আল-আরশ: কুর’আনিক দৃষ্টিকোণ (২য় পর্ব)
কুর'আন রিসার্চ সেন্টার- কিউ আর সি
প্রথম পর্বে বলা হয়েছিল: সামাওয়াত ওয়াল আরদ বা মহাবিশ্বজগত যে কাঠামো বা পদ্ধতি বা ব্যবস্থার ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে- তাকেই ‘আল-আরশ’ বলা হয়। অর্থাৎ, মহাবিশ্ব বা ইউনিভার্সের বাস্তব অবস্থার যাবতীয় নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ভিত্তি হলো আল-আরশ (The Arash)।
‘আল-আরশ’ ও ‘আরশ’ এই দু’টি শব্দের ব্যবহার দেখা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষেত্রেও।
১২:১০০ আর উচ্চ–মর্যাদা পেলো তার অভিভাবক (اَبَوَيْهِوَرَفَعَ) কাঠামোগত ব্যবস্থায় (عَلَى الْعَرْشِ) আর তার প্রতি বিনীত হয়ে পড়লো (وَخَرُّوْا لَهٗ سُجَّدًاۚ); আর বলল, হে আমার বাবা এটা আগে যা দেখেছি (رُءْيَٰىَ–Vision) তার ব্যাখ্যা- নিঃসন্দেহে আমার রব তা সত্য বানিয়েছেন (جَعَلَهَا رَبِّيْ حَقًّاۗقَدْ); নিঃসন্দেহে তিনি আমাকে অনুগ্রহ করেছেন- তিনি আমাকে কারাগার থেকে বের করেছেন আর শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার পরও তিনি আপনাদেরকে মরু অঞ্চল থেকে বের করে এনেছেন; নিশ্চয়ই আমার রব যা করতে চান তাতে সূক্ষ্ণদর্শী (لَطِيف); তিনি বড়ই বিজ্ঞ, বড়ই প্রজ্ঞাময় (هُوَ الْعَلِيْمُ الْحَكِيْمُ)।
এখানে বলে রাখা যায়, আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতা থেকে বোঝা যায়, আল্লাহর নবী ইউসুফের পরিবার অনেক কষ্টের পর সমৃদ্ধ মিশরে প্রবেশ করে। যেখানে নবী ইউসুফ শক্তিশালী মন্ত্রীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। স্বভাবতই মন্ত্রীর বাবা (যিনি নিজেও একজন নবী!) রাজ্যে উচ্চ মর্যাদা লাভ করলেন। যা ছিল বহু বছর আগে দেখা নবী ইউসুফের ভিশন (رُءْيَٰىَ–Vision)।
প্রচলিত অনুবাদগুলোত রুইয়া শব্দের অর্থ স্বপ্ন লেখা হয়েছে। যা মোটেও সঠিক নয়। যা ঘুমের ঘোরে দেখা হয় তা حُلْم – Hulm হুল্ম।
অন্যদিকে রু’ইয়া (رؤيا) শব্দের অর্থ হলো- vision, revelation, visionary, apocalypse, premonition, Revelation ইত্যাদি।
১১:৭ এবং তিনিই যিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশ ও যমিন ছয় পর্যায়ে আর তাঁর আরশ ছিল/হল পানিতে/ পানির ওপর (the water) যেন তিনি তোমাদের পরীক্ষা করেন তোমাদের মধ্যে কে কাজকর্মে উত্তম (اَحْسَنُ عَمَلً); এবং যদি তুমি বলো তোমরা নিশ্চয়ই উত্থিত হবে মৃত্যুর পর যারা অস্বীকার করেছে তারা অবশ্যই বলবে এটা স্পষ্ট জাদু ছাড়া আর কিছু নয়!
আল্লাহ আকাশ ও যমিন ৬ ধাপে সৃষ্টি করেছেন, ওয়া কানা আরশুহু আলাল মায়ি (عَرْشُهٗ عَلَى الْمَاۤءِوَّكَانَ) আর আগে আরশ ছিল/ আরশ হলো সুনির্দিষ্টভাবে পানির (দ্য ওয়াটার) ওপর….
[মানে, ৬ ধাপে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হবার আগের কাঠামো ছিল পানির ওপর বা পানিতে।]
ক্ষেত্র অনুযায়ী আরবি শব্দ ‘কানা’ (كَانَ) শব্দটি- হয়, হলো, ছিল ইত্যাদি অর্থ প্রকাশ করে। (be, had, used, found, exist, happen)
যেন তিনি পরীক্ষা করেন তোমাদের মধ্যে কর্মে কে উত্তম (لِيَبْلُوَكُمْ اَيُّكُمْ اَحْسَنُ عَمَلً)।
উল্লেখ্য, আল মা (ٱلْمَاءِ)/ পানি (the water) দেখুন ৭:৫০, ১১:৪৩, ১৩:১৪, ২১:৩০ ও ২৫:৫৪ বক্তব্যগুলোতে।
৩৯:৭৫ আর তুমি দেখবে মালাইকাদের (ٱلْمَلَٰٓئِكَةَ) আল-আরশের পাশে ঘিরে থেকে (حَاۤفِّيْنَ مِنْ حَوْلِ) তাদের রবের প্রশংসাসহ ভেসে থাকতে (يُسَبِّحُونَ); এবং তাদের মাঝে বিচার করা হবে (وَقُضِىَ) যথাযথভাবে (بِٱلْحَقِّ) আর বলা হবে সব প্রশংসা বিশ্বজগতের রব আল্লাহর জন্য (الْحَمْدُ
لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ)।
৪০:৭ যারা ধারণ করে (يَحْمِلُونَ) আল-আরশ আর যারা তার চার পাশে (حَوْلَهُۥ) তাদের রবের প্রশংসা-সহ ভাসতে থাকে (يُسَبِّحُونَ) এবং তারা বিশ্বাস করে তাঁকে ও তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদের জন্য যারা বিশ্বাস করে- হে আমাদের রব আপনি দয়া (رَّحْمَةً) ও জ্ঞান দিয়ে (عِلْمًا) ঘিরে রেখেছেন সব কিছু; অতএব ক্ষমা করুন তাদেরকে যারা অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসে (تَابُوا۟) ও অনুসরণ করে আপনার পথ এবং তাদেরকে বাঁচান জাহান্নামের শাস্তি থেকে (عَذَابَ الْجَحِيْ)।
৪০:১৫ সুউচ্চ মর্যাদাসমূহ আল-আরশের অধিপতির- তিনি পাঠান (يُلْقِى) আর-রুহ (لرُّوحَ)- তাঁর নির্দেশাবলী থেকে (أَمْرِهِۦ) তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তার ওপর (عَلٰى
مَنْ يَّشَاۤءُ مِنْ عِبَادِهٖ) যেন সতর্ক করে সেই সমাবেশের সময় সম্পর্কে (لِيُنْذِرَ يَوْمَ التَّلَاقِ)।
৬৯:১৭ আর মালাইকাগণ (وَٱلْمَلَكُ) বিভিন্ন প্রান্তে, আর ধারণ করবে তোমার রবের আরশ (عَرْشَ) তাদের ঊর্ধ্বে অষ্টম পর্যায়ে (يَوْمَىِٕذٍ ثَمٰنِيَة– Over them is an eighth day.)
এ ছাড়া, ৯:১২৯, ২১:২২, ২৭:২৬, ৮১:২০, ৮৫:১৫ তিনি আল- আরশিল আযিমের রব; অধিপতি, মহাসম্মানিত, মহামর্যাদাবান—এমন বক্তব্য পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে ২৩:৮৬ আয়াতে প্রশ্ন করা হয়েছে এবং তার উত্তর পাওয়া গেছে ১১৬নং আয়াতে।
২৩:৮৬ বলো- কে সাত আকাশের (السَّمٰوٰتِ السَّبْعِ) এবং কে সুমহান আল-আরশের (لْعَرْشِ الْعَظِيْمِ) রব?
২৩:১১৬ অতএব মহান-শ্রেষ্ঠ আল্লাহ- প্রকৃত মালিক তিনি (الْمَلِكُ الْحَقُّۚ) ; তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; মর্যাদাবান আল-আরশের রব (رَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيْمِ)।
এ ছাড়া, সুরা নমল (২৭)এর ২৩, ৩৮, ৪১, ৪২ আয়াতে ‘আল-আরশ’ নয়। বরং শুধু ‘আরশ’ শব্দটি এসেছে। যা নারী সম্রাজ্ঞীর মুকুট/ সিংহাসন/ প্রাসাদ/ছাদ—যে কোনো কিছুই হতে পারে। কারণ, আরবি আরশ শব্দটি দিয়ে মানুষ নির্মাণ করতে পারে- এমন বস্তুকে বোঝায়।
এখানে, মনে রাখতে হবে, প্রথমত, আল্লাহর নবী সুলায়মান ওই শাসক রানীর অনুমোতি ছাড়া তার কোনো জিনিস আনবেন—তা হতে পারে না !
দ্বিতীয়ত, একই মূল শব্দ ব্যবহৃত হলেও, মহান রব্বুল আলামিনের সৃষ্টি, কর্ম ও ইজ্জতের সঙ্গে মানুষ-সহ রবের কোনো সৃষ্টিরই কোনো-ধরনের তুলনা চলে না! তাই, মানুষের ‘আরশ’ আর মহান রবের ‘আল-আরশ’ তুলনীয় কোনো বিষয় না।
নবী সুলায়মানের দূত বলল-
২৭:২৩ নিশ্চয়ই আমি পেয়েছি (وَجَدتُّ) এক নারীকে তাদের শাসন করে (تَمْلِكُهُمْ) আর তাকে দেওয়া হয়েছে সবকিছু (اُوْتِيَتْ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ) এবং তার জন্য বিশাল/দুর্দান্ত মুকুট/সিংহাসন (عَرْشٌ عَظِيْمٌ)।
নবী সুলায়মান বললেন-
২৭:৩৮ বললেন, হে সভাসদবৃন্দ (ٱلْمَلَؤُا۟) তোমাদের মধ্যে কে আমার কাছে আনবে (يَأْتِينِى) তার মুকুট/ সিংহাসন থেকে (بِعَرْشِهَا বি-আরশি-হা) আমার কাছে আত্মসমর্পণকারী (مُسْلِمِينَ) হয়ে আসার আগে।
নবী সুলায়মান বললেন-
২৭:৪১ বললো, বদলে দাও (نَكِّرُوا۟) তার জন্য তার মুকুট/সিংহাসন (عَرْشَهَا) আমরা দেখবো সে পথ পেলো/ বুঝলো কিনা (أَتَهْتَدِىٓ) অথবা যে পথ দেখে না (مِنَ الَّذِيْنَ لَا يَهْتَدُوْنَ) সে তাদের একজন।
২৭:৪২ অতঃপর যখন সে আসলো বলা হলো এমনই কি তোমার মুকুট/সিংহাসন (اَهٰكَذَا عَرْشُكِ)? সে বলল, এ যেন সেটাই (كَاَنَّهٗ هُوَ), এবং এর আগেই আমাদের দেওয়া হয়েছে জ্ঞান/তথ্য আর আমরা আত্মসমর্পণ করেছিলাম (وَكُنَّا مُسْلِمِيْنَ)।
সুরা নমল এর আয়াতগুলোর ধারাবাহিক অনুবাদ থেকে বোঝা যায়, রানীর/নারী শাসকের আরশ যা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল- সেই বস্তুই বিপুল পরিমাণ সংগ্রহ করে আনে জিন। তা দিয়ে নবী সুলায়মানের প্রাসাদের স্ফটিক-স্বচ্ছ মেঝে তৈরি করা হয়। যাকে ‘টলটলে পরিষ্কার পানি’ মনে করে অতিথি রানী।
অর্থাৎ, রানীর আরশের (মুকুট বা সিংহাসনের) আকর্ষণীয় উপাদান বা বৈশিষ্ট্য ছিল স্ফটিক স্বচ্ছ পদার্থ। হতে পারে- বৃহদাকার সাদা-স্বচ্ছ হীরা, পান্না জাতীয় মহা মূল্যবান পাথর। যেহেতু, বলা হচ্ছে ওই রানীকে যেন পৃথিবীর ‘সব কিছুই দেওয়া হয়েছিল’ (اُوْتِيَتْ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ) !
প্রথম প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
সালামুন আলাইকুম ভাই আপনাদের সহযোগিতার আলহামদুলিল্লাহ ভালো কিছু জানতে পারি।
আপনাদের লেখা বাংলা ভাষায় কোরআনের অর্থ করা হয়েছে কি?
সালাম আলাইকুম। কুর’আন অনুবাদের কাজ ধীরগতিতে চলছে। এই পোর্টালে নজর রাখবেন। এখানেই লিংক প্রকাশ করা হবে। ধন্যবাদ…