মুত্তাকি কে, কারা (২য় পর্ব)
কুর'আন রিসার্চ সেন্টার- কিউ আর সি
যেসব মানুষ সবসময় সজাগ-সচেতন থাকে, যাচাই-বাছাই-পর্যবেক্ষণ না-করে কোনো কিছু গ্রহণ বা বর্জন করে না, জীবন-জগৎ-সংসারে সজাগ-সতর্কতার বোধ নিয়ে পথ চলে, তিনিই মুত্তাকি (متقي)। মহান রবের আল-কিতাব থেকে তিনি খুব সহজেই পথনির্দেশনা পেয়ে যাবেন।
পাশাপাশি, যখন বলা হয় ‘তাকওয়া আল্লাহ’ (تقوى الله)…
অর্থাৎ আল্লাহর বিষয়ে তাকওয়া.. তখন আল্লাহর বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক হওয়া বা সচেতন থাকার চেষ্টা করতেই বলা হয়েছে। স্রষ্টা-সচেতন হওয়াই ইত্তাকুল্লাহ (وَاتَّقُوا اللّٰهَ) ২:১৮৯, ১৯৪, ২০৩, ২০৬।
এবার দেখা যাক- যেখানে ‘ইত্তাকু’ ও ‘খওফ’ শব্দদ্বয় একসঙ্গে আছে। অর্থাৎ, সতর্কতা-সচেতনতা ও ভয় একসঙ্গে আছে।
এই আয়াতটি ইত্তাকু ও খওফ-কে আলাদা করে দেয়। কারণ, কিতাবে একই অর্থ প্রকাশে ভিন্ন দুটি শব্দ কখনও ব্যবহার করা হয়নি। প্রতিটি শব্দ, অক্ষর, চিহ্নের সুস্পষ্ট আলাদা অর্থ রয়েছে। অর্থাৎ, মহাগ্রন্থে কোনো প্রতিশব্দ বা synonym নাই।
অর্থাৎ, সুস্পষ্টভাবে ‘খওফ’ অর্থ ভয়। তাহলে কোনোভাবেই ইত্তাক অর্থ ‘ভয়’ হতে পারবে না। আল্লাহর শব্দভাণ্ডারের অভাব পড়েনি নিশ্চয়ই।
৭:৩৫ হে আদমের বংশধর! তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্যে থেকে যখন রসুলগণ আসে- যারা তোমাদের কাছে আমার আয়াত/নিদর্শনগুলো ব্যাখ্যা করে (يَقُصُّونَ), তখন যারা সজাগ-সতর্ক-সচেতন হবে (فَمَنِ اتَّقٰى) করে আর সংস্কার-সংশোধন করবে (وَأَصْلَحَ); অতঃপর তাদের জন্য কোন ভয় নেই (فَلَا خَوْفٌ), তারা দুঃখিত/চিন্তিত হবে না (وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ)।
ভয়/আশঙ্কা/দুশ্চিন্তা বা ‘খওফ’ সংক্রান্ত আরো আয়াত: ২:৩৮, ৬২, ১১২, ১৫৫, ২৬২, ২৭৪, ২৭৭; ৩:১৭০; ৪:৮৩, ৫:৬৯, ৬:৪৮, ৭:৩৫, ৪৯, ৫৬; ১০:৬২, ৮৩; ১৩:১২, ১৬:১১২, ২৪:৫৫, ৩০:২৪, ৩২:১৬, ৩৩:১৯, ৪৩:৬৮, ৪৬:১৩, ১০৬:৪
এসব আয়াতের কোথাও আছে- বিদ্যুৎচমকের ভয়, ক্ষুধার কষ্টে পড়ার ভয়, দুর্যোগের ভয়…; যা মূলত দুঃখ-কষ্ট-আশঙ্কার ভয়।
পাশাপাশি, যারা সজাগ-সচেতন মানুষ (মুত্তাকি), তারা দুনিয়ার জীবনের এহেন সংকট ও শঙ্কা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে পারেন। আর যারা একই সঙ্গে সজাগ-সচেতন (মুত্তাকি) এবং মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী (আমানু-মু’মিন) তারা দুনিয়ার জীবন এবং আল-আখিরাতের কঠিন বিপদ-ভয়-আশঙ্কা থেকে রক্ষা পেতে পারেন।
আর তার পরিণাম হিসেবে সজাগ-সচেতন মানুষগুলো (الْمُتَّقِيْنَ) পাবে অফুরন্ত পুরস্কার- যা মহান আল্লাহর অফুরান দয়ার অংশমাত্র।
যেমন-
নিশ্চয়ই সজাগ-সচেতন মানুষগুলো (الْمُتَّقِيْنَ) থাকবে উদ্যান ও নির্ঝরিনীর মধ্যে (اِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِيْ جَنّٰتٍ وَّعُيُوْنٍ) ১৫:৪৫
নিশ্চয়ই সজাগ সচেতন মানুষগুলো (الْمُتَّقِيْنَ) প্রাচুর্যের উদ্যানে (جَنّٰتٍ وَّنَعِيْمٍ)। (৫২:১৭)
اِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِيْ جَنّٰتٍ وَّنَعِيْمٍۙ ( الطور: ١٧ )
সেসময় (يَوْمَ) সজাগ-সচেতন মানুষগুলোকে সমবেত করবো আর-রহমানের কাছে প্রতিনিধি-স্বরূপ (وَفْدًا —delegations)। ১৯:৮৫
এই হলো যিকর-উপদেশ (هٰذَا ذِكْرٌ); আর নিশ্চয়ই সজাগ-সচেতন মানুষদের জন্য (لِلْمُتَّقِيْنَ) সুনিশ্চিত উৎকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল (لَحُسْنَ مَاٰبٍ)। ৩৮:৪৯
নিশ্চয়ই সজাগ-সচেতনরা (الْمُتَّقِيْنَ) নিরাপদ স্থানে (مَقَامٍ اَمِيْنٍ)। ৪৪:৫১
[اِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِيْ مَقَامٍ اَمِيْنٍۙ ( الدخان: ٥١ )]
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ‘তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার সতর্ক-সচেতন মানুষ’ মানুষ কিন্তু অবিশ্বাসী বা স্রষ্টার বিষয়ে (স্বেচ্ছায়) অসচেতন বা অস্বীকারকারীও হতে পারে।
যেমন, বর্তমান বিশ্বের চরমপন্থি ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগুলোর প্রধান যারা, সেসব শাসকগোষ্ঠীর লোকজন খুব ভালো করেই জানে যে, কীভাবে মানুষের ওপর শোষণ বঞ্চনা চালাতে হয়। যেমন ধরুন, উত্তর কোরিয়া, চীন, ইরান এমনসব দেশের শাসকগোষ্ঠী শত বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মানুষকে বুদ্ধি, শক্তি, মেধা, অর্থ, অস্ত্র দিয়ে অন্ধ বানিয়ে রেখেছে। তারা কি নিরেট বোকা টাইপের মানুষ হতে পারে? অবশ্যই না। বরং, তারা প্রচণ্ড চতুর, কৌশলী, জাগতিক শিক্ষায় উন্নীত বুদ্ধিমান মানুষ। রাজনীতি, শাসননীতি ও সংশ্লিষ্ট খাতে তারা ‘তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাসম্পন্ন সচেতন মানুষের’ কাতারেই পড়েন। তাহলে তারাও কি মুত্তাকী হয়ে যায় না? তারাও কি মুত্তাকি হওয়ার জন্য মহান রবের কাছে ‘মাগফিরাত ওয়া জান্নাত’ পেয়ে যাবে?
সাধারণ বিচারবোধ বলে, তেমনটি হবার কথা নয়। অথবা, মুত্তাকি সনাক্তকরণে কোথাও ভুল হয়েছে।
আসলে, মুত্তাকি’র সংজ্ঞা ঠিকই আছে। তবে, জান্নাত ও মাগফিরাত লাভের শর্তে খেয়াল না-করার কারণে। আর তা হলো, মুত্তাকি ব্যক্তিকে মহান স্রষ্টার বিষয়ে ঈমান বা বিশ্বাস আনতে হবে। আর সত্য সঠিক বিশ্বাসের ভিত্তিতেই মুত্তাকি মানুষ জুলুম-নির্যাতন-অন্যায়ের পথ থেকে ফিরে আসবে।
২:১০৩ আর যদি তারা বিশ্বাস করতো (اٰمَنُوْا) এবং সজাগ-সচেতন হতো (وَاتَّقَوْا) আল্লাহর নিকট থেকে সুনিশ্চিত কল্যাণকর (خَيْرٌ) পুরস্কার পেত।
০৫:০৮ ওহে যারা ঈমান এনেছো (يٰٓاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا)! আল্লাহর জন্য ন্যায্যভাবে (بِالْقِسْطِ) সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকো (قَوَّامِيْنَ لِلّٰهِ شُهَدَاۤءَ); আর বিদ্বেষ তোমাদের প্ররোচিত না করে (وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ) কোন জাতি/গোষ্ঠী/ সম্প্রদায়ের প্রতি (قَوْمٍ عَلٰٓى) যাতে তোমরা সুবিচার না করো (اَلَّا تَعْدِلُوْا); তোমরা সুবিচার কর (اِعْدِلُوْاۗ هُوَ)- তা সচেতনতার নিকটতর (اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰىۖ); আর আল্লাহ-সচেতন হও (وَاتَّقُوا اللّٰهَ); নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালোভাবেই অবহিত- তোমরা যা করো।
০৫:১১ ওহে যারা ঈমান এনেছো ( اٰمَنُوا)! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর (اذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللّٰهِ) যখন এক সম্প্রদায় তোমাদের দিকে হাত বাড়াতে চেয়েছিল তখন তিনি তাদের হাত তোমাদের থেকে নিবৃত্ত করেছিলেন; আর তোমরা আল্লাহ সচেতন হও (وَاتَّقُوا اللّٰهَ); আল্লাহর উপরেই মুমিনদের নির্ভর করা উচিত (وَعَلَى اللّٰهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ)।
০৫:৫৭ ওহে যারা ঈমান এনেছো (يٰٓاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا)! গ্রহণ করো না- যারা তোমাদের দীন/জীবনব্যবস্থা-কে তামাশা ও খেলার বিষয় রূপে ( هُزُوًا وَّلَعِبًا) গ্রহণ করে- যাদেরকে তোমাদের পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে থেকে ও কাফেরদেরকে অভিভাবক-রূপে (أَوْلِيَآءَۚ); আর আল্লাহ সচেতন হও (وَاتَّقُوا اللّٰ) যদি তোমরা বিশ্বাসী (مُّؤْمِنِينَ) হও।
৫:৬৫ আর যদি আল-কিতাবের অধিকারীরা বিশ্বাস করতো ও সজাগ-সচেতন হতো (اٰمَنُوْا وَاتَّقَوْ) অবশ্যই মুছে দিতাম (لَكَفَّرْنَا) তাদের থেকে তাদের দোষগুলো এবং আমি তাদের প্রবেশ করাতাম সেই সমৃদ্ধির উদ্যানে (جَنّٰتِ النَّعِيْمِ)।
৭:৯৬ জনপদের অধিবাসীরা যদি বিশ্বাস করতো ও সজাগ-সচেতন হতো (اٰمَنُوْا وَاتَّقَوْا) তাহলে আমি তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দ্বারসমূহ (بَرَكٰتٍ مِّنَ السَّمَاۤءِ وَالْاَرْضِ) খুলে দিতাম, কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, অতঃপর তাদেরকে পাকড়াও করলাম তাদের কৃতকর্মের কারণে।
১২:৫৭ তাদের জন্য সেই পরজীবনের (الْاٰخِرَةِ ) পুরস্কারই উত্তম- যারা বিশ্বাস করে (لِّلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا) এবং তারা সজাগ-সচেতন থাকে (وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ)।
১৬:৩০ আর যারা সজাগ-সচেতন ছিল তাদেরকে বলা হবে তোমাদের রব কি নাযিল করেছিলেন? তারা বলবে- কল্যাণ; যারা এই দুনিয়ায় ভালো করবে তাদের জন্য ভালোই আর আখিরাতের বাসস্থান কল্যাণময়; আর সজাগ-সচেতন মানুষের আবাস সুনিশ্চিত চমৎকার।
৪৯:১ ওহে যারা বিশ্বাস করো (ءَامَنُوا۟)! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সামনে অগ্রগামী হয়ো না আর আল্লাহ সচেতন হও (وَاتَّقُوا اللّٰهَ ); নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞানী (سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ )।
৪৭:৩৬ নিশ্চয়ই দুনিয়ার জীবন (الْحَيٰوةُ الدُّنْيَا) খেলা ও অর্থহীন আনন্দের (لَعِبٌ وَّلَهْوٌ); আর যদি তোমরা বিশ্বাস করো ও সজাগ-সচেতন হও (تُؤْمِنُوْا وَتَتَّقُوْا), তিনি তোমাদের পুরস্কার দেবেন (يُؤْتِكُمْ اُجُوْرَكُمْ), আর তিনি তোমাদের সম্পদ চান না (وَلَا يَسْـَٔلْكُمْ اَمْوَالَكُمْ)।
প্রচলিত একাধিক অভিধান থেকেও দেখা যায়,
পরিশেষে-
৬:৩২ এই দুনিয়ার জীবন (الْحَيٰوةُ الدُّنْيَآ) শুধুমাত্র খেলা ও অর্থহীন আনন্দের (اِلَّا لَعِبٌ وَّلَهْوٌ) এবং পরজীবনের সেই বাসস্থান উৎকৃষ্ট- তাদের জন্য যারা সজাগ-সতর্ক-সচেতন (لِّلَّذِيْنَ يَتَّقُوْنَ); তাহলে কি যুক্তি-বোধ খাটাবে না (اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ)?
৩:১৩৮ এটা বর্ণনা (بَيَانٌ) মানবজাতির জন্য (لِّلنَّاسِ) এবং দিক-নির্দেশনা ও বিশেষ উপদেশ (মাওইজাতুন- مَوْعِظَةٌ) সজাগ-সচেতনদের জন্য (لِّلْمُتَّقِيْنَ)।
৬:১৫৫ আর এই গ্রন্থ (وَهٰذَا كِتٰبٌ) আমি তা নাযিল করেছি (اَنْزَلْنٰهُ) কল্যাণময় (مُبٰرَكٌ); অতএব তারই অনুসরণ করো (فَٱتَّبِعُوهُ) এবং সজাগ-সচেতন হও, যাতে তোমরা দয়া লাভ করো (لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ)।
প্রথম প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
অনলাইন অভিধান সূত্র:
তাকওয়া:
https://context.reverso.net/translation/arabic-english/%D8%AA%D9%82%D9%88%D9%89?d=0
তাকি: ক্রিয়াপদ/ সচেতন থাকা
https://context.reverso.net/translation/arabic-english/%D8%AA%D9%82%D9%89?d=0
ইত্তাকি:
https://context.reverso.net/translation/arabic-english/%D8%A7%D8%AA%D9%82%D9%89?d=0