আল্লাহকে কীভাবে ভয় করা যায়?

আল্লাহকে কীভাবে ভয় করা যায়?

মহাগ্রন্থ আল-কিতাবে মহান রব্বুল আলামিন মানুষের প্রতি বহুবার আশা প্রকাশ করে বলেছেন-  লাআল্লাকুম তাত্তাকুন  لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ। এর প্রচলিত সরল বাংলা অর্থ হলো- আশা করা যায় তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে।

মহাগ্রন্থে মহান রব্বুল আলামিন বার বার বলেছেন- বিশ্বাসীদের মুত্তাকি হতে হবে, আল্লাহকে ভয় করতে হবে। তিনি যুক্তি তুলে ধরে বেশ কয়েকবার প্রশ্ন করেছেন- আফালা তাত্তাকুন? will you not fear Him? তোমরা কি ভয় করবে না? তাঁর রসুলগণও মানবজাতিকে প্রশ্ন করেছে- লা তাত্তাকুন? তোমাদের কি ভয় নেই?

দেখা যায়, ভয় করা-সংক্রান্ত প্রশ্ন ও ভয়ের কারণও জানিয়েছেন রব্বুল আলামিন। বলা যায়, প্রশ্নের চেয়ে উত্তরটাই বেশি দিয়েছেন তিনি। কারণগুলো ব্যাখ্যা করেছেন আরও বেশি। সুবহানাল্লাহ !

প্রশ্ন : أَفَلَا تَتَّقُونَ  তোমরা কি ভয় করবে না? {৭:৬৫}, {১০:৩১}, {২৩:২৩, ৩২, ৮৭}

উত্তর: মহান রব আশা করেন- আমরা তাঁকে তাত্তাকুন’ বা ভয় করবো। তিনি কেন ও কিসের ভিত্তিতে আশা করছেন যে- মানুষ তাঁকে ভয় করবে? তিনি তো মানুষকে পৃথিবীতে চিন্তার স্বাধীনতা, নিজ অবস্থানে কর্মের স্বাধীনতা, ভালো-মন্দ বাছাইয়ের স্বাধীনতা দিয়েছেন। এসব কিছু দিয়ে তিনি কোন কোন বিষয়ের ভিত্তিতে আশা করছেন যে- মানুষ তাকে ভয় করবে? চলুন দেখি।

হে মানবজাতি তোমাদের রবের ইবাদত করো- যিনি তোমাদের ও আগের লোকদের সৃষ্টি করেছেন; যাতে তোমরা ভয় করো (লাআল্লাকুম তাত্তাকুন)। {২:২১}

তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছেন, যারা আগে ছিল- তারা গত হয়েছে, আমাদেরও বিদায় নিয়ে তাঁর কাছে যেতে হবে। তাই রবের ইবাদত না করে গেলে বিপদ আছে। এটাই তাঁকে ভয় করার একটি কারণ।

যখন আমরা তোমাদের অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং তোমাদের ওপর পর্বত তুলে ধরেছিলাম- দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো, মনে রাখো তাতে যা আছে; যাতে তোমরা ভয় করো (লাআল্লাকুম তাত্তাকুন)। {২:৬৩}

এ ঘটনাটি আমাদের জন্য একটি উদাহরণ, যা বনি ইসরাইলদের সঙ্গে হয়েছিল। পাথরের গায়ে লিখিত বিধি-বিধান মনে রাখা ও অনুসরণ করার মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন আল্লাহ। এসব নির্দেশ পালন করা হলো তাঁকে ভয় করার প্রমাণ। তাঁর নির্দেশ সর্বক্ষণ মনে রাখা ও মেনে চলা।

এবং তোমাদের জন্য কিসাসের মধ্যে জীবন, হে সমঝদার মানুষ (উলিল আলবাব) যাতে তোমরা ভয় করো (লাআল্লাকুম তাত্তাকুন)। {২:১৭৯}

যারা উলিল আলবাব বা সমঝদার লোকজন, তাদের বলা হচ্ছে- কিসাসের বিধানের মধ্যে মানুষের হায়াত বা জীবনের নিরাপত্তার সম্পর্ক আছে। আল্লাহর নির্দেশ করা কিসাসের বিধান মেনে চলতে বলা হচ্ছে। প্রভুর নির্দেশ মান্য করা তাঁকে ভয় করার একটি উদাহরণ।

ওহে যারা বিশ্বাস করেছো তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো (কুতিবা) যেভাবে তা দেওয়া হয়েছিল আগের লোকদের (বিশ্বাসীদের) জন্য; যাতে তোমরা ভয় করো (লাআল্লাকুম তাত্তাকুন)। {২:১৮৩}

মহাজগতের প্রভু সিয়াম করতে বলেছেন, যাতে আমরা তাঁকে ভয় করতে পারি। অতীতের বিশ্বাসীরাও সিয়াম করত। অর্থাৎ, সিয়ামের মাধ্যমে মহাপ্রভুর প্রতি ভয় জাগ্রত হয়।

এবং এটাই আমার সিরাতুল মুস্তাকিম (সরল-সঠিক পথ), তাই তোমরা এর অনুসরণ করো; তোমরা অন্যান্য পথের অনুসরণ করো না, সেগুলো তোমাদের তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে; আল্লাহ তোমাদের এসব নির্দেশই দিচ্ছেন- যাতে তোমরা ভয় করো (লাআল্লাকুম তাত্তাকুন)। {৬:১৫৩}

মহাপ্রভু সিরাতুল মুস্তাকিমের সীমারেখা ঘোষণা করে শুধুমাত্র তা মান্য করার নির্দেশ দিলেন। এসব নির্দেশ মান্য করলেই তাঁকে ভয় করা হবে– সে কথাও সাফ জানিয়ে দিলেন।

আর যখন আমরা তাদের ওপর পর্বত ওঠালাম যেন তা শামিয়ানার মতো- তারা ভাবছিল সেটা তাদের ওপর পড়বে- যা তোমাদের দেওয়া হয়েছে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং মনে রাখো তাতে যা আছে- যাতে তোমরা ভয় করো (লাআল্লাকুম তাত্তাকুন)। {৭:১৭১}

আবারও সেই বনি ইসরাইল বা মুসার কওমের ঘটনা উদাহরণ হিসেবে পেশ করলেন। পর্বতের দেয়ালে লেখা বিধি-বিধান মনে রাখা ও মেনে চলাই হলো রব্বুল আলামিনের প্রতি ভয় প্রদর্শনের একটি পদ্ধতি বা মাধ্যম।

এসব আয়াতের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করুন। লাআল্লাকুম তাত্তাকুন শুরু হয়েছে ২:২১ আয়াত দিয়ে। সেখানে তিনি বলছেন- রবের ইবাদত করো (ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ)। কিন্তু রব্বুল আলামিনের ইবাদত কি? ইবাদত বলতে কী বোঝায়? এবং কীভাবে ইবাদত করলে- মহান রবকে ভয় করা যাবে বা তাত্তাকুন করা যাবে- এই আয়াতে তা বলা হয়নি। তবে ধারাবাহিক আয়াতগুলো দেখলে সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়।

তিনি বলছেন, বনি ইসরাইলের জন্য দেওয়া সব হুকুম/বিধান পালন করা (২:৬৩); কিসাসের হুকুম/বিধান মেনে চলা (২:১৭৯); সিয়ামের হুকুম/বিধান মান্য করা (২:১৮৩); সিরাতুল মুস্তাকিমের হুকুম/বিধান অনুসরণ করা (৬:১৫৩) এবং ইহুদিদেরকে রবের বিধান দৃঢ়ভাবে ধারণ করার (৭:১৭১) নির্দেশাবলী হলো- তাঁকে ভয় করার পদ্ধতি বা মাধ্যম বা উপায় (তাত্তাকুন)

স্বাভাবিক কারণেই মহাপ্রভুর এসব হুকুম পালন করাই হলো আল্লাহর ইবাদত করা। এর বাইরে যা কিছু আছে- তা আল্লাহর দেওয়া স্বাধীনতার শক্তি (ইবাদত) ব্যবহার করে জিন-শয়তানের দেখানো পথের অনুসরণ।

এখানে পাঠকদের জন্য প্রাসঙ্গিক আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা হলো। মহান রব্বুল আলামিনকে ভয় করার যেসব পদ্ধতি বা উপায় রয়েছে, তার মধ্যে ইহুদিদের বিষয় বাদ দিলে রইলো বাকি ৩। অর্থাৎ, কিসাস, সিয়াম ও সিরাতুল মুস্তাকিম।

আমরা কিসাস’ বুঝলাম; যা আইনসম্মত পদ্ধতিতে রাষ্ট্রে হত্যাকাণ্ডের বিধান বাস্তবায়ন। আনআমের ১৫১, ১৫২ নং আয়াতের নির্দেশ থেকে সিরাতুল মুস্তাকিমও সুস্পষ্ট হয়ে যায়।

কেউ এসব প্রত্যক্ষ নির্দেশ/ হুকুম/ কাজ করলে বলা যাবে যে- সে আল্লাহর নির্দেশে কাজ করছে। অর্থাৎ, সেই ব্যক্তি/সমাজ/দেশ অদৃশ্য রব্বুল আলামিনের ভয়ে দৃশ্যমান কাজগুলো করছে।

তাহলে সিয়াম কী? সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে থাকা কি সিয়াম? আপনি আমি ক্ষুধার্ত থাকলে কীভাবে তা কাজ হয়? নিজে নিজে অভুক্ত থাকা কি কোনও কাজ? সবাই মিলে অভুক্ত থাকা কি সামাজিক, যৌক্তিক, বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে কোনও কাজের’ মধ্যে পড়ে? ধর্ম তো অন্যকে খাওয়ানোই বড় কাজ বলে জানিয়েছে! কাজ-এর সংজ্ঞা কি? কিসাস’ সিরাতল মুস্তাকিম’ সুস্পষ্টভাবে অনেকগুলো নির্ধারিত কাজ। তা ছাড়া, অভুক্ত থাকলে কীভাবে আল্লাহ-ভীতি জাগ্রত হয়? বিশ্বের কোটি কোটি অনাহারি-অভুক্ত মানুষ শত হাজার বছর ধরে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দিনে রাতে না খেয়ে আছে। দুর্ভিক্ষকবলিত অঞ্চলগুলোতে না খেতে পেরে মারা গেছে লক্ষ-কোটি বনি আদম। তারা কী আল্লাহ-ভীতি জাগ্রত হয়ে মারা গেলো! সে কথাই কি বলবেন? রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো হাড্ডিসার-ক্ষুধার্ত ভিক্ষুকগুলো সবার আগেই তাত্তাকুনের চাপে মুত্তাকি’ হয়ে যেতো- তাই নয় কি? যুক্তি কী বলে?

আমরা যখন সকাল-সন্ধ্যা রোজা রাখি- তখন কি আমাদের খোদাভীতি জাগ্রত হয়? এক হাজার তিনশ বছর ধরে দুনিয়াজুড়ে মুসলিম জাতি সকাল-সন্ধ্যা রোজা পালন করেছে, বংশ পরম্পরায় চলে আসছে রোজা। এতে আমাদের আল্লাহর প্রতি ভয় (তাত্তাকুন) আকাশচুম্বী থেকে মহাকাশচুম্বী হওয়ার কথা ছিল। তা হয়েছে কি? নাকি পাতালচুম্বী হয়ে একেবারে হারিয়ে গেছে!

যাই হোক, এখানে সিয়াম আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। আমরা বলছিলাম লাআল্লাকুম তাত্তাকুনের কথা।

ওপরের আয়াতগুলোর বাইরে মহান আল্লাহ তাঁকে ভয় করার বিষয়ে আরও কিছু যুক্তি দেখিয়েছেন এবং আমাদের স্মরণ করতে বলেছেন। চলুন দেখা যাক।

তারা কি দেখেনা যা আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন- সেখানের জিনিস- হেলে পড়ে তাদের ছায়া ডানে ও বামে- আল্লাহর প্রতি ঝোঁকে (সুজ্জাদালিল্লাহ) যখন তারা বিনীত হয়; এবং আল্লাহকে মেনে নেয় (ইয়সজুদু) যা আছে মহাকাশ ও যমিনের প্রাণী ও ফেরেশতাগণ; আর তারা অহংকারী নয়। তারা তাদের উপর রবকে ভয় করে এবং তাই করে যা নির্দেশ দেওয়া হয়।

এবং আল্লাহ বলেছেন- দুইজন ইলাহ মেনে নিও না; শুধুমাত্র তিনিই একমাত্র ইলাহ; তাই শুধু আমাকেই ভয় ও শ্রদ্ধা করো (ফারহাবু-নি)। সবই তার- যা আছে মহাকাশ ও যমিনে এবং তার ব্যবস্থাই (আদ-দীন) অবিরত; তাহলে আল্লাহ ছাড়া কাকে ভয় করবে (তাত্তাকুন)? {১৬:৪৮-৫২}

সুরা শুআরাতে (২৬) নুহ, হুদ, সলেহ, লুত ও শুয়াইব তাঁদের জাতির লোকদের বলেছিলেন-

…তোমাদের কি ভয় নেই (আলা তাত্তাকুন)? নিঃসন্দেহে আমি তোমাদের কাছে বিশ্বস্ত রসুল। {২৬:১০৬, ১২৪. ১৪২, ১৬১, ১৭৭}

এসব রসুলদের জাতির লোকজন তাঁদেরকে প্রত্যাখ্যান করায় পরে তাদের সমূলে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এসব নিদর্শন থাকার পরও আমাদের ভয় না পাওয়ার কোনও কারণ আছে কি?

সুরা সাফফাতে (৩৭) পাওয়া যায়, ইলিয়াস রসুলুল্লাহর কথা।

নিশ্চয়ই ইলিয়াসও ছিলো একজন রসুল। যখন সে তার জাতিকে বলেছিল- তোমরা কি ভয় করো না (তাত্তাকুন)তোমরা কি বাআলান-কেই ডাকবেআর ত্যাগ করবে সর্বশ্রেষ্ঠ স্রষ্টাকে?

আল্লাহ তোমাদের রব এবং তোমাদের পূর্ব পুরুষদের রব। {৩৭:১২৩-১২৬}

চূড়ান্তভাবে মহান রব্বুল আলামিন ফেরাউনের কাছে রসুল পাঠানোর ঘটনা উল্লেখ করে বলছেন-

তাহলে তোমরা কীভাবে ভয় করবে (তাত্তাকুনা) যদি তোমরা অস্বীকার করো সেদিন- যেদিন বাচ্চাদের
চুল হবে ধূসর?
{৭৩:১৭}

এখানকার আয়াতগুলোতে কিয়ামতের শুরুর প্রাথমিক অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন রব্বুল আলামিন। যে কিয়ামত বা মহাপ্রলয়কে অস্বীকার করে, সে আসলেই ভয় করতে পারে না; তার মধ্যে মহাপ্রভুর প্রতি ভয় থাকার কথা না। যে মহাপ্রলয়কে বিশ্বাস করে, সে মহাপ্রভুকে বিশ্বাস করে; মহাজগতের প্রভু তাকেই সেদিন প্রলয়কাণ্ড থেকে রক্ষা করবেন। এসব মানুষই রসুলকে বিশ্বাস করে, রসুলের ওপর নাযিল হওয়া বার্তা বিশ্বাস করে।

যেদিন আকাশ ফেটে যাবে, ভীষণ ভূমিকম্পে প্রচণ্ডভাবে বিস্ফোরিত হবে পাহাড়-পর্বত; সেগুলো হয়ে যাবে ধুলা-বালির স্তূপ। সেদিন দূষিত আকাশ বাতাসের কালো ধোঁয়ায় শিশুদের চুল হয়ে পড়বে ধুসর! সেই ভয়াবহ দিন মহাপ্রভু তাদেরকেই রক্ষা করবেন- যারা তাঁকে ভয় করেছিল, যারা তাঁর মহাকাশ ও যমিনের এই আসন্ন যৌক্তিক দুর্যোগকে বিশ্বাস করেছিল।

মহান আল্লাহ বলছেন-…তাঁর প্রতিশ্রুতি অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। নিঃসন্দেহে এটি একটি উপদেশ (তাযকিরাত); অতএব যার ইচ্ছা হয়- সে তার রবের (লালন-পালন-রক্ষাকর্তা) পথ ধরুক। {৭৩:১৮,১৯}

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *