মানুষের গন্তব্য

মানুষের গন্তব্য

১.
পৃথিবীতে একটি মানুষের জীবন ‘জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত’ সীমাবদ্ধ। প্রতিটি মানুষ এই শৃঙ্খলে আবদ্ধ। কিন্তু সব মানুষ পৃথিবীতে এক ধরণের উন্নতি পায় না। পৃথিবীতে মানুষের উন্নতি প্রধানত ২টি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, অর্থ-সম্পদ-ক্ষমতা-শক্তি বা বস্তুগত উপাদানের ভিত্তিতে। দ্বিতীয়ত, চারিত্রিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘মহত্ মানুষ’ বা ‘উন্নত মানুষ’ বলে আমরা যাদের চিহ্নিত করি- তারা অর্থ-সম্পদ-ক্ষমতা-শক্তি থেকে বহু দূরে থাকেন। এ জাতীয় মানুষের মহত্ব বা উন্নতির পেছনে থাকে প্রজ্ঞা ও চারিত্রিক শক্তি। তারা সমাজের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ, কৃষিজীবী বা সাধু-সন্ন্যাসীও হতে পারেন। 

অন্যদিকে, যারা বিপুল ধনী ও প্রভাবশালী মানুষ- তাদের রয়েছে অর্থ-সম্পদ-ক্ষমতা-শক্তি বা বস্তুগত উপাদানের জ্ঞান ও প্রাচুর্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা প্রজ্ঞা ও উন্নত চারিত্রিক শক্তি থেকে বহু দূরে থাকেন।

পাশাপাশি, খুব কম মানুষের মধ্যেই এই দুই ধরনের উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটে। অর্থাৎ, খুব কম মানুষই “ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী এবং উন্নত চরিত্রের মহান মানুষ” হয়।  
এই দুই/তিন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ নির্ধারণ করা লক্ষ্য নয়। বরং, এই পার্থক্য বা বৈশিষ্ট্যের অন্তর্নিহিত বিষয়টি উন্মোচন করাই উদ্দেশ্য।

এই দুই-তিন ধরণ অথবা সব ধরণের মানুষের দৈহিক গঠন, চাহিদা ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। একই উপাদান দিয়েই দেহ-কাঠামো তৈরি। জ্ঞানবুদ্ধি হবার আগ্ পর্যন্ত ধনীর দুলাল, গরীবের ধুলোমাখা শিশু কিংবা ভবিষ্যতে উন্নত চরিত্রের মানুষ হবে- এমন শিশুর মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকে না। তারা বড় হয়ে মৃত্যুবরণ করে- দেহযন্ত্রে কোনও পার্থক্য দেখা যায় না। এমনকি একই বয়সে বড় বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিং; কবি সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হাফিজ, রুমি এবং বাঙ্গালি এক রিকশাওয়ালার দৈহিক গঠনগত দিকে কোনও পার্থক্য আছে কি? কিংবা আপনার আমার দেহগত গঠনে আসলে কোনও পার্থক্য আছে কি?

-নেই। মূলত কোনও পার্থক্য নেই। 
তাহলে, পার্থক্য হয় কোথায় ও কীসে?

কোন জিনিসটি একজনেক প্রজ্ঞাবান, একজনকে বুদ্ধিমান, একজনকে ধনবান ও প্রভাবশালী আর অন্যজনকে চারিত্রিক শক্তিশালী বানাচ্ছে? সবারই তো একই ওজনের ও একই ক্ষমতার মস্তিষ্ক রয়েছে। মানুষ নিজের মতো করে মস্তিষ্কের ব্যবহারও করছে। কিন্তু, দিনশেষে কেউ একরকম হয় না। এমনকি, দুজন যমজ ভাই-বোনও একরকম চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষার মানুষ হয় না।

আরও সূক্ষ্মভাবে দেখা যাক। দু’জন মানুষকে একই সঙ্গে তীব্রভাবে অপমান করা হচ্ছে। তাদের একজন ২ মিনিটের মাথায় প্রচণ্ড অপমানে রেগে গেলেন। আরেকজন পাথরের মত ঠাণ্ডা থাকলেন, কোনও প্রতিক্রিয়া দেখালেন না।
এই দু’জনের মধ্যে দ্বিতীয়জনের ধৈর্য্যশক্তি, সহ্যক্ষমতা ও বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা বেশি বলেই ধরা যায়।

কোন জিনিসটি এই দু’জনের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করলো? তাদের দেহগত বৈশিষ্ট্য নয়। বরং, তাদের দেহের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আত্মা-নসফ-Soul.

শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গবেষণার মাধ্যমে মানুষ তার আত্মাকে বা আত্মশক্তিকে উন্নত করে। আমরা বলি চারিত্রিক উন্নতি, ধৈর্য, প্রজ্ঞার শক্তি। এই কাজে মানুষ তার চোখ-কান-নাক-মুখ ব্যবহার করার মতো মস্তিষ্ক শক্তিও ব্যবহার করে। অনেকেই ভাবেন- এতে মস্তিষ্ক উন্নত হয়। আসলে তা নয়। জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক উন্নত; পার্থক্য শুধু তা ব্যবহারে। অনেক তথ্য জমা করলে কম্পিউটারের স্টোরেজ বা ডেটা ব্যাংক উন্নত হয়; অনেক বই জমা করলে গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ হয়। আর, অনেক তথ্য মুখস্থ করলে মস্তিষ্কে সেসব তথ্য জমা হয়। কিন্তু, সেসব তথ্য প্রক্রিয়া ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে জীবন-জগতে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে, তখন তাকে উন্নত মানুষ, জ্ঞানী মানুষ বলা হয়। তথ্য রূপান্তরিত হয় জ্ঞানে। আর যথাযথ জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয় মানুষের আত্মা বা নফস। সেই জ্ঞান বা প্রজ্ঞায় শিক্ষিত হয় মানবদেহ না, বরং মানবাত্মা।

একইভাবে যে মানুষটি ধন-সম্পদ উপার্জনে তার চিন্তা-জ্ঞান-গবেষণা ব্যবহার করে, অর্থাত্ মস্তিষ্কের শক্তি ব্যবহার করে, সে ধীরে ধীরে অর্থ-সম্পদ-ক্ষমতা-শক্তি বা বস্তুগত উপাদানের প্রাচুর্য লাভ করে।

এভাবে, জিরো থেকে হিরো হওয়া ধনবান মানুষটির ঘরে যে সন্তান জন্ম নেয়, সে বিত্তশালী জীবনের সুখ-সম্ভোগ উপভোগ করে। কিন্তু, তার মন-মগজ-আত্মা-নফস তার বাবার মতো জীবনের নানা রকম ঝুঁকি-ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করে বেড়ে ওঠা মানবাত্মা বা নফস হতে পারে না। তবে, সে চাইলে অন্য পথ বাছাই করতে পারে। মহামতি গৌতম বুদ্ধ রাজদরবার ছেড়ে সাধু-সন্ন্যাসীর কঠিন জীবন বেছে নেন। তার শারীরিক অবনতি হয়েছিল বৈকি; তবে, কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁর উন্নতি হয়েছিল আত্মা বা নফসের বা মনুষ্যত্বের।

অর্থাৎ, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে- যে কোনও পরিস্থিতিতে, যে কোনও মানুষ জন্মগ্রহণ করুক না কেন; সে মূলত তার পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। একইরকম দৈহিক বিকাশের পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় পদ্ধতিতে বিকশিত ও সমৃদ্ধ হতে থাকে ‘আত্মা’ বা ‘নফস’। এখানেই তৈরি হয় মানুষে মানুষে মূল পার্থক্য ও সুনির্দিষ্ট প্রকৃত পরিচয়।

ধনী-গরীব, লম্বা-খাটো, সাদা-কালো, আফ্রিকান-আমেরিকান যাই হোক না কেন, তাদের চিন্তা-ভাবনা-মানসিকতা কাছাকাছি হলেই- তারা পরিণত হয় ‘জানের দোস্ত’, স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদিতে। দৈহিক বৈশিষ্ট্য নয়, বরং ‘আত্মিক’ বৈশিষ্ট্যই তার মৌলিক কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে মূলত ‘আত্মার টান’ বা ‘নফসের গঠন’ প্রকৃত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। প্রজ্ঞাবান লোকজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হয়- তার চোখের শক্তি না থাকলেও। আবার বিলিওনিয়ার তার সম্পদকে বহুগুণে বৃদ্ধি করার জন্য নতুন বিনিয়োগ প্ল্যান নিয়ে এগিয়ে যায়। সবাই তাদের মস্তিষ্ক-শক্তি কাজে লাগায়- এটা ‘দৈহিক সাধারণ’ বিষয়। কিন্তু, এর মধ্য দিয়ে সবার ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ হতে থাকে মনুষ্যত্ব, মানবাত্মা, আত্মা বা নফস।

এটাই মহান স্রষ্টার বেঁধে দেওয়া পদ্ধতি।

২. 
মানুষের নফসের বিকাশ বা সমৃদ্ধির পেছনে কী কী উদ্দেশ্য রয়েছে? এতে মানুষেরই বা কী লাভ। মহান স্রষ্টা কি বিশেষ কোনও পদ্ধতিতে মানুষকে বা মানুষের নফসকে পরিচালিত বা বিকশিত করতে চান? যদি সত্যিই তিনি নফসের বৃদ্ধি বা বিকাশ চেয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি কোনও বিশেষ পথ বা পদ্ধতি জানিয়ে দেবেন—কী সেটা? কোথায় পাওয়া যাবে সেই পদ্ধতি? কেমন সেই পদ্ধতি? সেটাও জানার চেষ্টা করা যেতে পারে।

যেসব মানুষ মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাদের জন্য এই আগ্রহ নিবারণ করা সহজ। কারণ, বিশ্বাসী মানুষ মহাগ্রন্থ আল-কিতাবে সব উত্তর পেয়ে যায়। তবে, যারা কিতাব থেকে দূরে আছে, তারা না-জানলেও স্রষ্টার ‘নফস বিকাশের পদ্ধতি’ থেকে দূরে থাকতে পারবে না। ঘটনা ঘটতেই থাকবে ‘বেঁধে দেওয়া নিয়মে’। নফসের বিকাশের কাজটি অব্যাহতভাবে চলতেই থাকবে।

আবার সব বিশ্বাসী মানুষও এসব জানার ক্ষেত্রে আগ্রহী নয়। জেনেই বা লাভ কি? আল-কুর’আন অনুযায়ী, যে জানবে- সে অন্ধকার থেকে আলোতে আসবে, তার জন্য সঠিক পথের অনুসরণ সহজ হয়ে যাবে এবং সে মূলত পরবর্তী দীর্ঘস্থায়ী জীবনে ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়ে নিজের কল্যাণই নিশ্চিত করবে- মহান প্রভুর অশেষ রহমতে।

তিনিই তাঁর দাসের প্রতি নাযিল করেন সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ যা তোমাদের বের করে আনে অন্ধকাররাশি থেকে আলোতে এবং অবশ্যই আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি পরম করুণাময়, পরম দয়াবান। {৫৭:৯}

তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে সুস্পষ্ট প্রমাণ। সুতরাং যে দেখবে, সে নিজেরই কল্যাণ করবে। আর যে অন্ধত্বের পথ বেছে নেবে সে নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে….{৬:১০৪}

আলিফ লাম রা; এই কিতাব আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে করে তুমি মানবসমাজকে বের করে আনো অন্ধকাররাশি থেকে আলোতে, তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে মহাপরাক্রমশালী সপ্রশংসিত আল্লাহর পথে। {১৪:১}

৩. 
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বিস্তৃত এ বিষয়টিকে সহজে তুলে ধরা হলো। প্রশ্নের উত্তরের রেফারেন্সগুলো কুর’আনের সুরা ও আয়াত নম্বরসহ বিবৃত করা হলো।

১. মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি?

– শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা। ৫১:৫৬

২. মানুষকে কী বানানো হয়েছে?

– আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। ২:৩০

৩. প্রতিনিধি বানানোর উদ্দেশ্য কি?

– পৃথিবীতে মানুষের পরীক্ষা করা ৬:১৬৫, ৩৮:৩৯

৪. ‘সব কিছুই’ আল্লাহর ‘ইবাদত’ করে। তাহলে মানুষের সঙ্গে সবকিছুর পার্থক্য কী?!

– ‘প্রতিনিধি হিসেবে’ মানুষ ভালো-মন্দ বাছাইয়ের স্বাধীনতা লাভ করে; কিন্তু, ‘সব কিছুর’ সেই ‘স্বাধীনতার শক্তি’ নেই; তাই সবকিছুর ‘দায়বদ্ধতা’ নেই। এটাই একমাত্র পার্থক্য বা বৈশিষ্ট্য। ৬:১৬৫ , ৩৫:৩৯

৫. জিন জাতিরও ‘স্বাধীনতার শক্তি’ (ইবাদত) আছে। তারা কি খলিফা বা প্রতিনিধি?

– না। ৩৮:৩৯

৬. তাহলে, জিনদের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য কী ও কীভাবে?

– এই পার্থক্য গঠনগত বৈশিষ্ট্যের। জিনদের বিকাশ হয় না (যেহেতু বলা হয়নি), মানুষের নফসের বিকাশ হয়। এই বিকাশের প্রক্রিয়ায় পৃথিবীতে মানুষের জন্ম-বৃদ্ধি-মৃত্যু হয়; জিনদের জন্ম-বৃদ্ধি-মৃত্যু-বিকাশ-পবিত্রতা অর্জনের বিষয় নেই (যেহেতু বলা হয়নি)। তবে, জিনদের সত্য ও মিথ্যা বাছাইয়ের স্বাধীনতা আছে। তারা এজন্য ফলাফল ভোগ করবে। একই সময় মানুষের (নফসের) জন্ম-বৃদ্ধি-মৃত্যু, আবার জন্ম ও বিকাশ অব্যাহত থাকবে। (বিস্তারিত পড়ুন এখানে)

৭. সঠিক বিকাশ লক্ষ্য হলে, মানুষ কীভাবে একাজে সফল হবে?

– যেসব মানুষ পবিত্রতা অর্জন করবে (تَزَكّٰىۙ তাযাক্কা), তারাই সফল হবে। ৮৭:১৪; ৯১:৯

৮. ‘সফলতা’ অর্থ কি?

– সফলতা অর্থ ‘নফস’ বা ‘আত্মার’ পরিশুদ্ধতা, পবিত্রতা, বিশুদ্ধতা; পৃথিবীতে নফস বা আত্মা মানবদেহের সঙ্গে বিকশিত হয় বা সমৃদ্ধভাবে বেড়ে ওঠে। নির্দিষ্ট সময় পর দেহ অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু, নফস ইন্তেকাল বা স্থানান্তরের মাধ্যমে পরবর্তী গন্তব্যে চলে যায়।

৯. নফসের বিকাশ, সমৃদ্ধি, বৃদ্ধি অর্থ কি?

– মহান আল্লাহ মানুষকে সুগঠিত-সুসজ্জিত করেছেন, তারপর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। পৃথিবীতে নফসের/মানুষের বৃদ্ধির জন্য তাঁর বিশেষ শক্তি বা ‘রুহ’ দিয়েছেন; ১৫:২৯ ৩৮:৭২ ‘রুহ’-এর সহযোগিতায় পৃথিবীর জীবনে মানব-আত্মা বা নফস পূর্ণমাত্রায় সচেতন হয়ে ওঠে এবং দীর্ঘ জীবনে একটি মৌলিক রূপ বা কাঠামো লাভ করে (যা পৃথিবীতে অদৃশ্য কিন্তু অনুভবযোগ্য)। বিভিন্ন কারণে মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে আল্লাহ বিশেষ শক্তি বা ‘রুহ’ নিয়ে যান। আর ফেরেশতাগণ মানুষের ‘নফস’ নিয়ে যায়। দেহ বিলীন হয়ে যায়। আর মহাযাত্রার পরবর্তী রূপান্তরিত পর্যায় শুরু হয় ইল্লিন বা সিজ্জিনে। ৮৩:৭,৮,৯,১৮,১৯,২০

১০. মানুষের কল্যাণে পৃথিবীতে কী কী নিয়ম দিয়েছেন আল্লাহ?

– তিনি মানুষকে সালাত, সিয়াম, সাদাকা, হালাল-হারাম-কবিরা গুনাহ বেছে চলা, ন্যায়বিচার করা, সত্য ও ন্যায্য কথা বলা, উত্তম আচরণ করা, যৌক্তিক চিন্তা-ভাবনা-বিশ্লেষণ করা, পারস্পরিক সহযোগিতা করা, পারিবারিক-সামাজিক বিধান, সিরাতুল মুস্তাকিমে থাকা, ভালো-মন্দ কাজের দৃষ্টিভঙ্গি-সহ নানা নিয়ম-কানুন-উপদেশ দিয়েছেন। তিনি সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে এসব অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন।

১১. সালাতের উদ্দেশ্য কি?

– পবিত্রতা অর্জন করা (أَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ – সালাত কায়েম করো ও পবিত্র হও) ২:৪৩,৮৩,১১০। নিশ্চয়ই সালাত মানুষকে অশ্লীলতা ও মন্দকাজ থেকে দূরে রাখে– অর্থাৎ, মানুষকে (আত্মা বা নফসকে) পবিত্র করে। ২৯:৪৫

১২. সিয়ামের উদ্দেশ্য কি?

– তাকওয়া অর্জন করা (لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ – স্রষ্টা সম্পর্কে সচেতন থাকা/ ভীত হওয়া)। ২:১৮৩

১৩. কবিরা গুনাহ ও হালাল-হারাম-কবিরা গুনাহ বেছে চলা, ন্যায়বিচার করা, সত্য ও ন্যায্য কথা বলা, উত্তম আচরণ, যৌক্তিক চিন্তা-ভাবনা-বিশ্লেষণ করা, পারস্পরিক সহযোগিতা করা, পারিবারিক-সামাজিক বিধান, সিরাতুল মুস্তাকিমে থাকা, ভালো-মন্দ কাজের নিয়মকানুন মানার উদ্দেশ্য কি?

– মানুষের আত্মা বা মানুষের উন্নতি, নফসের উন্নত বিকাশ, শক্তি-সমৃদ্ধি অর্জন করা; যা মূলত মানুষের চিন্তা-ভাবনা-আত্মা-চেতনাকে পরিশুদ্ধতার দিকে এগিয়ে নেয়। যে কোনও ভালো কাজের একটাই উদ্দেশ্য। মানুষকে উন্নত করা।

১৪. আল-কুর‘আন বা মহাগ্রন্থ আল-কিতাবের উদ্দেশ্য কি?

– মানুষের উন্নয়নের জন্য (নফসের উন্নয়ন) সঠিক পথ দেখানো, সুসংবাদ দেওয়া ও সতর্ক করা। ১৭:৯

১৩. যারা বিশ্বাস করে- তাদেরকে আল্লাহ কী করতে চান?

– প্রথমত, পৃথিবীতে তাদেরকে বা তাদের আত্মাকে (নফস) পরিশুদ্ধ করতে চান। ৩:১৪১,১৫৪

১৫. নবী-রসুলের উদ্দেশ্য কি?

– মানুষকে (মানুষের আত্মাকে) পরিশুদ্ধ বা পবিত্র করা (يُزَكِّيهِمْ)। ৩:১৬৪

১৬. নবী-রসুল কীভাবে এই কাজ করেন?

– আল্লাহর কথা-বক্তব্য-আয়াত মানবজাতির কাছে প্রচার করা এবং কিতাব ও হিকমা শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে মানুষকে পরিশুদ্ধ বা পবিত্র (يُزَكِّيهِمْ) করা হয় ৩:১৬৪, ৬২:২। পাশাপাশি, অপরাধ স্বীকারকারী (তওবাকারী) লোকদের সাদাকা গ্রহণ করে তাদেরকে পবিত্র করা হয়। ৯:১০৩

১৭. জান্নাত সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি?

– মানুষ-সংশ্লিষ্ট জান্নাতের একটি উদ্দেশ্য হলো: পৃথিবীর জীবনে যারা সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে- অর্থাত্ ভালো কাজ করবে, সেসব মানুষকে পুরস্কার দেওয়া হবে জান্নাতে। অবশ্যই, যিনি পুরুস্কার দেবেন- অন্তত তাঁর প্রতি শিরকমুক্ত বিশ্বাস থাকতে হবে। ৪১:৩০; ৪৬:১৩,১৪ এবং ৬:৮৮,৮৯; ৩৯:৬৫ (শিরক সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন)

১৮. শিরক এর সমস্যা কী?

 – আল্লাহ বলেছেন তিনি শিরক-এর গুনাহ/ অপরাধ ক্ষমা করবেন না। এ ছাড়া যে কোনও অপরাধ তিনি ক্ষমা করবেন। এটা তাঁর সুস্পষ্ট ঘোষণা, মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। ৪:৪৮

১৯. না-জেনে না-বুঝে “শিরক” করলে সমস্যা আছে কি?

– নবী রসুলদের সতর্ক করা হয়েছিল তাঁরা যেন শিরকের সঙ্গে না -জড়ায় ৩৯:৬৫, ৩৯:৬৫, ৭২:২০। নবী ও রসুলগণ জেনে-বুঝে কখনোই শিরক করতে পারেন না। অর্থাৎ, তাঁদের অজ্ঞাতসারে বা না-বুঝে ভুলবশত ‘শিরক’ হওয়ার বিষয়ে আল্লাহ সতর্ক করে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি, এ তথ্য আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন।

২০. কোন কোন ক্ষেত্রে মানুষের ‘শিরক’ হতে পারে?

  – মহান আল্লাহ মর্যাদা, বৈশিষ্ট্যে কোনও তুলনা করা যাবে না। ১১২; ১৭:১১১

 – মহান আল্লাহর হুকুম/ বিধান/ নিয়ম-কানুনে কোনও হস্তক্ষেপ করা যাবে না। ২:১০৭, ৪৮:১৪, ১১২:৪

  – একনিষ্ঠভাবে মহান আল্লাহর ইবাদত করতে হবে; তাতে কোনও শরিক করা যাবে না। ৫১:৫৬, ৯৮:৫

২১. জাহান্নাম সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি?

 – ক্ষতিকর জিন ও পৃথিবীতে খারাপ কাজে জড়িত মানুষের (নফসের) শাস্তি দেওয়া হবে জাহান্নামে। জাহান্নাম এবং নফসের যাত্রা সম্পর্কে জানলে বোঝা যায়- অপরাধী মানুষের ‘বিকৃত নফস’ পুনর্গঠনের স্থান হলো জাহান্নাম।

২২. ‘বিকৃত নফস’ পুনর্গঠন শেষ হলে জাহান্নামের কী প্রয়োজন?

 – শাস্তি ও ‘বিকৃত নফস পুনর্গঠন’ শেষ হলে জাহান্নামের প্রয়োজনীয়তা নেই। তাই, জাহান্নাম থাকবে না বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ১১:১০৬,১০৭; ৭:৪০

২৩. মানুষের ‘ভুল উদ্দেশ্যে’ কি?

– পার্থিব জীবনকে ‘প্রধান লক্ষ্য’ বানানো সবচেয়ে বড় ভুল ৮৭:১৪। পাশাপাশি, পৃথিবীতে ঝামেলা-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ক্ষতিগ্রস্ত মানবাত্মার কাজ। ২:২৭

২৪. কোনটি প্রধান বিষয়? ‘উদ্দেশ্য’ নাকি ‘উদ্দেশ্য অর্জনের পদ্ধতি’?

– অবশ্যই যে কোনও কাজের ‘উদ্দেশ্য’ হলো প্রধান বিষয়। আর কর্মপদ্ধতি হলো ‘উদ্দেশ্য অর্জনের উপকরণ’। জাগতিক বিষয়ে ক্ষেত্রবিশেষে কর্মপদ্ধতি ও উপকরণ পরিবর্তন করা যায়। কিন্তু, উদ্দেশ্য সুদৃঢ়ভাবে নির্ধারিত। উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হওয়া পথভ্রষ্টতার লক্ষণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *