মানুষের ইতিহাস (২)
কুর'আন রিসার্চ সেন্টার- কিউআরসি
সুরা বাকারার ২৯ নং আয়াতে দেখা যায়- ফেরেশতারা তাদের কৌতূহল থেকে বলেছিল– আপনি কি এমন কাউকে বানাবেন যারা তাতে ফ্যাসাদ ও রক্তপাত ঘটাবে..।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো- ফেরেশতাগণ কিছু মানুষের পক্ষ থেকে বিপর্যয় ও ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা করছিল। কিন্তু মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ‘ফ্যাসাদ ও রক্তপাত’ নয়। কী সেই উদ্দেশ্য? তাই আমরা অনুসন্ধান করবো।
২. মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য:
এই আয়াতগুলোর আগের আয়াতেই (২৭) আল্লাহ বলছেন-….আর যারা যমিনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে (ইয়ুফসিদুনা ফিল আরদ), তারাই ব্যর্থ- ক্ষতিগ্রস্ত (الْخٰسِرُوْنَ)। {২:২৭}
ঠিক এই বিস্ময়টিই বোধ করছিলেন ফেরেশতারা! মানুষ তো যমিনে (ইয়ুফসিদু ফিহা ওয়া ইয়াস্ফিকুদ্ দীমা) ফ্যাসাদ ও রক্তপাত ঘটাতে পারে- তখন কী হবে! তাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটছিল না।
আবার একই সঙ্গে যেসব প্রতিনিধি (خَلِیْفَةً vicegerent ) পৃথিবীতে অথবা চাঁদের বুকে, মঙ্গল গ্রহের বুকে গিয়ে ঝামেলা ও রক্তপাত ঘটাবে- তারা ব্যর্থ-ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ/নফস/আত্মা বলে প্রমাণিত হবে। এই সূত্রটিও আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এসব থেকে যারা দূরে থাকবে- তারা ভালো মানুষ বলে পরিচিত হবে।
কেন? কী দরকার? এই ভালো-মন্দ প্রমাণের প্রয়োজন কেন? গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটি। ধারণা করা যায়- মানুষকে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া বা জান্নাতে আনন্দ দেওয়ার জন্যই আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেন নি; সেক্ষেত্রে মানবজাতিকে ভাগাভাগি করে জান্নাত-জাহান্নামে দিলেই হয়ে যেতো। এটাই মানুষ সৃষ্টির প্রধানতম উদ্দেশ্য হতে পারে না। যদি তাই হতো- গোটা কুর’আনে জান্নাতের পূর্বশর্ত হিসাবে এক স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস ও আমলে সালেহ সংক্রান্ত ১০০টি আয়াত নাযিল করলেই হয়ে যেতো। কিন্তু তা করা হয়নি। বোঝা যাচ্ছে- গোটা কুর’আন-জুড়ে যেভাবে মানবজাতিকে ধরে ধরে আল্লাহ তৈরি করছেন- তা ‘মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য‘ বাস্তবায়নের একটি প্রক্রিয়া।
পৃথিবীতে শুধু ভালো ও মন্দ নফস/ আত্মা/ মানুষগুলো বাছাই করা হচ্ছে। যে যত ভালো কাজই করুক- সে ভালো মানুষ। যে যত খারাপ কাজই করুক- সে খারাপ মানুষ। আবার কাজের মাধ্যমে আল্লাহর রহমতে খারাপ মানুষ ভালো হয়ে যায়। আবার অপকর্মের কারণে, অনেক ভালো মানুষও দিন শেষে ‘খারাপ‘ ক্যাটাগরিতে পড়ে যেতে পারে। মূলত এই দুই দল পৃথক করাই ‘পৃথিবীর মিশন‘।
ইতিহাস থেকে দেখা যায়, মহান আল্লাহ সবসময়ই মানুষকে ভালোর দিকে টেনে আনার জন্য নবী রসুল কিতাব পাঠিয়ে আসছেন। জীবন চলার পথের দিশা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তিনি কাউকে জোর করছেন না, বাধ্য করছেন না। তিনি মানুষের সঙ্গে যুক্তি-তর্ক, বিবেক-বোধ, অন্তরচক্ষু জাগ্রত করার মতো কথা বলেন। যেমন, এই আলোচনা শুরুর আয়াতেই তিনি বলছেন- “তোমরা কীভাবে আল্লাহকে অস্বীকার করছো, অথচ তোমরা ছিলে মৃত, তারপর তিনিই তোমাদের জীবন দিয়েছেন; পুনরায় তিনিই তোমাদের মৃত্যু দেবেন….” এখন একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আরে কে কবে দাবি করেছে যে- সে মানুষকে জীবন দেয়? কেউ করেনি করতে পারে নি। প্রত্যেক চিন্তাশীল মানুষই জানে, পৃথিবীতে পদার্পণের ১ বছর আগে সে মৃত ছিল, অদৃশ্য ছিল, মাতৃগর্ভে আসার আগে পৃথিবীতে তার কোনও নাম-পরিচয়-অস্তিত্ব ছিল না। একইভাবে কিছুদিন, মাস, বছর, যুগ, শতাব্দী পর সে ফের অদৃশ্য হয়ে যাবে পৃথিবী নামের গ্রহ থেকে! এই অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণের বাইরে কোন্ মানুষ যেতে পারে? আল্লাহ বলছেন- যেন অনেকটা বিস্ময়ের সুর- তোমরা কীভাবে অস্বীকার করো ! (কাইফা তাকফুরুনা বিল্লাহ !! How can you disbelieve in Allah!!)
তাহলে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি? জান্নাত ও জাহান্নামে মানুষের আনন্দ ও আযাব ভোগ করাই যদি মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য না হয়- তাহলে মানুষের উদ্দেশ্য কি?
তার আগে বলা দরকার- যদি জান্নাত ও জাহান্নাম মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য হতো- তাহলে ১. আল্লাহ জান্নাত ও জাহান্নামকে চিরস্থায়ী করে দিতেন এবং ২. মানুষের মধ্যে থেকে ভালো ও মন্দ মানুষ আলাদা করে ওই জান্নাত জাহান্নামে দিয়ে দিলেই হতো।
কিন্তু তা হয়নি। ১. কুর‘আনে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে- জান্নাত ও জাহান্নাম চিরস্থায়ী নয়! ২. তিনি মানুষকে নিজের ঈলম দিয়ে বাছাই করেন নি। বরং, মানুষের নিজের ঈলম ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছেন। সেজন্য জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন এবং জাহান্নামের শাস্তির ভয় আগাম জানিয়েছেন। অবশ্য পরিণাম কী হবে- তা তিনি তাঁর অসীম ঈলম বা জ্ঞান দিয়ে জানেন। কিন্তু তিনি জিন ও মানুষকে বাধ্য করেন নি। নিচের আয়াতগুলোতে জান্নাত ও জাহান্নামের স্থায়িত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। মানুষ জান্নাত ও জাহান্নামের স্থায়িত্ব পর্যন্ত ‘চিরকাল থাকবে’।
- দুর্ভাগারা থাকবে জাহান্নামে; সেখানে তাদের জন্যে থাকবে শুধু চিৎকার, আর্তনাদ!
সেখানে স্থায়ীভাবে থাকবে তারা- যতদিন মহাকাশ ও যমিন-সমূহ বিদ্যমান থাকবে, যদি না তোমার প্রভু ভিন্ন কিছু চান। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু যা চান তাই করেন।
আর যারা সৌভাগ্যবান- তারা থাকবে জান্নাতে; চিরকাল তারা সেখানে থাকবে; যতদিন বিদ্যমান থাকবে মহাকাশ ও যমিন-সমূহ; যদি না তোমার প্রভু ভিন্ন কিছু চান। এ এক অনন্ত অবিরাম পুরস্কার। {১১:১০৬,১০৭,১০৮}
এই আয়াত থেকে যে সুস্পষ্ট বার্তা পাওয়া যায়, তা হলো-
- যতদিন সামাওয়াত-আরদ থাকবে, ততদনি জান্নাত ও জাহান্নাম থাকবে।
- মহাজগতের প্রভু যদি ভিন্ন কিছু চান- তাহলে সেটাও বাস্তবায়িত হবে।
জিন ও মানুষ তো তাঁরই ইবাদ। তাঁর দেওয়া স্বাধীনতার শক্তি বা ইবাদত করে জিন ও মানুষ। এই শক্তি ব্যবহার করে কে নিজেকে কোন্ দলভুক্ত করবে- সেই অবাধ স্বাধীনতা ও প্রমাণ করার সুযোগ আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন। অন্য সবকিছুর পথ, কাজের পদ্ধতি ও কাজ উপযোগী করে তাদের তৈরিও করে দিয়েছেন আল্লাহ। কিন্তু জিন ও মানুষকে দিয়েছেন স্বাধীনতা। বলে দিয়েছেন- ইল্লা লিয়া‘বুদুন বা ‘শুধুমাত্র আমার ইবাদত ছাড়া’ আর কিছুই করার নাই। মানুষ যাই করুক-না-কেন, তা আল্লাহর দেওয়া স্বাধীনতার শক্তিরই ব্যবহার। মানুষের সৃষ্ট বা তৈরি কিছু না। তাই সঠিক পথে কাজ করার জন্য গাইডলাইন বা হুদা পাঠিয়েছেন মহান রব।
মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যের দিকে নজর দেওয়া যাক। জান্নাত জাহান্নাম যদি মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য বা মানুষ সৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্য না হয়–তাহলে মানুষের সৃষ্টির চেয়েও জটিল বা উন্নত/ বৃহত্তম/ সুবিশাল সৃষ্টি থাকার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কী সেটা? আল-কুর‘আন কি তেমন কিছু বলেছে?
- নিশ্চয়ই মহাকাশ ও যমিনসমূহের সৃষ্টি বৃহত্তম (اَكْبَرُ আকবারু মিন খলকিন নাস) মানুষ সৃষ্টির চেয়ে; কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ সে জ্ঞান রাখে না। {৪০:৫২}
খেয়াল করুন। মানুষের সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে দৃশ্যমান জগতের বস্তু-সামগ্রীর। মহাকাশ ও যমিনে যা কিছু আছে- মানুষ যা দেখতে পায় এবং যা দেখতে পায়না যেমন শূন্যস্থান! ‘এক গ্লাস শূন্যস্থান‘ কোনও মানুষ কি তৈরি করতে পারবে? এজন্য যে পরিমাণ শক্তি/এনার্জি প্রয়োজন তা মানুষ কোনোদিন সৃষ্টি করতে পারবে না। আর আল্লাহ বলছেন- এই সামাওয়াত ওয়াল আরদের অস্তিত্ব সৃষ্টি করা মানুষ সৃষ্টির চেয়েও আকবারু বা বিশাল- বিরাট- বৃহত্তম বিষয়। উল্লেখ্য, সামাওয়াত ওয়াল আরদ অর্থ হলো- স্তরে স্তরে সজ্জিত আকাশ ও যমিনসমূহ।
এই দৃশ্যমান জগতেই যদি মানুষের সৃষ্টির চেয়ে ‘আকবারু সৃষ্টি’ থাকে- তাহলে মহান রব আরও যে সব জগৎ সৃষ্টি করে রেখেছেন- সেখানকার সামগ্রীর কী হবে? সেগুলো কত বড়? যেমন জান্নাত। তার সঙ্গে কী মানুষের অথবা দৃশ্যমান জগতের কোনও কিছুর তুলনা করা যায়? অবশ্যই না। যেমন- তুলনা কার সঙ্গে কার করা যায়, তা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। সেই অদৃশ্য জগতে কি মানুষ যেতে চায়? মানুষ তো এখনই অদৃশ্য জগতে যেতে চায়, আলোর গতিতে ছুটতে চায়, গ্যালাক্সির অপর প্রান্তে যেতে চায়। এসব কাজ বিজ্ঞানীরা শত শত বছর ধরে করে আসছেন। আবার আধ্যাত্মিক সাধকরা ‘মোরাকাবার’ (ধ্যান-সাধনার) মাধ্যমে ‘রুহ-জগতেও’ পৌঁছাতে চায়, একদল ভণ্ড অদৃশ্য জগতের জিনদের রাজ্যেও নাকি চলে যায়! এই যে- সব পর্যায়ের মানুষের মধ্যে বহুদূর ছুটে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা— তা কিন্তু মিথ্যা নয়; এই চাওয়া কিন্তু মানুষের নিজের তৈরি নয়! বরং মহান আল্লাহর দেওয়া একটি নিয়ামত হলো এই ‘আকাঙ্ক্ষা’!
এটা হতেই পারে যে- জান্নাত জাহান্নাম পরবর্তী যুগে মানুষের জন্য রয়েছে আরও অনেক কিছু। আরও অনেক দায়িত্ব। কিন্তু দায়িত্ব মানেই কষ্টকর, অসাধ্য কিছু নয়।
যেমন, ফেরেশতারা প্রতি মুহূর্তে কত কাজ করছেন- এটা তাঁদের জন্য অসাধ্য- ঘাম ছুটে যায়- এমন কিছু নয়। বরং তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রশান্ত চিত্তে কাজ করার (ইবাদত) মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি এবং নিজের আনন্দের মধ্যেই আছেন। নিঃসন্দেহে মানুষ তার ব্যতিক্রম হবে না।
শুধুমাত্র- পৃথিবীতে যাচাই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা বা সাময়িক পরীক্ষা আল্লাহ নিয়ে থাকেন। তবে- বালা-মুসিবত-বিপর্যয় যা আসে, তা আল্লাহর দেওয়া নয়। সেসব মানবজাতি নিজেরা তৈরি করে। আল্লাহ বরং বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে মানবজাতিকে বার বার রক্ষা করেন।
তিনি মানবজাতিকে জানিয়েছেন, মানুষকে কোন কোন বিষয়ে পরীক্ষা করা হবে। তা সুস্পষ্টভাবে কিতাবে উল্লেখ করে দিয়েছেন।
- আর আমরা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করবো কিছু জিনিস দিয়ে যেমন- ভয়, ক্ষুধা, এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে; আর সুসংবাদ (وَبَشِّرِ) সবর-কারীদের।
যারা বিপদ-আপদে পড়লে বলে- নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয়ই তাঁরই কাছে ফিরে যাবো।
এরা তারা- যাদের ওপর তাদের রবের সালাওয়াত (সালাওয়াত মির রব্বিহিম) ও রহমত; আর তারাই হিদায়াত প্রাপ্ত (মুহতাদুন)। {২:১৫৫-১৫৭}
পরবর্তী পর্বে- মানুষের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ফেরেশতাদের ‘আগাম জানার’ বিষয় ব্যাখ্যা করা হবে।