করদে হাসানা (قَرْضًا حَسَنًا) কি ও কিভাবে?
কুর'আন রিসার্চ সেন্টার- কিউ আর সি
ভূমিকা: প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী কর্জে হাসানা কথাটার অর্থ হলো ‘উত্তম ঋণ‘। বিনা সুদে ও বিনা লাভে মানুষকে আর্থিক ঋণ দেওয়া ‘কর্জে হাসানা’ নামে পরিচিত। পাশাপাশি, দাবি করা হয় যে, মহান আল্লাহ মানুষের কাছে আর্থিক ঋণ চেয়েছেন এভাবে- “কে সে, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেবে? আল্লাহ তার জন্য একে বহুগুণে বাড়িয়ে দেবেন।”
প্রচলিত এই ধারণা ও দাবি কতটুকু সঠিক? চলুন আজ খতিয়ে দেখি।
উল্লেখ্য যে, জীবনযাত্রা পরিচালনায় ব্যক্তি, সংস্থা, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আর্থিক লোন/ঋণ গ্রহণ করে ও করতে হয়। তাতে স্বাভাবিক সুদ/মুনাফা/লাভ, চক্রবৃদ্ধি সুদ, সুদমুক্ত লোন ইত্যাদি নানা পদ্ধতি বহুকাল ধরেই বিশ্বে প্রচলিত রয়েছে। আমরা সেসব পদ্ধতির সমালোচনা করছি না। এ প্রবন্ধে শুধুমাত্র ‘করদে হাসানা (قَرْضًا حَسَنًا)‘ কথাটি দিয়ে মহান আল্লাহ কি বোঝাতে চেয়েছেন- সেটাই জানার ও বোঝার চেষ্টা করা হবে।
এজন্য, দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে। আভিধানিক পদ্ধতি ও কুর’আনিক যাচাই।
১.আভিধানিক পদ্ধতি
প্রথমেই ‘করদে হাসানা (قَرْضًا حَسَنًا)‘ শব্দটির আভিধানিক অনুবাদ দেখা যাক। একাধিক অভিধানে শব্দটির ধাতু (ق ر ض) দিয়ে তৈরি শব্দ- করদান (قَرْضًا) শব্দটির যেসব অর্থ আছে, তা হলো: কাটা, কেটে ফেলা, বিচ্ছিন্ন করা, ঘুরিয়ে দেওয়া, মৃদু কামড়, ভালো কাজ করা ইত্যাদি।
অর্থাৎ, এর করদ শব্দটির মধ্যে ‘টাকা’ ও ‘ঋণ দেওয়া’- এ জাতীয় কোনো বিষয় নাই। কেউ অর্থ ঋণ দিয়ে, ঋণ ফেরত না-নিয়ে বা অন্য কোনোভাবে মানুষের উপকার করতে চাইলে- সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু, করদান (قَرْضًا) শব্দের মধ্যে সে-বিষয়টি, সে শব্দগুলো লেখা নেই- এটা খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। অভিধানের সংযুক্ত ছবি গুলো দেখে নিন।
প্রাসঙ্গিক আরেকটি অংশ হলো- ইয়ুকরিদুল্লাহ (يقرض الله), যার অর্থ করা হয়েছে আল্লাহকে ধার/Lone/ঋণ দেওয়া ! উল্লেখিত আভিধানিক তথ্য অনুযায়ী- এখানে টাকা পয়সা লোন-ধার-ঋণের কোনো কারবার নাই। বরং, সঠিক অর্থ হতে পারে- আল্লাহকে অগ্রিম দেওয়া। এই অগ্রিম দিয়ে রাখাটা মানুষের নিজের জন্যই। পরবর্তী সময়ে যা বহুগুণে ফেরত দেওয়ার সুখবর জানিয়েছেন মালিকি-ইয়াওমিদ্দিন। তিনি মানুষের মন্দ কাজগুলো ক্ষমা না করলে সেটারও মন্দ পরিণতি ফেরত দেবেন তিনি! আমরা সবাই নিজেদের মন্দ কাজের ক্ষমাই চাই। মন্দ পরিণতি কেউ চাই না!
আরেকটি বিষয় হলো, কাউকে Lone/ধার দেওয়ার সঙ্গে কিন্তু ওই ব্যক্তির ঋণগ্রস্ত হওয়া, চাহিদা, প্রয়োজনীয়তার সম্পর্ক থাকে। অর্থাৎ, লোন/ধার/ঋণ শব্দটি শুধুমাত্র চাহিদাবান, অসহায়, সাহায্য-আকাঙ্ক্ষীর জন্যই ব্যবহার করা যায়। সেটা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যাই হোক না কেন।
আবার, যদি ব্যক্তির চেয়ে বড় কোনো প্রতিষ্ঠান-সংস্থা-রাষ্ট্রকে কোনো মানুষ লোন/ধার/ঋণ দেয় সেটাকে আর ‘লোন’ বলা হয় না। কারণ, বড় সেই প্রতিষ্ঠানের সম্মানার্থে তাকে ভিন্ন শব্দ দেওয়া হয়। যেমন, ব্যাংকে টাকা জমা রাখা মানে ব্যাংক নামের প্রতিষ্ঠানকে একটা মানুষ Lone/ধার/ঋণ দিল। কিন্তু, তাকে বলা হয় ব্যাংকে ‘আমানত’ রাখা। আবার রাষ্ট্র যখন আপনার কাছ থেকে লোন/ধার/ঋণ নেয় তখন আপনি বলেন- সঞ্চয়পত্র বা ট্রেজারি বন্ড। রাষ্ট্র ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে মানুষের কাছ থেকে ধার নেয়।
এক্ষেত্রে, রাষ্ট্র ও ব্যাংক মানুষের মুখাপেক্ষী ও সাহায্যপ্রার্থী। আর স্বয়ং মহান রব্বুল আলামিনকে আপনি অগ্রিম পাঠাবেন আর বলবেন Lone/ধার/ঋণ !!!!!!!!! এটা কতটুকু সম্মানজনক আচরণ হলো ???
তিনি কি কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী? তিনি কি আপনাকে-আমাকে জান্নাতে না দিলে বা জাহান্নামের নিকৃষ্ট আবাসে স্থান দিলে কোনো দিক থেকে তাঁর কোনো কিছু হবে?
মহান রবের সঙ্গে যা-ইচ্ছা-তাই বলার এই দুঃসাহস অনুবাদকরা কোথায় পেল????
পাশাপাশি, হাসানা (حسنا) শব্দটির অর্থ সর্বজনবিদিত। তা হলো: সুন্দর, আকর্ষণীয়, কল্যাণকর, দৃষ্টিনন্দন, উত্তম, উত্কৃষ্ট, যথাযথ ইত্যাদি।
এ অবস্থায় করদে হাসানা কথাটির যুত্সই অনুবাদ হতে পারে- উত্তম/উৎকৃষ্ট কিছু, উত্তম ভালো কিছু ইত্যাদি।
অর্থাৎ, বক্তব্যের বিষয়বস্তু অনুযায়ী- কোন জাতীয় উত্তম/উৎকৃষ্ট বিষয়ের অংশ নির্দেশ করা হচ্ছে তা বোঝা যাবে।
তাহলে চলুন এই ধারণা যাচাই করতে মহান আল্লাহর মহাগ্রন্থে দেওয়া বক্তব্যগুলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
২. কুর’আনিক যাচাই
মহাগ্রন্থে করদে হাসানা (قَرْضًا حَسَنًا) বাক্যাংশটি পাওয়া যায় ৬বার।
২:২৪৫, ৫:১২, ৫৭:১১, ১৮; ৬৪:১৭, ৭৩:২০
মহাগ্রন্থের শুরুতেই করদে হাসানা বাক্যাংশটি রয়েছে ২নং সুরার ২৪৫নং আয়াতে। তার আগের ২৪৩, ২৪৪নং আয়াত পড়লে বোঝা যায়, এখানে ‘ক্বতিলু ফি সাবিলিল্লাহ (وَقَـٰتِلُوا۟ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ)’র কথা বলা হয়েছে। আর এই ক্বতিলু ফি সাবিলিল্লাহ’র কাজকেই ২৪৫ আয়াতে এসে ‘করদে হাসানা (قَرْضًا حَسَنًا)’ বলা হচ্ছে। এরপর ২৪৬ আয়াতে ‘ক্বতিলু ফি সাবিলিল্লাহ (وَقَـٰتِلُوا۟ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ)’র বিষয়ে একটি অতীত উদাহরণও তুলে ধরা হয়েছে।
(وَقَـٰتِلُوا۟ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌۭ ٢٤٤)
- ২:২৪৪ আর তোমরা আল্লাহর পথে লড়াই-সংগ্রাম-চেষ্টা করো এবং জেনো যে আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা
- ২:২৪৫ (مَّن ذَا ٱلَّذِى يُقْرِضُ ٱللَّهَ قَرْضًا حَسَنًۭا) আর কে আছে- ‘কিছু অগ্রিম দেবে আল্লাহকে’ ‘উত্তম কিছু/অংশ’ (فَيُضٰعِفَهٗ لَهٗٓ اَضْعَافًا كَثِيْرَةً ۗ) অতঃপর আল্লাহ তার জন্য বহুগুণে বাড়িয়ে দেবেন; (وَاللّٰهُ يَقْبِضُ وَيَبْصُۣطُۖ وَاِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ ( البقرة: ٢٤٥) এবং আল্লাহই সংকুচিত করেন প্রসারিত করেন আর তাঁর দিকেই তোমরা ফিরে যাবে।
- ২:২৪৬ তুমি কি মুসার পরবর্তী বানী ইসরাঈলের প্রধানদের প্রতি লক্ষ্য করনি? তারা তাদের নবীকে বলেছিল, ‘আমাদের জন্য একজন বাদশাহ ঠিক করুন, যাতে আমরা আল্লাহর পথে লড়াই-সংগ্রাম-চেষ্টা করি’ (نُّقَاتِلْ فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ ۗ)। নির্দেশ হল, ‘এমন সম্ভাবনা আছে কি যে, যদি তোমাদের প্রতি ক্বিতাল কুতিবা হয় তবে তোমরা ক্বিতাল করবে না’ (كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ اَلَّا تُقَاتِلُوْا)? তারা বলল, ‘আমরা কী ওজরে আল্লাহর পথে ক্বিতাল করব না (نُقَاتِلَ فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ), যখন আমরা আমাদের গৃহ ও সন্তানাদি হতে বহিস্কৃত হয়েছি’। অতঃপর যখন তাদের ওপর যখন ক্বিতাল কুতিবা হল (كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقِتَالُ), তখন তাদের অল্প কিছু ছাড়া সবাই ফিরে দাঁড়াল এবং আল্লাহ যালিমদেরকে খুব ভালভাবেই জানেন। [তাইসীরুল কুরআন]
অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে ‘ক্বতিলু ফি সাবিলিল্লাহ (وَقَـٰتِلُوا۟ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ)’ সংক্রান্ত বিষয়ের কাজই হলো করদে হাসানা। সঙ্গত কারণে ধারণা করা যায়, বাকি ৫টি আয়াতের করদে হাসানা’র বিষয়বস্তুতে একই ধরণের বক্তব্য পাওয়া যাবে।
- প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো- ‘ক্বতিলু ফি সাবিলিল্লাহ (قَـٰتِلُوا۟ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ)’ কি?
২:২৪৬ আয়াতেই সে জবাব উদাহরণসহ দেওয়া আছে। তা হলো- ‘ক্বতিলু ফি সাবিলিল্লাহ (قَـٰتِلُوا۟ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ) বা প্রচলিত অনুবাদ অনুযায়ী আল্লাহর পথে লড়াই/সংগ্রাম/যুদ্ধ হলো- যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের যুদ্ধ-সংগ্রাম। অর্থাৎ, ন্যায়ের পথে সংগ্রাম হলো ‘ক্বতিলু ফি সাবিলিল্লাহ’। যেমন, কাউকে অন্যায়ভাবে/জোরপূর্বক বসতবাড়ি-জন্মস্থান থেকে উচ্ছেদ বা গৃহহীন করা হলে ভিটা-মাটি পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করা হলো ‘ক্বতিলু ফি সাবিলিল্লাহ’। অর্থাৎ, যে কোনো ন্যায়সঙ্গত বিষয়ের পক্ষে চেষ্টা-সাধনা-সংগ্রাম হলো ‘ক্বতিলু ফি সাবিলিল্লাহ’। যে কোনো ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষই ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ক্বিতাল’ করতে পারে। আর এই ‘ক্বতিলু ফি সাবিলিল্লাহ’র চেতনা মানুষকে ‘কুতিবা’ করা হয়েছে। অর্থাৎ, ন্যায়ের পক্ষে লড়াই বা ‘ক্বতিলু ফি সাবিলিল্লাহর’ চিন্তা-চেতনা-ধারণার বিষয়ে মানুষকে জোর তাড়না-প্রেরণা-উৎসাহ (কুতিবা) করা হয়েছে।
মহান আল্লাহই তো সব ন্যায়পরায়ণতা, সব ন্যায্যতার প্রতীক! তিনিই মহাসত্য আল হক্ব। মহাসত্যের অংশই হলো ন্যায্যতা। তাই, ন্যায্যতার জন্য চেষ্টা-সংগ্রাম-সাধনাই হলো ‘ক্বতিলু ফি সাবিলিল্লাহ (قَـٰتِلُوا۟ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ)।
কুতিবা কি? কুতিবা শব্দটির অর্থ হলো- জোরালো তাড়না-প্রেরণা-উৎসাহ-নির্দেশনা দেওয়া।
এবার
চলুন অন্য আয়াতগুলো দেখা যাক।
৫:১২
আয়াতে আছে করদে হাসানা (اَقْرَضْتُمُ اللّٰهَ قَرْضًا حَسَنًا)। তবে,
এই বিষয়ের বক্তব্য শুরু হয়েছে তার আগের আয়াত থেকে। দেখা যাচ্ছে, মু’মিনদের
ওপর অন্যায়ের হস্ত প্রসারণকারীদেরকে মহান আল্লাহ বাধা দিয়েছেন। কীভাবে? সে জবাব এসেছে
৫:১২তে। মহান আল্লাহ মু’মিন দলের মিছাক্বা
(مِيثَٰقَ)
বা অঙ্গীকার নিলেন এবং অনুগ্রহ করে বনি ইসরাইলের মু’মিনদের
জন্য ১২জন নেতা/নাকিব নিযুক্ত করলেন। তারপর জানিয়ে দিলেন, যদি তারা সালাহ কায়েম
করে ও পবিত্রতা অর্জন করে এবং তারা রসুলদের বিশ্বাস করে ও তাদের সাহায্য করে এবং
তারা আল্লাহকে আকরাদ দেয় (اَقْرَضْتُمُ اللّٰهَ -আকরাদতুমুল্লাহ) করদে
হাসানা (قَرْضًا حَسَنًا)– তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তম পুরুস্কার আছে।
এই
ধারাবাহিকতায় ৫:১৩তে দেখা যায়, বনি ইসরাইলের কিছু সংখ্যক ছাড়া বেশিরভাগই আল্লাহর
সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। এর পরিণতি অবশ্যই খারাপ হয়।
এই
আয়াতগুচ্ছ থেকেও ধারণা করা যায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিয়োগকৃত রসুলদের
সর্বাত্মক সাহায্য করাই ছিল করদে হাসানা (قَرْضًا حَسَنًا)।
৫৭:১১
আয়াতেও আছে ইয়ুকরিদুল্লাহা ক্বরদান হাসানা (يُقْرِضُ اللّٰهَ قَرْضًا حَسَنًا)। যা বোঝার জন্য আগের আয়াত দেখে নিন। ৫৭:১০
বাক্যে আল্লাহর পথে বা ফি সাবিলিল্লাহর জন্য ব্যয় (تُنفِقُوا۟) করতে বলা হয়েছে। এবং তারা শ্রেষ্ঠতর ওইসব
লোকের চেয়ে যারা বিজয়ের আগে বা লড়াই-সংগ্রাম-প্রচেষ্টার (قَٰتَلَ) সময় অর্থ-সম্পদ ব্যয় করেছে (أَنفَقُوا۟) এবং লড়াই-সংগ্রাম-প্রচেষ্টা করেছে (وَقَٰتَلُوا۟)। আর সবাইকে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আল-হুসনা
বা সুনির্দিষ্ট কল্যাণের (وَكُلًّا وَّعَدَ اللّٰهُ الْحُسْنٰى)। তারপর ৫৭:১১
আয়াতে পাওয়া যায় মহান আল্লাহর উদাত্ত আহ্বান।
- কে সে যে আল্লাহকে অগ্রিম কিছু দেবে (ইয়ুকরিদু আল্লাহ) উত্তম অংশ/কিছু (ক্বরদান হাসানা) অতঃপর আল্লাহ তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন তার জন্য (فَيُضٰعِفَهٗ لَهٗ) এবং তার জন্য আছে সম্মানজনক পুরস্কার (وَلَهٗٓ اَجْرٌ كَرِيْمٌ)। (৫৭:১১)
অর্থাৎ,
এখানেও দেখা যায়, ফি সাবিলিল্লাহর জন্য
অর্থ-সম্পদ ব্যয় করেছে (أَنفَقُوا۟)
এবং লড়াই-সংগ্রাম-প্রচেষ্টা করেছে (قَٰتَلُوا۟)। তাহলে ফি সাবিলিল্লাহ কি? যে
পরিস্থিতিতে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করতে হয় এবং লড়াই-সংগ্রাম-প্রচেষ্টা চালাতে হয়, সে
পরিস্থিতিতে ন্যায়, সত্য ও হকের পথ অবলম্বনই হলো ফি
সাবিলিল্লাহ!
একই
সুরার ১৮নং আয়াতে এসে মহান আল্লাহ ফের ঘোষণা করলেন:
- ৫৭:১৮ নিশ্চয়ই সত্য মান্যকারী পুরুষ ও সত্য মান্যকারী নারী (اِنَّ الْمُصَّدِّقِيْنَ وَالْمُصَّدِّقٰتِ) এবং যারা আল্লাহকে অগ্রিম কিছু দেয় উত্তম অংশ/কিছু (وَاَقْرَضُوا اللّٰهَ قَرْضًا حَسَنًا) তাদের জন্য বহুগুণে বাড়ানো হবে (يُّضٰعَفُ لَهُمْ) এবং তাদের জন্য সম্মানজনক পুরস্কার (وَلَهُمْ اَجْرٌ كَرِيْمٌ)।
উল্লেখ্য যে, প্রচলিত অনুবাদে দান করা এবং আল্লাহকে লোন/ঋণ দেওয়া আলাদা করে লেখা হয়েছে। অথচ, প্রচলিত অর্থ অনুযায়ী এই দুটোই তো অর্থ দান…! কী ভয়াবহ জটিলতা তৈরি করা হয়েছে!
- ৬৪:১৬
অতএব আল্লাহর বিষয়ে সজাগ-সচেতন হও (فَاتَّقُوا اللّٰهَ)
তোমরা যতটা পারো (مَا
اسْتَطَعْتُمْ) আর শোনো (وَاسْمَعُوْا)
ও আনুগত্য করো (وَأَطِيعُوا۟) এবং ব্যয় করো/সহজলভ্য
করো (وَأَنفِقُوا۟) উত্তম তোমাদের নিজেদের জন্য (خَيْرًا لِّاَنْفُسِكُمْۗ);
আর যে রক্ষা পেল (وَمَنْ يُّوْقَ) তার নফসের/নিজের সংকীর্ণতার (شُحَّ نَفْسِهٖ) অতঃপর তারাই যারা সফল (فَاُولٰۤىِٕكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ)।
সর্বশেষ
৭৩:২০ আয়াত দেখা যাক। বেশ বড় ও অনেক তথ্যবহুল। প্রবন্ধের স্বার্থে আমরা করদে
হাসানা অংশটুকোতে মনোযোগ দেবো।
- ৭৩:২০
নিশ্চয়ই তোমার রব জানে যে তুমি (اِنَّ رَبَّكَ يَعْلَمُ اَنَّكَ)
রাতের মধ্যে ওঠো/দাঁড়াও/জাগো প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (تَقُوْمُ اَدْنٰى مِنْ ثُلُثَيِ الَّيْلِ)
ও তার অর্ধেক; তার এক-তৃতীয়াংশ (وَنِصْفَهٗ وَثُلُثَهٗ) এবং একদল
তোমার সঙ্গে থাকে (وَطَاۤىِٕفَةٌ
مِّنَ الَّذِيْنَ مَعَكَۗ);
আর আল্লাহই নির্ধারণ করেন রাত ও দিন (وَاللّٰهُ يُقَدِّرُ الَّيْلَ وَالنَّهَارَۗ);
তিনি জানেন তার হিসাব রাখতে পারবে না (عَلِمَ اَنْ لَّنْ تُحْصُوْهُ) অতএব তিনি ফিরলেন/ক্ষমা করলে তোমাদের (فَتَابَ عَلَيْكُمْ), সুতরাং তোমরা পড়ো আল-কুর‘আন থেকে যা/যতটা তোমাদের জন্য সহজ (فَاقْرَءُوْا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْاٰنِۗ);
তিনি জানেন যে তোমাদের মধ্যে কেউ থাকবে অসুস্থ (عَلِمَ اَنْ سَيَكُوْنُ مِنْكُمْ مَّرْضٰىۙ),
এবং অন্য কেউ ভ্রমণ করবে যমিনে (وَاٰخَرُوْنَ يَضْرِبُوْنَ فِى الْاَرْضِ) অনুসন্ধান করবে আল্লাহর অনুগ্রহ/ফাদ্বল (يَبْتَغُوْنَ مِنْ فَضْلِ اللّٰهِ ۙ);
এবং অন্য কেউ (وَاٰخَرُوْنَ) আল্লাহর পথে লড়াই-সংগ্রাম-প্রচেষ্টারত থাকবে (يُقَاتِلُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ);
সুতরাং তোমরা পড়ো তা-থেকে যা/যতটা সহজ হয় (فَاقْرَءُوْا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُۙ);
আর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করো ও পবিত্রতা অর্জন করো (وَاَقِيْمُوا الصَّلٰوةَ وَاٰتُوا الزَّكٰوةَ)
আর আল্লাহকে অগ্রিম কিছু দাও উত্তম অংশ/কিছু (وَاَقْرِضُوا اللّٰهَ قَرْضًا حَسَنًاۗ);
আর যা কল্যাণ/ভালো থেকে তোমরা আগে পাঠাবে তোমাদের নিজেদের জন্য (وَمَا تُقَدِّمُوْا لِاَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَيْرٍ) তা তোমরা পাবে আল্লাহর কাছে (تَجِدُوْهُ عِنْدَ اللّٰهِ) তাই উত্তম (هُوَخَيْرًا) ও অতি উৎকৃষ্ট প্রতিদান ( وَّاَعْظَمَ اَجْرًاۗ);
নিশ্চয়ই আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল অত্যন্ত মেহেরবান (اِنَّ اللّٰهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ)
এখানে
দেখা যায়, রাতে মহান আল-কুর’আন পড়া বা অধ্যয়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাতে জেগে
কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে আল-কুর’আন অধ্যয়ন
কষ্টকর কাজই বটে। আবার, রসুলুল্লাহর সঙ্গে থাকা বিভিন্ন মানুষ দিনের বেলা বিভিন্ন
কাজে ব্যস্ত থাকতো; তাদের মধ্যে ক্বিতাল ফি সাবিলিল্লাহতে জড়িত মানুষও ছিল (يُقَاتِلُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ)। এজন্য অনেকের
জন্যই রাতের আল-কুর’আন অধিবেশনে
“প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (تَقُوْمُ اَدْنٰى مِنْ ثُلُثَيِ الَّيْلِ)
ও তার অর্ধেক; তার এক-তৃতীয়াংশ (وَنِصْفَهٗ وَثُلُثَهٗ) সময়”
যোগ দেওয়া কষ্ট হতো। তাই বলা হচ্ছে, রাতের বেলা আল-কুর’আনের অধিবেশনের সময় “সহনীয়
বা সহজ পর্যায়ে রাখতে। আর এসব কার্যাবলীর মাধ্যমে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে যোগাযোগ
প্রতিষ্ঠা করা ও পবিত্রতা
অর্জন করা যায়; এবং এভাবেই আল্লাহর কাছে আপনার জীবন ও সময় থেকে
অগ্রিম কিছু- উত্তম অংশ পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এটাই সেই- করদে হাসানা। আর যা কিছু কল্যাণ/ভালো থেকে তোমরা আগে পাঠাবে তোমাদের নিজেদের
জন্য (وَمَا تُقَدِّمُوْا لِاَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَيْرٍ)
যা
কিছু উত্তম/উত্কৃষ্ট বিষয়াদি মানুষ করে ও করবে- তাই মহান আল্লাহর কাছে অগ্রিম চলে
যায়। তা তোমরা পাবে আল্লাহর কাছে (تَجِدُوْهُ عِنْدَ اللّٰهِ) তাই উত্তম (هُوَخَيْرًا)
ও অতি উৎকৃষ্ট প্রতিদান (وَّاَعْظَمَ اَجْرًاۗ)।
অবশ্য,
জগতে মন্দ কাজও যারা করে, তাও আগে চলে যায়। তারও প্রতিদান মানুষ পাবে। একেই
মহাগ্রন্থে শাস্তি বলা হয়েছে।
পরিশেষ বলা যায়, প্রচলিত সুদমুক্ত, সময়মুক্ত আর্থিক লোন দেওয়া ভালো কাজ হলেও সেটাকে করদে হাসানার (قَرْضًا حَسَنًا) সংজ্ঞা বলা যায় না। বরং, ন্যায়, ইনসাফ, সাম্য, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে বা ক্বিতাল ফি সাবিলিল্লাহ’র কাজে মানুষকে উৎসাহিত করতেই করদে হাসানার (قَرْضًا حَسَنًا) বিষয়টি উল্লেখ করেছেন মহান রব।
ক্বিতাল ফি সাবিলিল্লাহ’র কাজে মানুষের ব্যয় করা সময়, শ্রম, অর্থ, মেধা, জীবন—সবই মূলত করদে হাসানা (قَرْضًا حَسَنًا)।
প্রথম প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল, ২০২৩