াগুলোও তাঁকে সাজদা করে সকালে ও বিকেলে।

এই মহাবিশ্বে ২ ধরণের প্রাণী আছে যারা কিছুটা স্বাধীন। তারা মানুষ ও জিন।
সবকিছুই আল্লাহর নিয়ম মেনে চলে। কিন্তু মানুষ ও জিন কিছুটা অবাধ্য হবার স্বাধীনতা ভোগ করে। যারা অবাধ্য হয়- তারা কি কোনও কিছু সাজাদা করে? অথবা, তারা কি অনিচ্ছায় হলেও কোনও কিছু মেনে নেয়? চিন্তা করুন। 
হ্যাঁ, অনিচ্ছায় হলেও অবাধ্য মানুষ (ও জিন) আল্লাহর নিয়ম মেনে নেয় বা সাজাদা করে।
কীভাবে? 

মানুষের অবাধ্য হবার শক্তি কে দিয়েছে? কোথা থেকে এসেছে? যেই মগজ খাটিয়ে, যেই হাত-পা-মুখ দিয়ে অপকর্ম করা হয়- সেগুলো কে দিয়েছে? মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অপকর্ম করার স্বাধীনতা ও সীমা কে বেঁধে দিয়েছে?

সবগুলোর উত্তর আল্লাহ দিয়েছেন। অপকর্ম করতে চাইলে তার লিমিট বা সীমা তিনিই বেঁধে দিয়েছেন। অপকর্ম করা মানুষটি তার সব কিছুকে আল্লাহর বেঁধে দেওয়া নিয়ম দিয়েই ব্যবহার করে অর্থাত্ সাজাদা করে বা মেনে নেয়। কিন্তু, তা আল্লাহর নির্দেশিত পথে বা পদ্ধতিতে ব্যবহার না করায় সাজাদা করেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়ে যায়। এজন্যই আল্লাহ বলছেন : সবাই ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, আল্লাহকে সাজদা (ইয়াসজুদু) করে

আপনার হাতের ক্ষমতা, চোখের ক্ষমতা, মন-মগজের ক্ষমতা—সবই মহান আল্লাহর দেওয়া। তাঁর দেওয়া শক্তিগুলো ব্যবহার করেই তাঁর অবাধ্যতা করা হয়। যখনই তাঁর দেওয়া নেয়ামতগুলো নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী ব্যবহার করা হয়- তখনই ‘সাজাদা হয়’– কিন্তু ভালো বা মন্দ কাজে ব্যবহারের স্বাধীন সিদ্ধান্ত মানুষই (নফস) নেয়। তাই মানুষকেই বা নফসকেই পুরষ্কার বা শাস্তি দেওয়া হবে। 

আল্লাহ সুস্পষ্ট করে উদাহরণ দিয়ে বলছেন-

৪১:৩৭ তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে রাত, দিন এবং সূর্য ও চাঁদ; তোমরা সূর্যকে সাজদা কোরো না, চাঁদকেও নয়; সাজদা করো আল্লাহকেযিনি সেসব সৃষ্টি করেছেন- যদি তোমরা সত্যিই তাঁর ইবাদত করো। 

২৪:৪১ তুমি কী দেখো (تَرَ) না- আল্লাহর সাব্বিহ করছে (يُسَبِّحُ) মহাকাশ ও যমিনে যা-কিছু আছে সব এবং পাখিরাও ডানা মেলে (صَٰٓفَّٰتٍۖ); নিশ্চয়ই সবাই জানে তার সালাত (صَلَاتَهُ) ও তসবিহ (تَسْبِيحَهُ); আর তারা যা করে আল্লাহ্ তা জানেন।

8 thoughts on “সাজাদা বা সিজদা কী”

  1. সালামুন আলাইকুম , খুব সুন্দর লাগলো । আলহামদুলিল্লাহ ।

  2. সত্যিই চমৎকার এবং বাস্তবধর্মী! আল্লাহ্ আপনাদের সফল করুন

  3. Md Shahadat Hossain

    আপনি এত রেফারেন্স দিলেন কিন্ত রললেন না রাছুল সঃ কিভাবে সিজদা করেছেন? ইসলাম কোরান আর রাছুল সঃএর শিক্ষা ছাড়া অচল। এটা এমন যে পিতৃ পরিচয় বিহীন সন্তান। কোরআন এ অসংখ্য আয়াত আছে রাছুল সঃএর অনুসরণ অনুকরণ করার। আর রাছুল কেন প্রেরিত হয়েছেন? উত্তর-সুরাহ বাকারার 151 আয়াত।

    1. আপনার প্রতিটি কথা ভুল। ইসলাম চলে হাদিসের বই অনুযায়ী।
      ইসলাম ও হাদিসের সঙ্গে আল-কুর’আনের কোনো সম্পর্ক নাই। শুধুমাত্র কুর’আন অধ্যয়ন করলেই তা বুঝতে পারবেন। যেহেতু করেন না, সেহেতু আবেগ দিয়ে কথা বলছেন।
      যাই হোক, পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনার কি করণীয়.. সে প্রেসকিপশন দেওয়া হয়েছে। অনুসরণ করুন।

  4. Syed Al Kaium

    অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্য। বোজার চেষ্টা করতেছি। প্রচলিত যে সিজদাহ্ মুসলিম সমাজে বিরাজমান এটা কখন ও কীভাবে প্রবেশ করেছে? একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে দীর্ঘ সময়ে, হয়তো সালামুন আলা ইব্রাহিম, ইসমাঈল, ইসহাক, মুসা, ঈসা বা মুহাম্মাদ থেকে কারণ সালাত তো শুধু আমাদের না সকল ধর্মের এবং এর মধ্যে সিজদাহ্ আছে নাকি নাই?

    1. সিজদা শব্দের সরল অর্থ হলো মান্য করা বা মেনে চলা। এটা কোনো শারীরিক কাজ নয়।
      ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *