ইন শায়া আল্লাহ মানে কি?
কুর'আন রিসার্চ সেন্টার- কিউ আর সি
১.
শত সহস্র বছর ধরে চতুর-ধূর্ত পারসিক ইমাম ও আরবের পথভ্রষ্ট শয়তানের অনুসারীরা সহজ সরল ভালো মানুষদের বোকা বানিয়ে রেখেছে। অনেকেই সেই বেড়াজাল থেকে বেরুবার চেষ্টা করেছেন। তবে, বিশেষ একটা সফল হননি।
মহান রবের পাঠানো অতীতের কিতাবগুলোর সঙ্গে অন্যায়কারী মানুষ যে অসদাচরণ করেছে, সেই একই অপকর্ম আল-কুর’আন নাযিলের পরও করা হয়েছে। আর তা হলো, মহাগ্রন্থের শব্দের অর্থগুলো পরিবর্তন করে মানবজাতিকে ধোঁকায় ফেলা।
এরকম শত-হাজার শব্দের মধ্যে একটি হলো ‘ইন-শায়া-আল্লাহ’ শব্দ বা বাক্যাংশটি। এর অর্থ কি?
পূর্বপুরুষ ও চলে আসা শিক্ষা অনুযায়ী সবাই বলে, যদি আল্লাহ চান..
ইন (اِنۡ): যদি ।। শায়া (شَآءَ): চান ।। আল্লাহ (اللّٰہُ): আল্লাহ
আসলে কি তাই? চলুন যুক্তিবোধ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি।
২.
এখানে অপকর্মটি করা হয়েছে শুধুমাত্র শায়া [শায়া (شَآءَ): চান] শব্দটি নিয়ে। এর অর্থ চাওয়া নয়। বরং, শায়া (شَآءَ) অর্থ: উপযুক্ত/যোগ্য/সঠিক মনে করা, সঠিক বিবেচনা করা, উপযুক্ত গণ্য করা।
আরবি অভিধান থেকে অথবা নানা বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ থেকে আপনি নানা অর্থ পাবেন, নানা রুট-প্রোটোরুট, নানা তথ্য পাবেন। কিন্তু সঠিক অর্থটি জানা হবে না।
যাই হোক, ইন-শায়া-আল্লাহ কথাটির অর্থ: যদি আল্লাহ যোগ্য মনে করেন
ইন (اِنۡ): যদি ।। শায়া (شَآءَ): উপযুক্ত গণ্য করেন ।। আল্লাহ (اللّٰہُ): আল্লাহ
৩.
চলুন সামান্য ক’টি আয়াত দেখি।
- ২:৩৫ আর বললাম হে আদম (وَقُلْنَا يٰٓاٰدَمُ), তুমি ও তোমার সঙ্গী বাস করো জান্নাতটিতে (اسْكُنْ اَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ) এবং তোমরা তাতে স্বাচ্ছন্দ্যে খাও (وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا) যেখান থেকে উপযুক্ত মনে করো (حَيْثُ شِئْتُمَاۖ); তবে এই গাছটির কাছে যেয়ো না (وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ), তাহলে তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী/যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে (فَتَكُوْنَا مِنَ الظّٰلِمِيْنَ)!
- ২:৩৫ আর বললাম হে আদম (وَقُلْنَا يٰٓاٰدَمُ), তুমি ও তোমার সঙ্গী বাস করো জান্নাতটিতে (اسْكُنْ اَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ) এবং তোমরা তাতে স্বাচ্ছন্দ্যে খাও (وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا) যেখান থেকে উপযুক্ত মনে করো (حَيْثُ شِئْتُمَاۖ); তবে এই গাছটির কাছে যেয়ো না (وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ), তাহলে তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী/যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে (فَتَكُوْنَا مِنَ الظّٰلِمِيْنَ)!
–এই বাক্যাংশে শায়া আছে।
(وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَاۖ)… এটার অর্থ করা হয়েছে “তোমরা সেখানে যা ইচ্ছা তাই খাও “!! কী বিস্ময়কর চিন্তা ও কথা।
মনে করুন, বাবা আদম এবং তাঁর সঙ্গী হাঁটছিলেন। তখন তাঁরা দেখলেন যে, পায়ের নীচে হিরা, চুনি, পান্নার মাটি সরে সরে যাচ্ছে! তখন তাঁদের মনে হলো কামড়িয়ে খেয়ে ফেলি! তারপর আবার আইফেল টাওয়ারের মতো বিশাল একটি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। জান্নাতের গাছ- সুন্দর সুগন্ধযুক্ত হবারই কথা! যদি মনে হয়, এইটাকেও খেয়ে ফেলি! আবার একটা গজাবে তো। দৃশ্যটা চিন্তা করুন।
অথচ, প্রচলিত অনুবাদে এই ধারণাই দেওয়া হয়েছে। যেখান থেকে যা ইচ্ছা খাও!
অথচ, আয়াতাংশে বলা হয়েছে,
এবং তোমরা তাতে স্বাচ্ছন্দ্যে খাও (وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا) যেখান থেকে উপযুক্ত মনে করো (حَيْثُ شِئْتُمَاۖ)…
এরপর গরুর ঘটনা:
২:৭০ এর প্রচলিত অনুবাদে বলা হয়েছে :❌আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিশ্চয় আমরা পথের দিশা পাব।❌
অথচ, এখানে বলা হচ্ছে: …এবং আমরা নিশ্চয়ই (وَاِنَّا) যদি আল্লাহ উপযুক্ত গণ্য করেন (اِنْ شَاۤءَ اللّٰهُ) আমরা নিশ্চিত সঠিক পথ/দিশা পাবো ( لَمُهْتَدُوْنَ)।
প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহ ‘ইচ্ছা’ করবেন না কেন? আল্লাহ ইচ্ছা করলে, কেউ কি তাতে বাধা দেবে? সময়ের অভাব? অন্যান্য ব্যস্ততা? এমনটাও কি সম্ভব? আল্লাহ তো আমাদের স্বাধীন করে সৃষ্টি করেই দিয়েছেন। আমরা তাঁর কাছে চাইবো… দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা চাইবো। তিনি সঠিক-উপযুক্ত মনে করলে, আমাদের তা দেবেন।
আর, এই কুর’আনের ‘চাওয়া’ শব্দটির আলাদা আরবি আছে। তাহলে, শায়া-কে ‘চাওয়া’ বানানোর অসৎ উদ্দেশ্য ছিল বৈকি।
২:২৬ আয়াতেই আছে (مَاذَآ اَرَادَ اللّٰهُ) আল্লাহ কি চান (আরদা)?
৪:২৮ ইউরিদুল্লাহু আন.. (يُرِيْدُ اللّٰهُ اَنْ) আল্লাহ চান যে..।
আরদা (اَرَادَ) অর্থ চাওয়া বা ইচ্ছা করা! শায়া (شَاۤءَ) নয়। অন্তত ১১২ বার আরদা (اَرَادَ) শব্দের ব্যবহার হয়েছে। অন্যদিকে শায়া (شَاۤءَ) শব্দটি ২০৫ বার ব্যবহৃত হয়েছে।
৫:৪৮ নং আয়াতে যেখানে বলা হয়েছে, (وَلَوْ شَاۤءَ اللّٰهُ لَجَعَلَكُمْ اُمَّةً وَّاحِدَةً) ❌আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদের এক জাতি বানাতেন❌
আর যদি আল্লাহ উপযুক্ত মনে করতেন (وَلَوْ شَاۤءَ اللّٰهُ) নিশ্চিতভাবে তোমাদের বানাতেন (لَجَعَلَكُمْ) একক জাতি/উম্মত (اُمَّةً وَّاحِدَةً)…
সবাই ইউরোপিয়ান, আমেরিকান, আফ্রিকান বা মঙ্গোলিয়ান হতো। সেটা সঠিক বিবেচনা করেন নি আল্লাহ। তাই এত রকম জাতিগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে জগতে।
এখানে “আল্লাহ উপযুক্ত মনে করতেন” এর ক্ষেত্রে উপযুক্ত শব্দটাই কি বেশি উপযুক্ত নয়?
যদি বলেন, “আল্লাহ ইচ্ছা করতেন”, এমতাবস্থায় দুষ্ট মনে প্রশ্ন উঠবে, আল্লাহ ইচ্ছা করেন-নি কেন? কিসের পিছুটান? কিসের ভয়? কিসের দ্বিধা-সংশয়? কিসের সীমাবদ্ধতা??? এরকম আপত্তিকর চিন্তার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা অনুবাদে। মহান আল্লাহকে নিয়ে এভাবে চিন্তা করা মহা অন্যায়।
হয়তো কেউ বলবে, আল্লাহ চান-নি কারণ, তিনি সঠিক মনে করেন না। তাহলে ফের প্রশ্ন উঠবে, তাহলে চাওয়ার কথা উঠানো হলো কেন? যা সঠিক না- তা চাওয়া কথা আল্লাহ বলবেন? অতএব এই নির্বোধ যুক্তি ধোপে টিকবে না।
মনে করুন, আপনার এখন বিমানে উঠতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু আপনি উঠছেন না। কেন? কারণ, আপনার সে সুযোগ নাই। অর্থাৎ, সীমাবদ্ধতা আছে। আপনি যা-কিছুই চান, তা করতে পারছেন না? কেন??? কিসের বাধা??? নিশ্চয়ই কোনো একটা বাধা/প্রতিবন্ধকতা/সীমাবদ্ধতা/দুর্বলতা/যোগ্যতার অভাব/ক্ষমতার অভাব/শক্তির অভাব—কোনো না কোনো অক্ষমতার কারণেই আপনি-আমি-আমরা “যাহা চাই তাহা পাই না”।
তাইনা?
এভাবেই, আল্লাহ যদি চান/চাইতেন… বলে আপনি সুমহান, সর্বক্ষমতাধর, সর্বস্রষ্টা, সর্বসীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে যিনি- তাঁকে কী করলেন আর কী বললেন????
মহান আল্লাহ আমাদের মাফ করুন!
প্রথম প্রকাশ: ৮ অগাস্ট ২০২৩