তথাকথিত ইসলামিক নাম!

তথাকথিত ইসলামিক নাম !

কুর'আন রিসার্ট সেন্টার- কিউআরসি

যখনই কোনো মানুষ ইসলামে ধর্মান্তরিত (!)হতে চায়, তখনই তাকে নয়া বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাম রাখার দাবি জানানো হয়। এমন কি নতুন জন্ম নেওয়া সন্তানকেও আরবীয় বৈশিষ্ট্যের অথবা ফারসি শব্দযুক্ত নাম দেওয়া হয়। পাশাপাশি, নবী, রাসুল, তাঁদের আত্মীয়, স্বজন, সঙ্গী-সাথীদের (সাহাবি) নামগুলো দেওয়া হয়। এর পেছনে কাজ করে ওই নাম ধরে পুলসেরাত পার হবার একা আকাঙ্ক্ষা! ধারণা ও আশা করা হয়নতুন সন্তানটি হয়তো ওই নামের ব্যক্তির মতোই একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে। এমন নানা ধরণের ধারণা, অনুমান কল্পিত আশা-ভরসার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা নামকে বলা হয় ইসলামিক নামএবং মুসলিম নাম। অনেক ক্ষেত্রেই তা বাধ্যতামূলক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, এ বিষয়ে কুরআনিক দৃষ্টিকোণ কী? সেটাই আজ জানার চেষ্টা করবো।

বাস্তবতা হলো, একটি আরবীয় বৈশিষ্ট্যযুক্ত নামের ধারণাটি শুধু ভ্রান্ত ধারণাই নয়, বরং এটি এমন একটি উদ্ভাবন- কুরআনে যার বিন্দুমাত্র ভিত্তি নেই! কুরআন অধ্যয়নকারী যে কেউ মাত্রই বুঝতে পারেন যে- তথাকথিত ইসলামিক নামবা মুসলিম নামবলে কিছু নাই। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন যে মহাসত্যের উপর জোর গুরুত্ব দেয়, তা হলো- ইসলাম (মহান স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ)। যা মূলত মন-হৃদয়-অন্তরের একটি অবস্থা। মানসিক এই অবস্থার ওপর ভিত্তি করে বাস্তব জীবনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে হবে। যার ওপর নির্ভর করে চূড়ান্ত সফলতা লাভের বিষয়। এর সঙ্গে ব্যক্তির নাম-ধাম, বংশ পরিচয়, দেশ-কাল-গোত্র, চামড়ার রং, ভাষা… ইত্যাদির বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নাই। বরং, চূড়ান্ত সফলতা লাভের সঙ্গে তথাকথিত জাতীয়তা বা আঞ্চলিকতার বিষয় যুক্ত করা, সেরূপ ধারণা ও বিশ্বাস তৈরি করা, তার অনুশলীন ও চর্চা করা নিছক অপকর্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া বিষয়!

মনে রাখতে হবে, আরবি ভাষার শব্দ দিয়ে নাম রাখার কোনো নির্দেশনা, বাধ্যবাধকতা ও নিষেধাজ্ঞা আল-কুর’আনে নাই। এহেন সংকীর্ণ মানসিকতা থেকেও সুমহান এই গ্রন্থ বহু যোজন ঊর্ধ্বে অবস্থান করে।

ওহি নাযিল হবার পর স্বয়ং মোহাম্মদ রসুলুল্লাহ কিংবা হজরত ঈসা আ., হজরত মুসা আ., হজরত ইবরাহিম আ. অথবা অন্য কোনো নবী রসুল নিজের নাম পরিবর্তন করেন নি।

শেষ নবীর সাহাবি হিসেবে যাঁরা পরিচিত তাঁরাও কাফের/মুশরিকদের দলে থাকার সময় এবং মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী) হবার পর নিজেদের আরবি ভাষার নাম পরিবর্তন করেন নি। তাঁরাও জাহেলি যুগের প্রচলিত নামেই পরিচিত ও সম্মানিত হয়েছিলেন।

এহেন অবস্থায় সাহাবিদের মতো নও মুসলিমদের নাম পরিবর্তন করার শিক্ষা কোথা থেকে এলো?!?! অথবা, আরবি ভাষার শব্দ দিয়ে পৃথিবীতে সদ্য আগত বাচ্চার নাম রাখার মানসিকতা কীভাবে তৈরি হলো?

প্রকৃতপক্ষে, ‘ইসলামিক নামের‘ ধারণাটি মানুষের নিজের উদ্ভাবিত একটি পদ্ধতি। যা মূলত ধর্মীয় আমেজে দিয়ে ‘আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সান্নিধ্য/ আন্তরিকতা/ ভালোবাসা/ নেক নজর লাভের উপায় হিসেবে অবচেতন মনে সক্রিয় থাকে। যার আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্যতা নাই। 

আপনি যদি ‘ইসলাম গ্রহণ করতে ইচ্ছুক’ বা সুমহান স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণ করতে আগ্রহী একজন মানুষ হন, তবে তারা আপনাকে মুহাম্মদ, আলী, আহমদ, খাদিজা, ফাতিমা বা জয়নবের মতো একটি নাম বেছে নিতে উৎসাহ দেওয়া হবে। যা চরম সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচয়।

ভেবে দেখুন,

আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলি, যয়িদ, সাবিত, সাদ, জুলকারনাইন, জায়েদ, হুসাইন, আহমেদ, উমর, খাদিজা, ফাতিমা, জয়নব… ইত্যাদি বিখ্যাত শব্দগুলো কি “ইসলামিক নাম“? নাকি এগুলো শুধুই আরবি নাম ? তা ছাড়া “ইসলামিক নাম” বলে আদৌ কি কিছু আছে ?

উত্তর হলো- এসবই আসলে আরবি নাম বা সেই ভাষার শব্দ। পাশাপাশি, মহাগ্রন্থে “ইসলামান” (ইসলামিক) বলে কোনো শব্দ, ধারণা ও তথ্য দেওয়া নাই। যে কোনো কিছুকে “ইসালামান” বা “ইসলামিক” বানানোর কোনো দিক-নির্দেশনাও নাই। বরং, এটি একটি গভীর চক্রান্ত যা শেষ নবীর ওফাতের পর চালু করা হয়।

পাশাপাশি, মনে রাখতে হবে, মহান আল্লাহ প্রথম মানব বা জনাব আদমকে সব কিছুর নাম (বা নামকরণ পদ্ধতি) শিখিয়েছিলেন। (২:৩১)

এজন্যই দেখা যায়, ভারতবর্ষে জন্ম নেওয়া মেয়েগুলোর নাম হয়, কুসুমবালা, মরিয়ম, দিপিকা, ইত্যাদি। আর, সুদূর ইউরোপে পাওয়া যায় মেরি, এলিজাবেথ, খেইট ইত্যাদি। (পাশাপাশি, পুরুষদের নামগুলোও উল্লেখযোগ্য)। 

স্থান, কাল ও ভাষা-ভেদে মানুষের নামের বৈচিত্র্যময় পরিবর্তন দেখা যায়, যা বর্ণ-গোত্রের মতোই একটি বৈশিষ্ট্যময় সৌন্দর্য। এই ভৌগোলিক বাস্তবতা ও সত্যতাকে উপেক্ষা করা এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে অবজ্ঞা করা- একই ধরনের অপকর্ম নয়কি?

অধিকন্তু, ইসলাম বা সুমহান একক স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণ একটি সর্বজনীন বিশ্বাস; যা কোনো সংস্কৃতি, জাতি, বর্ণ বা নামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, নির্ভরশীলও নয়। তাই, কারও ওপর জোর করে আরবি নাম চাপানোর মধ্যে কোনো কল্যাণ লাভের কোনো সুযোগ নাই। বরং, উল্টো তা ইসলামের সর্বজনীন রূপ বিরোধী সংকীর্ণ আচরণ।


প্রথম প্রকাশ: ৬ ডিসেম্বর ২০২২।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *