জিন-সমগ্র (দ্বিতীয় পর্ব)

জিন-সমগ্র (দ্বিতীয় পর্ব)

প্রথম পর্বে জিনদের সৃষ্টি সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছিলাম। এবার আমরা জানব জিনদের বিস্ময়কর কিছু বৈশিষ্ট্য।

২. জিনের বৈশিষ্ট্য

 وَالْجَانَّ خَلَقْنَاهُ مِن قَبْلُ مِننَّارِ ٱلسَّمُومِ   

  • And the jinn I’ve created before from the FIRE of HOLE.
  • আর জিন- আগে আমি সৃষ্টি করেছিলাম গর্তের আগুন থেকে। {১৫:২৭}

যে যুগে কুরআন নাযিল হয়, সে যুগে মহাকাশ, গ্যালাক্সি, ব্ল্যাক হোলএসব বিষয় মানুষ জানত না। তাই কুরআনে এমন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা দেড় হাজার বছর আগের মানুষও বুঝতে পারে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের মানুষও তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে নিগূঢ় তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ বের করতে পারে। এটি মহান রবের একটি প্রজ্ঞা ও মহাগ্রন্থের একটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য।

জিনরা মূলত বুদ্ধিমান প্রাণী। তারা ‘সামওয়াতের’ প্রাণী। ‘সামওয়াত’ বা ‘মহাবিশ্বজগত’ তাদের জন্য শান্তিপূর্ণ স্থান। বাইবেলে তাদের বলা হয়েছে, ‘আকাশের পুত্র’। এই মহাবিশ্বের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ মানুষদের পরীক্ষা করছেন এবং মানুষের ‘নফসের’ বিকাশ ঘটাচ্ছেন, পরবর্তী জগতের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য। জিনরা মানুষকে মহান প্রভুর অযোগ্য প্রতিনিধি (খলিফা) প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। মানুষের নফস ও দৃশ্যমান ম্যাটারের তৈরি মানবদেহ তারা ব্যবহার করে। কিন্তু তারা মানুষকে প্রভুর খলিফা হিসেবে চায় না (এই ব্যাখ্যা পরে উল্লেখ করা হবে)।

আমরা আগেই জানতে পেরেছি যে, এই মহাবিশ্ব (সামাওয়াত) একটি টু-ইন-ওয়ান মহাবিশ্ব: একটি পদার্থের প্রাণীদের জন্য (baryonic matter) এবং অন্যটি অ্যান্টি-ম্যাটারের প্রাণীদের জন্য। আমরা ম্যাটার বা পদার্থের তৈরি শীর্ষ-বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রাণী। পাশাপাশি জিনরা হলো প্রতি-পদার্থ বা অ্যান্টি ম্যাটারের তৈরি শীর্ষমানের প্রাণী।

দেখা যায়, জিন-শয়তান (আযাযিল) আল্লাহর সঙ্গে তর্ক করে বলেছিল যে, তাকে আগুন (গর্তের আগুন/অ্যান্টি ম্যাটার) থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আদমকে পৃথিবী থেকে (ব্যারিয়নিক ম্যাটার) সৃষ্টি করা হয়েছে, কেন সে আদমকে মেনে নেবে (সাজাদা)? বলা যেতে পারে যে- ‘পদার্থের তৈরি প্রাণী’ যেহেতু ‘প্রতি-পদার্থের তৈরি প্রাণীর’ সঙ্গে যোগাযোগই করতে পারবে না—সেহেতু তাকে জিনরা কেন আনুগত্য করবে বা তার নেতৃত্ব গ্রহণ করবে?

  • নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি (خَلَقْنَٰكُمْ), তারপর সজ্জিত করেছি (صَوَّرْنَٰكُمْ), তারপর মালাইকাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলাম আদমকে মেনে নাও (اسْجُدُوْ সুজুদু), তাই তারা মেনে নিলো (فَسَجَدُوٓا۟ ফা-সাজাদু); শুধু ইবলিস (إِبْلِيسَ) মান্যকারীদের (ٱلسَّٰجِدِينَ সাজিদিন) মধ্যে ছিল না।
  • বললেন, কি তোমাকে বাধা দিলো মেনে নিতে (تَسْجُدَ তাসজুদা) যখন আমি নির্দেশ দিলাম! বলল- আমি তার চেয়ে উন্নত আপনি আমাকে তৈরি করেছেন আগুন (نَّارٍ) থেকে, আর তাকে তৈরি করেছেন মাটি (طِينٍ ত্বীন) থেকে। {৭:১১.১২}

বলাই বাহুল্য, আল্লাহ এই যুক্তি গ্রহণ করেন নি। যদিও জিন-ইবলিসের দাবি ছিল সত্য (সৃষ্টির উপাদান- আগুন আর মাটি)! তাহলে ধরে নেওয়া যায়, দুই অঞ্চলের প্রাণীর মধ্যে পৃথিবীর সময়পর্ব পর্যন্ত যোগাযোগ না হলেও- একসময় ঠিকই যোগাযোগ হবে। অর্থাৎ, আপাত সত্যের ভিত্তিতে (সৃষ্টির উপাদান) জিনের দাবিটি সার্বিকভাবে ও সামগ্রীকভাবে সত্য নয়।

তা ছাড়া, আল্লাহর নির্দেশে আদমের আনুগত্য করা মূলত- আল্লাহরই আনুগত্য করা। সেটা জিন চিন্তা-ভাবনা করে দেখে নি। ঠিক যেমন, রসুলদের ক্ষেত্রে পৃথিবীবাসীকে আল্লাহ বলেছেন- আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসুলের আনুগত্য করো। এখানেও রাসুলের আনুগত্য হলো আল্লাহরই আনুগত্য। 

যাই হোক- মহান রব যেহেতু জিন-ইবলিসের দাবি মেনে নেননি; তার মানে হতে পারে- পরস্পর বিপরীতধর্মী পদার্থের তৈরি প্রাণীদের প্রত্যক্ষ/সরাসরি যোগাযোগ একদিন সম্ভব হবে। পৃথিবীতে একজন মানুষের দেহে যে নফস বা ‘প্রথম পর্যায়ের আত্মা‘ থাকে, সেই নফসে তথ্য দিতে পারে জিন। আত্মা বা নফস হলো দুই জগতের প্রাণীদের যোগাযোগের গোপন ব্যবস্থা। কিয়ামতের পর পুনরুত্থিত মানুষের নফস হবে সক্রিয় ও শক্তিশালী। যা পৃথিবীর জীবনে নির্দিষ্ট সময়ে বিকশিত হয়। মহাবিশ্বের জ্বলন্ত গ্যালাক্সি ও অন্যান্য বিষয়বস্তুকে মহান আল্লাহ জাহান্নাম, নার, সায়ির, হুতামা- ইত্যাদি বলেছেন। অর্থাৎ, সেগুলো বিভিন্ন পর্যায়ের জাহান্নাম। কিয়ামতের পরবর্তী পুনরুত্থিত মানুষের/নফসের ক্ষমতা বৃদ্ধি না পেলে তারা কীভাবে এই গনগনে উত্তাপে শাস্তি ভোগ করবেআল্লাহ বলছেন-

  • আর যেদিন তিনি বলবেন- তোমরা যাদেরকে আমার শরিক দাবি করতে তাদেরকে ডাকো (نَادُوا۟); তারা তাদেরকে ডাকবে (دَعَوْهُمْ), কিন্তু তারা তাদেরকে সাড়া দেবে না; এবং আমরা তাদের মাঝে বানাবো (مَّوْبِقًا) ধ্বংসস্থাল! আর অপরাধীরা সে আগুন (ٱلنَّارَ) দেখবে, তখন তারা নিশ্চিত হবে যে তারা তাতে পড়তে যাচ্ছে (مُّوَاقِعُوهَا) এবং তারা তা থেকে পালাবার পথ পাবে না {১৮:৫২,৫৩}

  • One Day He will say, “Call on those whom you thought to be My partners,” and they will call on them, but they will not listen to them. And We shall set a Crucible (Mawbiqan) between them, and the Sinful shall see the fire and apprehend that they have to fall therein—no means will they find to turn away from there. {18:52,53}

একটি ঘূর্ণনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র (magnetic field)একটি ঘূর্ণায়মান ব্ল্যাক হোলের সঙ্গে যুক্ত। যা কেন্দ্রের বাইরে একটি অ্যাক্রিশন ডিস্ক তৈরি করে (যেমন দেখা যায়, মহাকাশে একটি ব্ল্যাক হোলের চারপাশে অবস্থিত একটি গোলক যেখানে পদার্থের গতিবেগ আলোর গতি পর্যন্ত পৌঁছায়)। উপরের আয়াতগুলিতেঅ্যাক্রিশন ডিস্ককে Crucible– ক্রুসিবল বলা হয়েছে (ক্রুসিবল- ধাতু গলানোর পাত্রের মতো অবধারিত মহাসঙ্কট)। যেসব বস্তু ব্ল্যাক হোলে গিয়ে পড়বে তা ক্রুসিবলের মধ্যে প্রচণ্ড গতিতে ঘুরতে থাকে। সেখানে প্রচণ্ড ঘর্ষণে ধ্বংস হয়ে যায়। সেসময় বিধ্বংসী তাপমাত্রা উৎপন্ন হয়।

crucible


এই ক্রুসিবল ব্ল্যাক হোলের চারপাশে একটি বাধা হিসাবেও কাজ করে। তাই ব্ল্যাক হোল দিয়ে জিনেরা বের হতে পারবে না।

একজন পাপিষ্ঠ ব্যক্তি ক্রুসিবলে উৎপন্ন বিধ্বংসী আগুন দেখবে এবং ভাববে যে- সে তার বাসস্থান-সহ তীব্র মহাকর্ষীয় শক্তির সর্পিলকার ক্রুসিবলে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে! 

যাই হোক, বিলিয়ন- ট্রিলিয়ন- যিলিয়ন বছর পর হয়তো এমন একটি সময় আসবে যখন শক্তিশালী নফস-বিশিষ্ট পাপী মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এবং ওই ব্ল্যাক-হোলের আগুনের তৈরি জিনরা হবে তার অন্তরঙ্গ সহযোগী। 

সুতরাং যদি তারা ধৈর্য ধরে (يَصْبِرُوا۟) তবুও আগুন (ٱلنَّارُ) তাদের আবাস (مَثْوًى); আর তারা অনুগ্রহ চাইলেও (يَسْتَعْتِبُوا۟) তারা অনুগ্রহপ্রাপ্তদের (ٱلْمُعْتَبِينَ) অন্তর্ভুক্ত হবে না। আমরা তাদের জন্যে নির্ধারণ করেছিলাম (قَيَّضْنَا) সঙ্গী-সাথি-নিকটজন (قُرَنَآءَ), আর তারা তাদের সামনে-পেছনে যা কিছু আছে (مَّا بَيْنَ اَيْدِيْهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ) তাদেরকে আকর্ষণীয় করেছিল (زَيَّنُوا۟); এবং তাদের উপর সেই কথা সত্য-সাব্যস্ত হয়েছিল (حَقَّ عَلَيْهِمُ الْقَوْلُ), উম্মাতগুলোর মধ্যে (فِيْٓ اُمَمٍ)- নিঃসন্দেহে তা অতীত হয়েছে (قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِمْ) জিন ও মানুষের মধ্যে (مِّنَ الْجِنِّ وَالْاِنْسِ); নিশ্চয়ই তারা ছিল ক্ষতিগ্রস্ত/ব্যর্থ/পরাজিত (اِنَّهُمْ كَانُوْا خٰسِرِيْنَ)। {৪১:২৪,২৫}


  • If then they have patience, the Fire will be a home for them! And if they beg to be received into favor, into favor will they not be received. And We have destined for them intimate companions who made alluring to them what was before them and behind them, and the sentence among the previous generations of jinns and men who have passed away is proved against them; for they are utterly lost. {41: 24-25}

একটি মানুষের নফস (আত্মা) হল জানা অজানা ফোর্স ফিল্ড বা শক্তি-ক্ষেত্রের সংমিশ্রণে গঠিত। যাকে মহান রব বলেছেন- তোমাদের সৃষ্টি করেছি তারপর সজ্জিত করেছি {৭:১১}। কিছু শক্তি-ক্ষেত্র অ্যান্টি-ম্যাটারের সাথে ইন্টারেক্টিভ বা যোগাযোগ করার উপযোগী হয়ে উঠতে পারে। তার দুটি কারণ। প্রথমত, এই মহাবিশ্বেও জিনজাতি মানবজাতির নফসে উসকানি ও মন্দ কাজের প্রেরণা দেয়। দ্বিতীয়ত, একই মহাকর্ষ বল (Gravitational Force) পদার্থ ও প্রতি পদার্থ (both matter and anti-matter ) উভয়ের উপরই কাজ করে। সুতরাং, মৃত্যুর পর অপরাধী মানুষ বা অপরাধী নফস এক জিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়ে উঠবে। সে কথাও নিশ্চিত করেছে আল-কুরআন।

  • আর তখন শয়তান (الشَّيْطٰنُ) বলবে যখন নির্ধারিত/মীমাংসা হবে সব-বিষয়ের (قُضِيَ الْاَمْرُ) আল্লাহ তোমাদের সত্য প্রতিশ্রুতি (وَعْدَ الْحَقِّ) দিয়াছিলেন এবং আমিও প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলাম তোমাদের- তা ভঙ্গ করেছি (اَخْلَفْتُكُمْ); তোমাদের উপর আমার কর্তৃত্ব (سُلْطَٰنٍ) ছিল না, আমি শুধুমাত্র তোমাদেরকে ডেকেছিলাম (دَعَوْتُكُمْ)- আর তোমরা সাড়া দিয়াছিলে (ٱسْتَجَبْتُمْ) আমাকে; সুতরাং তোমরা আমাকে দোষ (لُومُو) দিও না, বরং নিজেদেরকে ধিক্কার (لُومُو) দাও; আমি তোমাদের উদ্ধারকারী (بِمُصْرِخِ) না এবং তোমরাও আমার উদ্ধারকারী না; নিশ্চয়ই আমি অস্বীকার করি (كَفَرْتُ) সে বিষয়ে যাতে আমাকে তোমরা শরিক করেছিলে (أَشْرَكْتُمُونِ); নিশ্চয়ই জালিমদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে। {১৪:২২}

শুধু জিন-ই নয়, নূরের তৈরি আরও উন্নত সৃষ্টি- ফেরেশতাগণের সঙ্গেও কথা বলতে পারবে মানবাত্মা বা নফস। অর্থাৎ মানুষের নফস মৃত্যুর পর প্রচণ্ড রকম উন্নত ও কার্যকর হবে। সেই নফস অ্যান্টি-ম্যাটারের প্রাণী জিন ও নূরের তৈরি ফেরেশতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। (আল মুদ্দাসির ৪২-৪৯; মুলক ১০) জাহান্নামিদের কথোপকথন দেখুন এখানে।

এবার ৭২ নং সুরা জিন থেকে দেখবো- তারা কী কী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আয়াত নম্বর ব্র্যাকেটে উল্লেখ করা হয়েছে।

জিনরা মানুষকে দেখতে পায়, মানুষের কথা শুনতে পায়; তারা নিজেরা কথা বলে; তারা বিস্ময় বোধ করেউপলব্ধি করে; তাদের চিন্তা-ভাবনা-বিবেচনাশক্তি আছে। (১)

জিনরাও রবের প্রতি ঈমান আনে। তারা শিরক-ও করে। তাদের কেউ স্বীকার করে যে কুরআন সঠিক পথ দেখায়।(২)

তাদের মধ্যেও স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের ধারণা আছে। তারা বুঝেছে যে- মহান রবের মর্যাদা বিশাল/সুউচ্চ। তিনি স্ত্রী-সন্তান নেন না। এসবের প্রয়োজন-চাহিদাসব কিছু থেকে মুক্ত মহান-সুউচ্চ মর্যাদার সত্তা তিনি। (৩)

বোকা ও সীমালঙ্ঘনকারী জিন আছেযারা আল্লাহ সম্পর্কে অবান্তর/ আপত্তিকর বিরুদ্ধাচরণ করে। (৪)

জিনরাও ভাবতে পারেতাদেরও মন-মনন আছে। তারা সত্য-মিথ্যা বলতে পারে, ভুল ধারণা, অলীক অসংলগ্ন কথা-কাজ করতে পারে। (৫)

মানুষ জিন থেকে রক্ষার জন্য মানুষের কাছেই আশ্রয় চাইলে জিনরা তার ওপর رَهَقًا রহাকা/ ভারী চাপ বা বোঝা চাপায়। তাই আশ্রয় চাইতে হবে সরাসরি আল্লাহর কাছে। (৬)

মানুষ যেহেতু নিজ শক্তি দিয়ে জিনের মোকাবিলা করতে পারে না, সেহেতু আল্লাহ মানুষকে রক্ষা করেন। কিন্তু তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে হবে।

জিনরা কোনও ভবিষ্যৎ জানে না। অতীতেও যেতে পারে না। তাদের একটি অংশ অজ্ঞদের মতো ধারণা করে যে- পুনরুত্থান হবে না। (৭)

তারা সামায়া/ আকাশের কোনও এক অংশে যেতে চায়; কিন্তু গিয়ে দেখে যে, সেখানে আছে প্রহরী ও ভয়াবহ-জ্বলন্ত আগুন (শাদিদান ওয়া শুহুবান)। (৮)

জিনরা আগে আকাশের কিছু নির্দিষ্ট স্থানে তথ্য শোনার জন্য বসতো। অর্থাৎ তারা উঠতে, বসতে, ছুটতে, উড়তে পারে। কিন্তু এখন সেখানে বসতে গেলে (রসুলের সময়) দেখে যে- জ্বলন্ত আগুন তার জন্য অপেক্ষা করছে (শিহাবা)। (৯)

তারা ধারণা করে যে- তথ্য সংগ্রহের স্থানে এই পরিবর্তনের মাধ্যমে পৃথিবীতে অকল্যাণ আসবে কি? নাকি পৃথিবীবাসীকে সঠিক পথ দেখানো হবে? অর্থাৎশেষ নবীর আগে তারা গায়েবের জগৎ থেকে/ ঊর্ধ্ব জগত থেকে নানা তথ্য জানতে পারত। যার সঙ্গে পৃথিবীর ভালো মন্দের যোগাযোগ ছিল। হঠাৎ করে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা বিস্মিত হয়েছে- বিভ্রান্তিতে পড়েছে। এরাই সেই দল- যারা পৃথিবীতে বিচরণ করতে করতে হঠাৎ কুরআন শুনে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, আত্মসমর্পণ করেছে। (১০)

জিনদের মধ্যে কেউ কেউ আছে সৎকর্মশীল (সলেহীন)সবাই নয়। তাদের মধ্যে বিভিন্ন মত/ পথ আছে। তারাও কাজ করে। কাজের মধ্যে ভালো-মন্দ আছে। বিভিন্ন দল-মত ও অনুসারী আছে। (১১)

তারা নিশ্চিত হয়েছে যে- পৃথিবীতে সব মানুষকে বিভ্রান্ত করে আল্লাহকে পরাস্ত করতে পারবে না এবং আল্লাহর হাত থেকে পালিয়ে কোথাও যেতে পারবে না। তারা هَرَبًا হারাবা/ফ্লাইট- এর মাধ্যমে বা প্রক্রিয়ায় মুহূর্তে বহু দূর-দূরান্তে পলায়ন করে থাকে। বিশেষ কোনও প্রযুক্তি/ব্যবস্থা- যা জিনদের আয়ত্বে আছে। যা দিয়ে ইন্টার গ্যালাক্সি ভ্রমণ করা যায়। লাইটইয়ারস্ দূরত্ব অতিক্রমে এর কোনও বিকল্প নেই। (১২)

জিনরা মূলত পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাস্ত করার জন্য চেষ্টা করে। আদম সন্তানদের বিভ্রান্ত করে জিনদের দলভুক্ত করতে চেষ্টা করে। যত বেশি মানুষকে তাদের দিকে টানতে পারবে- সেই চেষ্টায় তারা ব্যস্ত। এতে তাদের কিছু উপকার আছে। মূলত, এটা ছিল জিনদের একজন- যে শয়তান- তার লক্ষ্য। সেই মিশন পৃথিবীতে বাস্তবায়ন করছে  জিন-শয়তান ও তার অনুসারী দল। সব জিন তার অনুসারী না। কারণ, তাদের মধ্যেও বহুদল আছে। তাদের কেউ ভালো জিন। তারা আসমানের খবর নেওয়ার জায়গাগুলো আগুনের গোলা দিয়ে বন্ধ দেখে পৃথিবীতে এসেছে। তারপর শেষ নবীর কণ্ঠে কুরআন পাঠ শুনেছে ও মহাপ্রভুর প্রতি বিশ্বাস করেছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে- জিন-শয়তান বা ইবলিস আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সব মানুষকে পথভ্রষ্ট করার মাধ্যমে আল্লাহকে পরাজিত করার যে মিশন নিয়েছিলতা সম্ভব হবে না। কারণ, মানুষের কাছে হুদাপৌঁছে গেছে।

শেষ পর্যন্ত তারা হারাবা  هَرَبًا দিয়ে বা এই প্রক্রিয়ায় পালিয়ে আল্লাহর পাকরাও থেকে বাঁচতে পারবে না। নিজেদের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরে, জিনরা বললো-

  • …আমরা শুনেছি এক বিস্ময়কর কুরআন, যা সঠিক পথ দেখায়, আমরা তা বিশ্বাস করেছিএবং আমরা কখনও আমাদের প্রভুর সঙ্গে কাউকে শরিক করবো না। {৭২:১,}

জিনদের একটি দল হুদা বা পথনির্দেশের খবর পেল- তাতে বিশ্বাস করল। যে তার রবকে বিশ্বাস করবে, তার কোনও ক্ষতি হবে নাকোনও চাপ/বোঝা رَهَقًا রহাকা থাকবে না। এই হুদা মানুষের জন্য হলেও, তাতে জিনদের জন্য পথনির্দেশ আছে। জিনরা বুদ্ধিমান হওয়ায় তাদের একটি দল আল-কিতাব থেকে শিক্ষা নিয়েছে ও নিচ্ছে।
এজন্যই দেখা যায় মহাগ্রন্থ আল-কিতাবে অসংখ্যবার জিন ও মানুষকে একসঙ্গে উল্লেখ করে কথা বলেছেন মহাপ্রভু।

জিনদের মধ্যে আছে আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) এবং অন্যরা সীমালঙ্ঘনকারী (ক্বসিতুন)। যারা বশ্যতা স্বীকার করেছে (আসলিম) তারাই সঠিক পথ পেয়েছে (তাহারও রশাদা)। (১৪)

বোঝা যাচ্ছে- মুসলিমুন ও ক্বসিতুন বিপরীত শব্দ। যারা আত্মসমর্পণ করে না- তারা ক্বসিতুন। যারাই মহান রবের নিকট বশ্যতা স্বীকার করেছে, অর্থাৎ মহান রবের নিয়ম-কানুনের কাছে নতি স্বীকার করেছে- তারাই আত্মসমর্পণকারী। অন্যরা হলো- অবাধ্য বা সীমালঙ্ঘনকারী বা ক্বসিতুন। আর আত্মসমর্পনই হলো সঠিক পথ।

যারা আল-ক্বসিতুন তারা হবে জাহান্নামের জ্বালানি। (১৫) জাহান্নামের অধিবাসী হবে মানুষ ও জিন। জাহান্নামের জ্বালানি হবে আল-ক্বসিতুন। তারা আত্মসমর্পণ করেনি- এমনসব জিন ও মানুষ।

আর জিনরা যদি তারা সঠিকপথে থাকতো- আল্লাহ তাদের পান করার জন্য প্রচুর পানি দিতেন [লা-আসক্বইনাহুম মা] (১৬)

যার মাধ্যমে জিনদের পরীক্ষা করা যাবে; যে তার রবের স্মরণ থেকে মুখ সরাবে তাকে কঠিন আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। (১৭)

দেখা যাচ্ছে, জিনদের অন্যতম একটি চাহিদা হলো- পানি। জাহান্নামিরাও (জিন ও মানুষ) পানি চাইবে জান্নাতিদের কাছে। জিনরা সঠিক পথে থাকলে- তাদেরকে আল্লাহ পানি দিতেন পান করার জন্য। সেই পানি পানের বিষয়টি হতো একটি পরীক্ষা। আর পরীক্ষা মানেই- তারপর আছে ফলাফল; পাস-ফেল। মূলত, দুনিয়াতে মানুষকে দেওয়া আল্লাহর সব নিয়ামত হলো পরীক্ষা। তেমনি জিনদেরও পরীক্ষার বিষয়বস্তু আছে।

যেসব জিন ঈমান এনেছে- তারা সঠিক পথ পেয়েছে। সূত্র অনুযায়ী তারা পানিও পেয়েছে। তারা আল্লাহর পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিয়ামতের পর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ জিনরা জাহান্নামের আযাব থেকে নিষ্কৃতি পাবে। সৎ মানুষগুলো যাবে জান্নাতে যেখানে প্রচুর পানির কথা জানা যায়। কিন্তু পানি দৃশ্যমান ম্যাটারের তৈরি পদার্থ। অ্যান্টি-ম্যাটারের তৈরি জিনদের এই পানির তৃপ্তির নাগাল পেতে হলে মানুষের নফস ছাড়া তার কোনও উপায় নাই।

বিগ ক্রাঞ্চ বা দ্বিতীয় নতুন শুরুর পর  নতুন করে গড়ে ওঠা মহাবিশ্বের কোথাও ভালো জিনদের জন্য পানির ব্যবস্থা থাকবে বলে ধারণা করা যায়। যেহেতু পানির প্রতি তাদের চাহিদা আছে।

আন্ নমল সুরার ১৭, ৪০, ৪১ আয়াতে দেখা যায়, দুই ধরনের জিন রয়েছে। একজন শক্তিশালী, বিশ্বস্ত ও অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে কাজ করতে পারে। আরেকজনের আছে কিতাবের জ্ঞান- সে আরও বেশি দ্রুতগতির! চোখের পলক ফেলার আগেই কাজ সমাধান করতে পারে।

এখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তা হলো কিতাবের জ্ঞানের ভিত্তিতে বিশালাকার বস্তু দ্রুত গতিতে/ মুহূর্তের মধ্যে স্থানান্তর করা যায়। অর্থাৎ, বস্তুকে আলোক তরঙ্গের বা ফোটন কণার মতো পরিবর্তন করে তা আলোর গতিতে স্থানান্তর করে ফের তাকে বস্তুতে রূপান্তর করা যায়। যা নিয়ে উন্নত রাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা ব্যাপক গবেষণা করছেন। বিখ্যাত ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট রহস্য (Oct. 28, 1943) সে পরীক্ষারই একটি অংশ বলে জানা যায়। অথবা- ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক সিগনালে রূপান্তর করা যায়। যেভাবে মোবাইল ফোন সিগনালের মাধ্যমে শব্দ, ভিডিও ইত্যাদি আদানপ্রদান করা হয়।

সুরা সাবার ১২,১৩,১৪ নং আয়াত থেকে জানা যায়, মহান রবের অনুমতিক্রমে জিনদের কিছু সংখ্যক তার রাজ্যে কাজ করত। তারা মধ্যে নবী সোলাইমানের নির্দেশ অমান্য করলে জ্বলন্ত আগুনের শাস্তি ভোগ করতে হবে।

তারা নবী সুলাইমানের ইচ্ছে অনুযায়ী তার জন্য প্রাসাদ, ভাস্কর্য, হাউযের ন্যায় বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশালাকায় ডেগ নির্মাণ করত। পরে যখন সুলাইমানের মৃত্যু হলো- তখন মাটির পোকা (দাব্বাতুল আরদ)তার লাঠি খেয়ে ফেলায় ভারসাম্য হারিয়ে নবীর মৃতদেহ পড়ে যায়। তখন জিনরা -বুঝতে পারল যে, যদি তারা গায়েব জানত, তাহলে তারা এই লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি থেকে পালিয়ে যেত।

সুরা ছোয়াদের ৩৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে জিন-শয়তানদের কথা। যারা ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরি।

অর্থাৎ সুলাইমানের অধীনে যেসব জিন কাজ করত- তারা ছিল শয়তান-জিন। তারা শাস্তিস্বরূপ তাঁর রাজ্যে গোলামির কাজ করতো। এজন্যই তাঁর মৃত্যুর পর তারা শাস্তিমুক্ত হয়ে যায়। বিরাট রাজ্যের নানা ধরনের কাজকে তারা লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি বলে উল্লেখ করেছে। জিনরা গায়েব বা অদৃশ্যজগতের খবর জানে না। তবে, তারা জানার চেষ্টা করে। আগে জানতেও পারত। কিন্তু শেষ নবীর আগমনের পর তা বন্ধ হয়ে যায়।

দেখা যাচ্ছে- শাস্তি হিসেবে যেসব জিন কাজ করত- তারা বস্তুজগতের জিনিস ধরতে এবং তা দিয়ে বিভিন্ন কাজ করতো। অবশ্যই আল্লাহর আদেশে এই অবস্থায় তাদের আনা হয়েছিল। তারা রাণীর সিংহাসন/মুকুট নিয়ে এসেছিল; যা ছিল ম্যাটার দিয়ে তৈরি বস্তুজগতের পদার্থ।

মহান আল্লাহ প্রথমে আদমকে জান্নাতে রেখেছিলেন। অর্থাৎ তিনি মানুষকে জান্নাতের উপযোগী করেই সৃষ্টি করেছিলেন। মানুষ এই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মহাবিশ্বের (সামাওয়াত) উপযোগী প্রাণী নয়। বিবর্তনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীকে মানুষের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। এই পৃথিবী একটি অনন্য গ্রহ; যার সমুদ্রে জলের ভাণ্ডার, স্তরে স্তরে সাজানো বায়ুমণ্ডল, আকাশমণ্ডল শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের ঢাল এবং অসংখ্য জীবন্ত প্রাণী রয়েছে।

যতদূর দেখা যায়, ততটুকু মহাবিশ্বের তুলনায় পৃথিবী অদৃশ্য ক্ষুদ্র একটি স্থান। যতটুকু দেখা যায়- তা ভয়ঙ্কর একটি স্থান। প্রচণ্ড ঠান্ডা, প্রচণ্ড উত্তাপ, প্রচণ্ড গতিসমপন্ন, ভয়াবহ ক্ষতিকর বিকিরণের এক মহাবিশ্ব! যা দেখা যায় যা দেখা যায়না- সেই ডার্ক এনার্জির মহাবিশ্ব আরও বহুগুণে বড়। সাধারণভাবে বোঝা যায়, এই মহাবিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়ার মতো প্রাণী হলো জিন। তাওরাতের বুক অফ ইনোকে (Book of Enoch) জিনদের বলা হয়েছে- ‘আকাশের পুত্র’। পবিত্র কুরআন ও বাইবেলে, আকাশ হলো এই মহাবিশ্ব (সামাওয়াত)। অর্থাৎ, জিনরাই হলো এই মহাবিশ্বের উপযোগী সৃষ্টি। এই মহাবিশ্বই তাদের আদি বসতবাড়ি।

আল্লাহ সর্বোচ্চ মহাবিজ্ঞানময় সৃষ্টিকর্তা। তিনি এই মহাবিশ্বের জন্য জিনদের সৃষ্টি করে থাকলেঅবশ্যই তারা এই মহাবিশ্বের জন্য সবচেয়ে নিখুঁতভাবে উপযুক্ত হবে; যেভাবে মানুষ হলো জান্নাতের জন্য উপযুক্ত। তাদের জীবনের আয়ু, খাদ্য ও চলাফেরা নিয়ে কোনও সমস্যা হবার কথা নয়।

নিঃসন্দেহে জিন দীর্ঘজীবন লাভ করে। যেমন- শয়তান-জিন পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত মানুষকে পথভ্রষ্ট করার অনুমতি পেয়েছে। ধারণা করা যায়- অন্যান্য জিনরাও স্বাভাবিকভাবে শত-কোটি-বিলিয়ন বছরের আয়ু পেয়েছে। আসলে তাদের মৃত্যুর কোনও ইঙ্গিত কুরআনে নেই।

মনে হয়, খাবার নিয়ে জিনদের কোনও চিন্তা নেই। তারা প্রকৃতি থেকে সরাসরি শক্তি (অ্যান্টি-এনার্জি) শোষণ করতে পারে। যেভাবে গাছ সূর্য থেকে শক্তি নেয়। তবেতাদের পানির প্রতি চাহিদা আছে। পানি- একটি রহস্যময় পদার্থ। পানির মতো তরল, কঠিন ও বায়বীয় পদার্থ মহাবিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই! বিস্তর গবেষণা চলছে পানি নিয়ে। এ বিষয়ে পরে আলোচনা হবে। তাদের খাবার-দাবার, কাজকর্ম নিয়ে দুশ্চিন্তা না-থাকায় বিরামহীনভাবে মানুষের পিছে লেগে রয়েছে শয়তান-জিনের দল।

ক্রমশ: প্রসারিত মহাবিশ্বযা আলোর গতির চেয়েও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছেএমন স্থানে জিনদের ভ্রমণের জন্য রয়েছে হারাবা।তারা هَرَبًا হারাবা/ ফ্লাইট- এর মাধ্যমে বা এই প্রক্রিয়ায় মুহূর্তে বহু দূর-দূরান্তে যাতায়াত করতে পারে।

মহাগ্রন্থ থেকে জিনদের এসব অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা ও রহস্যময় বৈশিষ্ট্য জানা যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *