মানুষের ইতিহাস (১)

মানুষের ইতিহাস (১)

কুর'আন রিসার্চ সেন্টার- কিউআরসি

ভূমিকা

২:২৮-৩৩ তোমরা কীভাবে আল্লাহকে অস্বীকার করছোঅথচ তোমরা ছিলে মৃত, তারপর তিনিই তোমাদের জীবন দিয়েছেন; পুনরায় তিনিই তোমাদের মৃত্যু দেবেন, তারপর আবার তোমাদের জীবন দান করবেন এবং সবশেষে তোমাদের ফিরিয়ে নেবেন তাঁর কাছে। তিনিই তোমাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর সবকিছু; তারপর তিনি আকাশ দেখলেন এবং সাত স্তরে সাজালেন; আর প্রতিটি বিষয়ে তিনি অতীব জ্ঞানী।

আর যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বলেছিলেন- আমি পৃথিবীতে খলিফা (প্রতিনিধি) বানাতে যাচ্ছি; তারা বলেছিল- আপনি কি সেখানে এমন কাউকে বানাবেনযারা সেখানে ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত করবে, যেখানে আমরা স্বাভাবিকভাবে কাজ করছি- এভাবেই আপনার প্রশংসা করছি আর আমরা আপনার পবিত্রতা জানাই; তিনি বলেছিলেন- আমি জানি যা তোমরা জানো না।

আর তিনি শিক্ষা দিলেন আদমকে নামকরণ; আর উপস্থাপন করলেন ফেরেশতাদের সামনে। তাদের বললেন- এসব জিনিসের নাম বলো যদি তোমরা সত্য বলে থাকো।

তারা বললো- আপনি মহান, আমাদের তো কোনো ইলম নেই আপনি যা শিক্ষা দিয়েছেন- তা ছাড়া; নিশ্চয়ই আপনি মহাজ্ঞানী এবং মহা প্রজ্ঞাময়।

তিনি বললেন- হে আদম! এদের নাম তাদের বলো। তারপর সে যখন তাদের নাম বললতখন তিনি বললেন- আমি কি তোমাদের বলিনি, আমি জানি মহাকাশ এবং পৃথিবীর গায়েব; আর যা কিছু তোমরা ব্যক্ত করো এবং যা কিছু কর গোপন I 

১. শুরু হলো অনন্তকালের পথচলা

এখান থেকে শুরু হলো মানুষের গল্প। আসলে গল্প নয়; এটি মানুষের ইতিহাস। যা শুরু হয়েছিল গায়েবের জগতে বা অদৃশ্য জগতে। যে জগত পৃথিবীর মানুষের কাছে অদৃশ্য- সেই জগতই হলো অদৃশ্য জগৎ

একটি প্রশ্ন- দৃশ্যমান জগৎ ও অদৃশ্য জগৎ–কোনটি আসলে গুরুত্বপূর্ণ?

প্রথমত, সব ধরণের বিষয় তুলনা করা যায় না এবং তা ঠিক নয়। দৃশ্যমান জগতের সঙ্গে অদৃশ্য বাস্তবতা বা ‘গায়েব’-এর গঠন প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপরীত ধর্মী। তাই তা তুলনার যোগ্য নয়। তুলনা করা যায় শুধুমাত্র সমজাতীয় বস্তুর মধ্যে। যেমন, এক ধরনের খাবারের সঙ্গে অন্য ধরনের খাবারের; এক ধরনের যন্ত্রপাতির সঙ্গে ভিন্ন ব্র্যান্ডের যন্ত্রপাতির। কিন্তু কলাগাছের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরের বৃহদাকার নীল তিমি’র তুলনা করা যায় না! এই প্রশ্ন করাই অযৌক্তিক। তেমনি দৃশ্যমান জগৎ ও অদৃশ্য বাস্তবতার’ তুলনা করা অযৌক্তিক। এমনকি আমরা যাকে অদৃশ্য বলছি- তা আমাদের সাপেক্ষে অদৃশ্য। সেই জগতে আমাদের প্রবেশাধিকার নেই। আমাদেরই দুর্বলতা। কিন্তু ‘অদৃশ্য জগতের বাস্তবতা’ ভিন্ন। অপেক্ষাকৃত হায়ার ডাইমেনশন (জগত) থেকে জিন জাতি আমাদের দেখতে পায়। তাদের বাস্তবতার চেয়ে ঊর্ধ্বেের ডাইমেনশন ফেরেশতাদের। সেখান থেকে তারা নিচের দু’টি জগতে দেখেন ও বিভিন্ন কাজ করেন। সবার উপরে আছে প্রকৃত বাস্তবতার জগৎ; মহান প্রভুর অবস্থান- আল্লাহর আরশ! প্রতিটি স্তরের বাস্তবতা, বস্তু সামগ্রী, প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুন ভিন্ন, গঠন প্রণালী ভিন্ন! এ অব্স্থায় ভিন্নধর্মী বিষয়বস্তুর মধ্যে তুলনা করা যায় না। কুরআনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই ভিন্নতা পরবর্তী আলোচনার মধ্যে উঠে আসবে।

দৃশ্যমান জগৎ থেকে অদৃশ্য জগতে মানুষের যাতায়াতের পদ্ধতি সম্পর্কে ওপরের আয়াতগুচ্ছের শুরুতেই উল্লেখ করেছেন মহান আল্লাহ। মানুষ প্রথমে ছিল মৃত। তাকে তিনি তৈরি করলেন ও জীবন দিলেন। এই পর্যায়টি ছিল অদৃশ্য জগতে। তারপর তিনি জীবন দেওয়ার প্রক্রিয়াটি পৃথিবীতে বা দৃশ্যমান জগতে ব্যবস্থা করে দিলেন। এরপর তিনি মৃত্যু দেবেন (দৃশ্যমান পৃথিবীতে)। তারপর আবার জীবন দেবেন। এটি হবে অদৃশ্য জগতের দিকে মানুষের পুনরায় যাত্রার প্রথম পর্ব। তারপর শেষ পর্যায়ে কিছু কাজকর্ম (হিসাব নিকাশ) শেষ করে তিনি তাঁর কাছে বা প্রকৃত বাস্তবতার জগতে (গায়েবে) ফিরিয়ে নেবেন।

দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন জগতের মধ্যে যাতায়াতের অন্যতম পদ্ধতি, মাধ্যম বা প্রক্রিয়া হলো মৃত্যু।

এ অবস্থায় মহাজগতের প্রভুর বক্তব্য অনুযায়ী, যেসব বিজ্ঞানীরা অদৃশ্য জগৎ বা রহস্যময় জগতে যাবার স্বপ্নে বিভোর–তাদের আশায় গুড়ে-বালি। বরং, ‘সামাওয়াত ওয়াল আরদের’ এই দৃশ্যমান জগতেই মানবজাতির প্রজন্ম শুধুমাত্র দেখা (শেষ তো দূরের কথা) ভালমতো শুরুই করতে পারেনি এখনও! কারণ, বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি উপলব্ধি করেছেন যে- মহাকাশের স্পেস বা মহা-শূন্যস্থান ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। তাও আবার আলোর গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে! এই দশার কিছুটা ধারণা করা যায়কিন্তু বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করা যায় না। বরং “ তিনিই তোমাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর সবকিছু”; মানুষের উচিত পৃথিবীতে যা আছে এবং তার কল্যাণকর বিষয়গুলো অনুসন্ধান ও ব্যবহার করা। সেই ইঙ্গিত মানুষকে দিয়েছেন মহাজগতের প্রভু। উন্নত বিশ্বের একদল গবেষক দিন-রাত সেই কাজেই ব্যস্ত রয়েছেন।

যাই হোক, মানব-ইতিহাসে ফিরে আসি। মহান রব্বুল আলামিন মালাইকাদের বললেন- “আমি পৃথিবীতে খলিফা (প্রতিনিধি) বানাতে যাচ্ছি।

একটু দাঁড়ান! মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের কেন বলতে যাবেন, তিনি কী সৃষ্টি করছেন, কোথায় কী কাজে লাগাবেন ইত্যাদি? কেমন ব্যাপার এটা? মহান আল্লাহ তাঁর অসীম জ্ঞান দিয়ে অসীম সংখ্যক জিনিস সৃষ্টি করছেন। কাউকে জানাতে তিনি বাধ্য না। তাঁর সে প্রয়োজনও নেই। তিনি সব প্রয়োজন, সব চাহিদার ঊর্ধ্বে। তিনি মহা পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী, মহান স্রষ্টা।

তাহলে?

বাস্তবসম্মত উত্তর একটাই। তাহলো- মানুষের সৃষ্টির বিষয়টি ফেরেশতাদের জানা প্রয়োজন। পাশাপাশি, আল্লাহ আল-কিতাবে এই ঘটনা উল্লেখ করে মানুষকেও জানার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এর কারণও একটাই। মানুষেরও তা জানা প্রয়োজন। যে ফেরেশতারা আমাদের সম্পর্কে জানে এবং আমাদের জন্য অনেক কিছু করে, তাদেরকে আমাদের বিশ্বাস করা প্রয়োজন।

আল-কুরআন থেকেই আমরা জানতে পারি, মানবজাতির প্রতিটি সদস্যের রক্ষণাবেক্ষণ, জীবন চলার পথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার সুরক্ষা, মৃত্যু দেওয়া, মৃত্যুর পর মানুষটিকে (নফসকে) আল্লাহর কাছে নিয়ে যাওয়া—ইত্যাদি নানা কাজে জড়িয়ে থাকেন ফেরেশতারা। তাঁদের একটি দল মূলত মানুষের এই প্রক্রিয়াগুলো বাস্তবায়ন করে দেন বন্ধুর মতো। তাই মানবজাতিকে মেনে নেওয়াফেরেশতাদের জন্য জরুরি।

কিন্তু এক্ষেত্রে আল্লাহ সরাসরি হুকুম দিতে পারতেন- মেনে নাও, মানুষকে সাজাদা করো- তাহলেই হতো! আল্লাহপাক তা করেন নি। তিনি চমৎকার করে ফেরেশতাদের কাছে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি কী করতে যাচ্ছেন, তাদের কাজ কী এবং সেই কাজে ভূমিকা রাখার জন্য- তাদেরকে মেনে নাও। ফেরেশতাদের এই দলে জিনছিল। এ ঘটনা পরে উল্লেখ করা হবে।

বিরাট এই ঘটনার এই অংশ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে- ফেরেশতাদেরকে কাজ করানোর ক্ষেত্রেও মহান আল্লাহ ধাপে ধাপে তাদেরকে প্রস্তুত করেছেন; আমাদের ভাষায় আমরা যেসব উন্নত চরিত্র বৈশিষ্ট্যকে নম্রতা‘ ‘ভদ্রতাদিয়ে বর্ণনা করি- সেই ভালো গুণগুলোর সবই তো মহান আল্লাহর। তাহলে তিনি নিজে কি সেই মহান গুণের সামান্যতম ব্যবহার তাঁর নিজের সৃষ্টির প্রতি করবেন না?! তিনি কিন্তু তা করেছেন- তাঁর ফেরেশতাদের তিনি কাজের হুকুম দেওয়ার আগে জানিয়েছেন যে তিনি কী করতে যাচ্ছেন। মহা-পবিত্র মহা-সম্মানিত মহান রবের প্রতি অফুরন্ত কৃতজ্ঞতা। যিনি আমাদের শিক্ষা দিলেন- আদব-কায়দা-নিয়ম-নীতি। আলহামদুলিল্লাহ!

এখানে আবারও আরেকটি ঘটনা ঘটে। 

  • তারা বলেছিল- আপনি কি সেখানে এমন কাউকে বানাবেন, যারা সেখানে ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত করবে; আমরা স্বাভাবিকভাবে কাজ করছি (কাজ এগিয়ে নিচ্ছি)- এভাবেই আপনার প্রশংসা করছি আর আমরা আপনার পবিত্রতা জানাচ্ছি।

প্রচলিত অনুবাদের ধরণ দেখে মনে হয়- ফেরেশতারা মহান আল্লাহর সঙ্গে কিছুটা বাদানুবাদ করছে। অথবা মহান আল্লাহর কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে(!) বিস্ময় প্রকাশ করছে! (নাঊযুবিল্লাহ!)

বিষয়টি মোটেও তেমন হবার কথা নয়, তেমন হবার সুযোগও নেই। বিষয়টি হলো- ফেরেশতারা তাদের কৌতূহল প্রকাশ করেছে মাত্র। ফেরেশতারা তাদের শিক্ষা ও জ্ঞান থেকে যা বুঝতে পেরেছেন তার ভিত্তিতে রব্বুল আলামিনের কাছে তাদের কৌতূহল ব্যক্ত করেছে। অর্থাৎ, সব ফেরেশতা অথবা মানুষ-সংশ্লিষ্ট বিশেষ একদল ফেরেশতা (مَلٰٓىِٕكَةِ) এমন কৌতূহল ব্যক্ত করেন। তারাও চিন্তা-ভাবনা করতে পারে; তারাও বিবেচনা করতে পারেহিসাব-নিকাশ করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা করতে পারে। সবশেষে আবারওআল্লাহ ফেরেশতাদের জানাচ্ছেন এবং তার প্রেক্ষিতে ফেরেশতারও আরও জানার জন্য মহান আল্লাহর কাছে তাদের কৌতূহল জানালো। 

ফেরেশতারা তাদের কৌতূহল থেকে বললো- তারা বললো- আপনি কি এমন কাউকে বানাবেন যারা তাতে ফ্যাসাদ ও রক্তপাত ঘটাবে..

খেয়াল করুন- ফেরেশতা কীভাবে জানলো যে, মানুষের দেহ রক্তমাংসের তৈরি এবং তাতে ‘রক্ত’ ‘পাত’ হয়? অথবা, মানুষ রক্তপাত ঘটাতে পারবেঅথবা, মানুষ যমিনে (আরদে) ফ্যাসাদ সৃষ্টি করতে পারে? অথবা, পৃথিবীতে মানুষের মন্দ কাজ করার ক্ষমতা থাকবে? ফেরেশতারা কোন ধরনের ঈলম রাখে- যার ভিত্তিতে তারা আগাম এসব বিষয় ধারণা করতে পারে? তবে, তাদের ধারণা সত্য ছিল। পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া আর কে বিপর্যয়/ ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে? পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া আর কে রক্তপাত, খুন, হত্যা ও ধ্বংসের পৈশাচিক আনন্দে লিপ্ত হয় !?!

এসব প্রশ্নের উত্তর কয়েকটি। প্রথমত, ফেরেশতারা জানতেন আরদ বা যমিনে (পৃথিবীতে) যেসব প্রাণী আছে ও বাস করে তাদেরকে রক্ত-মাংসের দেহধারী হতে হয়। বৃহত্তম প্রাচীন ডাইনোসর, বর্তমানের নীল তিমি থেকে শুরু করে মশা-মাছি এমনকি অদৃশ্য ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার দেহ’ রয়েছেএকটি কাঠামো রয়েছে; যাতে তরল পদার্থ রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ফেরেশতারা জানতেন (خَلِیْفَةً) খলিফা বা প্রতিনিধি বা a vicegerent শব্দটির মানে কী? আল্লাহ যাকে খলিফা’ বানাবেন, সে ভালো ও মন্দ দুই ধরনের বিপরীতধর্মী আচরণ বা কাজের ক্ষমতা রাখবে।

তৃতীয়ত, ফেরেশতারা মহান রবের বিশাল সাম্রাজ্যে (দৃশ্যমান ও অদৃশ্য জগতে) নানা কাজ করেন। তারা শৃঙ্খলা ও সুসামঞ্জস্য বজায় রাখার দায়িত্বে মহাব্যস্ত থাকে। সেখানে মানুষ ফ্যাসাদ ও রক্তপাত ঘটানোর ক্ষমতা পাবে এবং তা করবে! ফেরেশতাদের যে ক্ষমতা নেই, মানুষকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সেই ক্ষমতা হলো খুবই কম পর্যায়ে (পৃথিবীতে)- কোনও কিছু তৈরি ও ধ্বংসের ক্ষমতা, নতুন কিছু বানানোর ক্ষমতা।

পরবর্তী পর্বে আমরা মানুষ সৃষ্টির ইতিহাসের দিকে নজর দেবো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *