আত্মা- Soul (নফস ও রুহ)
ভূমিকা
মানুষের রহস্যময় আত্মা এবং আরও রহস্যময় ও অদৃশ্য মহান স্রষ্টা ‘আল্লাহ’ সম্পর্কে নানা তথ্য গোটা কুর’আন শরীফে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এসব তথ্য একত্রিত করা এবং মহান রবকে আরও ভালভাবে জানার জন্য পদ্ধতিগতভাবে চিন্তা করা হয়েছে ধারাবাহিক এ প্রবন্ধে।
মানব-আত্মার গঠন, প্রকৃতি, উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায়- তার সঙ্গে কুর’আনে বর্ণিত ‘সামাওয়াত ওয়াল-আরদ’ এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ‘সামাওয়াত ওয়াল-আরদ’ এর বাংলা- মহাকাশ ও যমিন।
তাই এখানে সংক্ষেপে মহাবিশ্ব নিয়ে আলোচনা করা হলো এবং প্রাসঙ্গিকভাবে মানুষ, জ্বিন ও ফেরেশতারা চলে এসেছে। কারণ, তারাও এই সুবিশাল, রহস্যময় ও ভয়ঙ্কর মহাবিশ্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষ করে জিন জাতি। বলে রাখা ভালো, কুর’আনে বর্ণিত ‘জিন’ মানুষের ধারণা অনুযায়ী কোনো ভূত-প্রেত টাইপের বস্তু নয়। বরং মহান আল্লাহর সৃষ্ট আরেক ধরণের প্রাণী যারা মূলত এই স্তরে স্তরে সজ্জিত সপ্ত আসমানের ‘সামাওয়াত’ বা মহাবিশ্বের প্রধান অধিবাসী।
এখানে মানুষের রক্ষণাবেক্ষণে ফেরেশতাগণের ভূমিকা আলোচনা করা হয়েছে। কুর’আন থেকে ধারণা করা যায় যে, ফেরেশতাদের সাম্রাজ্য একটি বিশাল সাইবারনেটিক সিস্টেমের মতো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। প্রাসঙ্গিক আয়াত দিয়ে তা আলোচনা করা হবে।
এ প্রবন্ধে নফস্ (আত্মা), রুহ (আত্মা) ও কলব (মন) সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কীভাবে এ ব্যবস্থাগুলো কাজ করে- তা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের নফসের সঙ্গে রুহের পার্থক্য, নফসের বিকশিত হওয়া এবং তার প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বাস করি- এ বিষয়গুলো জানা খুব জরুরি। যা জগৎ-সংসার, ধর্ম-কর্ম, সৃষ্টি-স্রষ্টা নিয়ে মানুষের চিন্তা ও ধ্যান-ধারণাকে উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করবে।
পরিশেষে, সৃষ্টিজগতে ‘আল্লাহর প্রতিনিধি’ হিসেবে মানুষের সম্মান, মর্যাদা ও ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হবে। মহান প্রভু কুর’আনে বলেছেন-
Are you a Stronger creation or is the Universe? Allah constructed it. [Al Quran 79:27]
তোমারাই কি শক্তিশালী সৃষ্টি নাকি মহাবিশ্ব- যা তিনি সৃষ্টি করেছেন। [আল কুর’আন ৭৯:২৭]
মহা বিস্ময়কর মহাবিশ্বে মানুষ কীভাবে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে ও করবে- সে সম্পর্কে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে ধারাবাহিক প্রবন্ধে।
আলোচনায় বিজ্ঞানের সাধারণ ও প্রতিষ্ঠিত ধারণা দিয়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্যের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর প্রধান উদ্দেশ্য বিষয়টি আরও সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করা। বাস্তবতা হলো- আমাদের বিশ্বাস মজবুত করার জন্য মহাগ্রন্থ আল-কুর’আনই যথেষ্ট।
অধ্যায় ১: আত্মা বা Soul
প্রথমে আত্মা সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্যগুলো জানার চেষ্টা করব। আশা করা যায়- আত্মা সম্পর্কে জানার মাধ্যমে মহান প্রভুর অন্যান্য সৃষ্টি সম্পর্কে বোঝা যাবে- যা অদৃশ্য।
আমাদের চারপাশে বেশ কিছু ‘আত্মার’ অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়; কিন্তু সেগুলোকে ‘আত্মা’ বা Soul হিসেবে আমরা সচরাচর চিনতে পারি না। কারণ তার ভিন্ন নামকরণ করা হয়েছে।
চলুন তাহলে চেনার চেষ্টা করা যাক। প্রথমেই দেখি, আত্মা বা Soul কী?
১. আত্মা ও ফোর্স ফিল্ড (শক্তি ক্ষেত্র) Soul and Force Field
আমরা বুঝতে পারি যে, মানুষের আত্মা তার চরিত্র, স্বভাব ও প্রকৃতি নির্ধারণ করে থাকে এবং ‘মূল জীবিত সত্তা’ হিসাবে মানবদেহে টিকে থাকে। আত্মার দেহত্যাগেই মানবদেহের মৃত্যু নিশ্চিত হয়। কিন্তু, মানুষের আত্মাকে সুষ্পষ্টভাবে ধরা, দেখা ও বোঝা যায় না!
তাই ‘আত্মা’ বুঝতে হলে, আত্মার মতো অন্যান্য শক্তি সম্পর্কে জানতে হবে।
ধর্মীয় কাজের সঙ্গে সম্পর্কহীন কিছু হাদিসে দেখা যায়- প্রতিটি বস্তুর (জড় পদার্থের) আত্মা আছে। এ বিষয়টি সত্য বলে আমরা জানতে পেরেছি। বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত প্রমাণ করেছে যে, বিভিন্ন ধরণের ফোর্স ফিল্ড (force field) মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছে। বিজ্ঞানীরা হতবাক হয়ে যান, যখন তাঁরা দেখেন যে- এই সুবিশাল মহাবিশ্ব এতটাই নিখুঁত ও সু-সামঞ্জস্যপূর্ণ (fine-tuned universe) কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছাড়া তা সম্ভব না! কে নিয়ন্ত্রণ করছে এসব। এর উত্তর আমরা জানি।
যিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সাত আকাশ। দয়াময়- রহমানের সৃষ্টিতে কোনো খুঁত তুমি দেখতে পাবে না! আবার তাকিয়ে দেখো, কোনো খুঁত পাও কি? তারপর বার বার খুঁজে দেখো, দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে তোমার দিকে। [ ৬৭:৩,৪]
He created seven skies in layers. You do not see any discordance in the creation of the All-beneficent. Look again! Do you see any flaw? Look again, once more. Your look will return to you humbled and weary. [67:3,4]
বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত চারটি ফোর্স ফিল্ড খুঁজে পেয়েছেন। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স ফিল্ড (আলো), স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স ফিল্ড, উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স ফিল্ড ও গ্র্যাভিটি। এই ফোর্স ফিল্ড-গুলো মূলত আত্মা বা ‘প্রভুর আদেশ’ হিসেবে কাজ করে। যেমন- ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স ফিল্ড বা ‘বিদ্যুৎচৌম্বক ক্ষেত্র’ বা চৌম্বক ক্ষেত্র (magnetic field)।
একটি ‘ফোর্স ফিল্ড’ এবং একটি ‘আত্মা’ একই জিনিস হতে পারে; অদৃশ্য চৌম্বক ক্ষেত্র জড় পদার্থটিকে বিশেষ চরিত্র-বৈশিষ্ট্য দেয়। যা ধরা-ছোঁয়া বা দেখা যায় না; আবার তা জীবিত প্রাণীর মতো আচরণ করে! এই ধারণাটি যাচাই করার জন্য আমরা চৌম্বক ক্ষেত্র নিয়ে কিছু কথা বলবো।
১ (ক). কুর’আনে আত্মা
কুর’আনে, আত্মা (রুহ)-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- রুহ হলো আল্লাহর আদেশ।
They ask thee concerning the ruhh (soul). Say: “The ruhh is Command of my Lord.” Of knowledge, it is only a little that is communicated to you.
তারা তোমাকে রুহ (আত্মা) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন- ‘রুহ আমার প্রভুর আদেশ’ এই জ্ঞানের সামান্যই তোমাকে দেওয়া হয়েছে।
চলুন দেখি, চৌম্বক ক্ষেত্র কীভাবে ‘আদেশ’ বা ‘Command’ হিসেবে কাজ করে।
দৃশ্যপট ১:
আমাদের এই পৃথিবীর একটি বিশাল চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে। যা ‘সৌর বায়ুকে’ পৃথিবীতে প্রবেশে বাধা দেয়। ছবিতে (১.২) দেখা যাচ্ছে- কীভাবে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র সৌর বায়ু প্রতিরোধ করছে। চৌম্বক ক্ষেত্র নির্দেশ দিচ্ছে যে- “খবরদার! পৃথিবীতে ঢুকো না।” সৌর বায়ু পৃথিবীতে ঢুকলে গাছপালা-জীবজন্তু জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যেতো এবং পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ হতো না। যেমন- অন্যান্য কোনও গ্রহে হয়নি।
পৃথিবীর এই চৌম্বক ক্ষেত্র কীভাবে এলো? কীভাবে পৃথিবীতে এত বিশাল চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হলো ও লাখ লাখ বছর ধরে টিকে রইলো?
বিজ্ঞানীরা বলছেন যে- ঘূর্ণন, পরিবাহী ও বৈদ্যুতিক পরিবাহী তরল এমন চৌম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি সূর্যের মতো গ্যাসীয় বস্তুর ক্ষেত্রেও আয়নিত গ্যাস চৌম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে। যা বিজ্ঞানীদের নিছক ধারণা বা প্রমাণহীন অনুমান। চৌম্বক ক্ষেত্রের জন্য অবশ্যই চৌম্বকশক্তি-সম্পন্ন চুম্বক-দণ্ড প্রয়োজন; যার কোনোটাই পৃথিবী বা সূর্যে নেই। এ দাবিটিও বিজ্ঞানীরাই করছেন।
প্রকৃতপক্ষে, এই ‘শক্তি ক্ষেত্র’ বা ‘ফোর্স ফিল্ড’- ‘মহান আল্লাহর আদেশ’ হিসাবে বিশাল গ্রহ (জড় পদার্থ) পৃথিবীতে সুষ্ঠুভাবে কাজ করছে। পৃথিবীর জীবন্ত প্রাণীজগৎ এই দুর্দান্ত ‘চৌম্বক ক্ষেত্র’ ছাড়া কোনোভাবেই এক মুহূর্ত টিকতে পারে না। মাথার ওপর চৌম্বক ক্ষেত্রের এই ছাদ না থাকলে মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যেত সবকিছু।
যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বানিয়েছেন বিশ্রামের স্থান আর আকাশকে বানিয়েছেন ছাদ…
He who made the earth a place of repose for you, and the sky a canopy.. [০২:২২]
দৃশ্যপট ২
মূলত চৌম্বকত্ব- – ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক শক্তি (electromagnetic force) দিয়ে সৃষ্ট। এটি প্রকৃতির অন্যতম মৌলিক শক্তি। একটি চলমান বৈদ্যুতিক চার্জ এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হলে লম্বভাবে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়। মনে হয় যেন, চৌম্বক ক্ষেত্র ইলেকট্রনগুলোকে ধরে রাখছে ও যথাযথভাবে চারদিকে চৌম্বক ক্ষেত্র ধরে রাখার নির্দেশ দিচ্ছে।
এই ক্ষেত্রেও, চৌম্বক ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড Command বা আদেশের মতো কাজ করছে।
[যখন ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা চৌম্বক ক্ষেত্র ও
বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র একে অপরের সঙ্গে ছবির মতো ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে থাকে।]
- “The Field is sole governing agency of the particle” – Albert Einstein.
- “ক্ষেত্র হল কণার একমাত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা”– আলবার্ট আইনস্টাইন
অন্যকথায়, পৃথিবীর এই চৌম্বক ক্ষেত্রটি পৃথিবীর আত্মা- যা পৃথিবীর চারদিকে ছাদের মতো ঘিরে রেখেছে। এটি সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মিকে পৃথিবীতে ঢুকতে দেয় না।
১. খ. আকর্ষণকারী আত্মা Soul which attracts
বিদ্যুৎ চৌম্বক ক্ষেত্র শুধু বিকর্ষণই করে না- এই শক্তি আকর্ষণ করে বা ধরে রাখে। পরমাণুর গাঠনিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলেই তা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
আমরা জানি, প্রোটন কণা একে অপরকে বিকর্ষণ করে। একটি পরমাণুর শক্তিশালী নিউক্লিয়ার ফোর্স ফিল্ড প্রোটন কণাকে নিউক্লিয়াসের মধ্যে টেনে ধরে রাখে (ছবি ১.৪)। কিন্তু নিউক্লিয়াস ইলেক্ট্রনকে তার দিকে আকর্ষণ করে না; দূরে সরিয়ে রাখে।
এসব বিশ্লেষণে বোঝা যাচ্ছে, একটি ফোর্স ফিল্ড হলো একটি আত্মা/ Soul বা রুহ্। যা প্রয়োজন অনুযায়ী আকর্ষণ ও বিকষর্ণের কাজ করে থাকে।
এই পর্যায়ে এসে, আমরা বুঝতে পারলাম যে, ফোর্স ফিল্ড ও আত্মা মূলত একই জিনিস; কারণ, তাদের ভূমিকা ও কাজ একই রকম। তারা আল্লাহর দেওয়া সূত্র অনুযায়ী সুনির্ধারিত ‘আদেশ’ মেনে চলে। এই বাস্তবতা আরও যাচাই করা হবে।
২. আত্মার প্রকারভেদ Types of Souls
মহাগ্রন্থ আল কুর’আনে দুই প্রকার আত্মার কথা বলা হয়েছে:
- ক. রুহ (প্রাথমিক আত্মা)/ Ruhh (Elementary Soul)
- খ. নফস্ (যৌগিক আত্মা)/ Nafs (Composite Soul)
২ক. রুহ روح (মৌলিক আত্মা) Ruhh (Elementary Soul)
রুহ ( روح )কে প্রাথমিক বা মৌলিক আত্মা বলা যায়।
আরবি শব্দ ‘রুহ’-কে বাংলা ভাষায় ‘আত্মা’ হিসাবে অনুবাদ করা হয়েছে।
তিনিই রাতের বেলা তোমাদের মৃত্যু দেন এবং তিনি জানেন দিনের বেলায় তোমরা যা করো…
It is He who takes your souls by night, and He knows what you do by day…
কিন্তু রাতের বেলা ঘুমের সময় আমাদের শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জীবিত থাকে; তবে আমাদের সচেতনতা কাজ করে না। এই অবস্থাকে আল্লাহ মৃত্যু বলছেন। ঘুমের মধ্যে কেটে যাওয়া ১ মিনিট বা ১০ ঘণ্টা বা ৩০০ বছর বা লক্ষ কোটি বছরের মধ্যে আসলে কোনও পার্থক্য নেই। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে কল্পবিজ্ঞানে মহাকাশের অসীম দূরত্ব ভ্রমণে ‘হাইবারনেট’ চিন্তার উদ্ভব হয়েছে।
আসহাবে কাহফ বা গুহার অধিবাসীরা ৩০০ বছর ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু তাদের বয়স বাড়ে নি, তারা মৃত্যুও বরণ করে নি। অর্থাৎ কল্পবিজ্ঞানের ধারণাটিকে স্বীকৃতি দেয় কুর’আন।
ঘুমের সময় মানুষকে চেতনা বা consciousness দানকারী আত্মা চলে যায়; তাকেই মহান রব মৃত্যু বলছেন।
সৃষ্টির প্রথম মানব ‘আদম’ কিন্তু তখনই চেতনা-প্রাপ্ত হন, যখন আল্লাহ তাঁকে ‘রুহ দেন’ বা বিশেষ সেই আত্মা দেন। যাতে তিনি সচেতন হয়ে ওঠেন।
- আমি যখন তাকে সুগঠিত করবো এবং আমার পক্ষ থেকে তাতে রুহ সঞ্চার করে দেবো…
- আমি যখন তাকে নিখুঁত ও সুষম করবো এবং তার মধ্যে সঞ্চার করে দেবো রূহ, তখন তোমরা তার প্রতি সাজদায় অবনত
হয়ো [১৫:২৯; ৩৮:৭২]
মাতৃগর্ভে যখন ধাপে ধাপে শিশুর দেহ গঠন হতে থাকে, তখন সে শিশু নড়াচড়া করে, এপাশ ওপাশ করে, ঘুমায়, খায়, শারীরিক বিকাশ হতে থাকে- শুধু তার সচেতনতা থাকে না।
ভুমিষ্ঠ হবার পর কোনও এক মুহূর্তে শিশুটি সচেতনতা প্রাপ্ত হয় এবং চিৎকার করে কেঁদে ওঠে বা শব্দ করে। যেমন, সচেতনতা লাভ করেছিলেন আদম আ.- রুহ লাভের পর।
একইভাবে, এমন একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল সুদূর অতীতে একবার, যখন কোনও দিন, মাস, আলো- ছিল না! প্রত্যেক বিষয়ের ‘রুহ’ সংযুক্ত করে দেবার পর দেখা দিয়েছিল নতুন আলো- একটি নতুন মহাবিশ্বে। জেগে উঠেছিল সুপ্ত, ঘুমন্ত মহা-বিশ্বজগত। সুরা কদরে সেই তথ্যই জানানো হয়েছে। (পড়ুন সুরা কদর)
- পাঠানো হয়েছিল মালাইকা ও ‘রুহ’ রবের নির্দেশে- প্রত্যেক কাজের জন্য। {৯৭:৪}
- …বলো- রুহ হলো তোমার প্রভুর আদেশ। {১৭:৮৫} (Say, “The soul is the command of my Lord.)
এই রুহ হলো বিশেষ একটি আত্মা বা ফোর্স ফিল্ড- যা মানুষ লাভ করে মহান প্রভুর কাছ থেকে। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞান এই রুহ আবিষ্কার করতে পারে নি।
মহাজগত বা বিশ্বপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে যে চারটি মৌলিক শক্তি-ক্ষেত্র বা ফোর্স ফিল্ড আবিষ্কার করা গেছে তা হলো- স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স ফিল্ড (strong nuclear force field), ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স ফিল্ড (আলো), উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স ফিল্ড ও গ্র্যাভিটি। যা মূলত ‘স্রষ্টার আদেশ’ এবং এক ধরনের রুহ (Elementary বা মৌলিক আত্মা)। এই চারটি ফোর্স ফিল্ড-এর ওপর মানুষের কোনও নিয়ন্ত্রণ নাই। তারা সুনির্ধারিত আদেশ অনুসরণ করে চলেছে- ঠিক মানুষের রুহ বা আত্মার মতো।
মহান আল্লাহ একটি ‘ফোর্স ফিল্ড’ ডিজাইন করেছেন,উন্নত করেছেন এবং তা স্থির বা ফিক্সড করে রেখেছেন। বিশাল গ্যালাক্সি থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রতম কণা- ইলেকট্রন পর্যন্ত সবই নির্ধারিত ফোর্স ফিল্ডের আওতায় কাজ করে।
তাই একটি ‘পরিকল্পিত ফোর্স ফিল্ড’-কে আমরা একটি রুহ (এলিমেন্টারি বা মৌলিক আত্মা) বলতে পারি; যার সুনির্দিষ্ট কাজ করে এবং এই কাজে বাধা দেওয়ার শক্তি কারও নেই।
ছবির মাধ্যমে আবিষ্কৃত চারটি ‘রুহ’ বা প্রভুর নির্দেশকে দেখা যাক।
অতএব, আমরা একটি ‘রুহ’কে (একটি প্রাথমিক আত্মা) একটি ‘পরিকল্পিত ফোর্স ফিল্ড’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি- যা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে কাজ করে এবং সেসব রুহ দ্বিতীয় পর্যায়ের আত্মাকে সক্রিয় করে। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের আত্মা হলো ‘নফস্’।
২খ. নফস্نفس (যৌগিক আত্মা)
দ্বিতীয় পর্যায়ের আত্মাকে বলা হয় ‘নফস্’ (نفس)।
আরবি শব্দ ‘নফস্’কেও ‘আত্মা’ হিসাবে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা হয়। কারণ, রুহ ও নফসের মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি। কিন্তু রুহ ও নফসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে; যা পবিত্র কুর’আনের অসংখ্য আয়াতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিটি নফসকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে.. Every soul will taste death.. [আল কুর’আন ০৩:১৮৫]
আর তোমরা সে দিনকে ভয় কর, যেদিন কোনও নফস্ অন্য নফসের কাজে আসবে না।
And fear a Day when no soul will suffice for another soul.. [আল কুর’আন ০২:৪৮]
সুতরাং তার নফস্ তাকে বশ করল তার ভাইকে হত্যা করতে। ফলে সে তাকে হত্যা করল এবং ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হল।
And his soul permitted to him the murder of his brother, so hekilled him and became among the losers.
নিশ্চয় নফস্ মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়, তবে আমার রব যাকে দয়া করেন সে ছাড়া। Indeed, the soul is a persistent enjoiner of evil, except those upon which my Lord has mercy. [১২:৫৩]
আর যে তার মহান প্রভুর সামনে দাঁড়াবার ভয়ে ভীত ছিলো এবং নিজেকে আত্মার দাসত্ব ও মন্দ কামনা – বাসনা থেকে বিরত রেখেছিল।
But as for he who feared the position of his Lord and preventedthe soul from [unlawful] inclination [৭৯:৪০]
এসব এসব আয়াত থেকে দেখা যায়, মানুষের নফস্ তাকে মন্দ কাজে প্রবৃত্ত করে, এই নফস্ বিকশিত হয়, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং এক পর্যায়ে নফস্ মারা যায়। আবার হাশরের ময়দানে এই নফস্ জেগে উঠবে, প্রচণ্ড অসহায় থাকবে, সাহায্যের প্রয়োজন হবে, কিন্তু তা করতে পারবে না।
উপরের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এই নফস্ হলো ‘যৌগিক আত্মা’- দুই বা ততোধিক আত্মার (Elementary force field) সমন্বয়ে বা সংমিশ্রণে একটি নফস্ তৈরি হতে পারে।
মানুষের মতো প্রাণীজগতের সবার নফস্ রয়েছে। মানুষের চেয়ে বড় আকারের মস্তিষ্ক রয়েছে ডলফিনের। কিন্তু সেই মস্তিষ্ক ডলফিনকে উন্নত প্রাণী বানাতে পারে নি। অন্যদিকে, বিশেষ ধরনের সচেতনতা দেওয়া রুহ (মৌলিক আত্মা) মানুষকে বা মানুষের নফস্কে ক্রমান্বয়ে উন্নত করে চলেছে। আদিম যুগের গুহা-মানব থেকে শুরু করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মানবজাতির ক্রমবিকাশ সে প্রমাণই বহন করে।
অনেক প্রাকৃতিক ব্যবস্থারও এই নফস্ বা আত্মা আছে। যেমন, ক্ষুদ্রতম কণা অ্যাটম বা পরমাণু। একটি পরমাণু ম্যাগনেটিক ফোর্স ফিল্ড (a ruhh), উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স ফিল্ড (a ruhh) এবং স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স ফিল্ড (a ruhh) দিয়ে তৈরি হয়। এখানে অ্যাটম/ পরমাণু হলো একটি যৌগিক আত্মা- যা ৩টি মৌলিক আত্মা দিয়ে গঠিত। যৌগিক আত্মাকে Composite soul / কম্পোজিট সোল বলা যেতে পারে।
পরমাণুর নফস্ ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন কণাকে ধরে রাখে এবং পরমাণুর দেহ গঠন (atomic structure) করে। এরপরই মূলত পরমাণুটি তার নিজস্ব চরিত্র-বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। আর এই পরমাণুকে ধারণ করেন মহান রব্বুল আলামিন।
মহাকাশ ও যমিনে অণু পরিমাণ বা তার চেয়েও ক্ষুদ্রতর বা বৃহত্তম কিছুই তার দৃষ্টির অগোচরে নেই; যা আছে সুস্পষ্ট কিতাবে।
Not an atom’s weight escapes your Lord in the earth or in the sky, nor [is there] anything smaller than that nor bigger, but it is in a manifest Book. [১০:৬১]
অতএব, নফস্ হলো দুই বা ততোধিক মৌলিক ফোর্স ফিল্ড-এর সংমিশ্রণ। যা একটি ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখে; তার রূপ, প্রকৃতি/ চরিত্র নির্ধারণ করে এবং নির্দিষ্ট কাজ করে।
এই ব্যবস্থা অদৃশ্য পরমাণু থেকে শুরু করে দৃশ্যমান মহাজগৎ পর্যন্ত বিস্তৃত। মানুষ ও প্রাণীজগৎও তার ব্যতিক্রম নয়।
২গ. আলো ও সাব-এটমিক কণা (Light and Subatomic Particles)
আলো হলো ইলেক্ট্রো-চৌম্বকীয় শক্তি ক্ষেত্র বা ফোর্স ফিল্ড। আলোতে দুই ধরণের ফোর্স ফিল্ড রয়েছে। যেমন- বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র ও চৌম্বক ক্ষেত্র। সুতরাং, আলোও এক প্রকার নফস্- যা যৌগিক (Composite soul)।
বিজ্ঞান বলছে, মহাবিশ্ব গঠনের শুরুতেই আলো বা ‘সাব-এটমিক কণা’ (Subatomic Particles) তৈরি হয়ছিল। এই সাব-এটমিক কণাগুলো এক ধরনের নফস
৩.
পরমাণু ও মহাবিশ্ব
পরমাণু (atom) হলো মহাবিশ্ব গঠনের মৌলিক উপাদান (basic building blocks)। যখন পরমাণু তৈরি হয়ে যায়, তখন পরমাণু (atom) দিয়ে মহাবিশ্বও সৃষ্টি হয়ে যায়। দৃশ্যমান যা কিছু- সবকিছুই এই পরমাণু দিয়ে তৈরি।
একটি পরমাণু তৈরি হয় ফোর্স ফিল্ড (অনেকগুলো রুহ) ও সাব-অ্যাটমিক কণা (অনেকগুলো নফস্) দিয়ে। সুতরাং, নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এই মহাবিশ্ব বিভিন্ন ধরণের আত্মা (রুহ ও নফস্) দিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছে।
৪. নাফসিন-ওয়াহিদাতিন (একটি একক নফস্/ A Nafs Single)
কুর’আনে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ তার নিজের নফস্ থেকে একটি বিশাল নফস্ (যৌগিক আত্মা) প্রদান করেছেন। সেই ‘প্রদত্ত নফস্’ থেকে তিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। নিচের আয়াতগুলিতে সেই ‘প্রদত্ত নফস্কে’ নাফসিন-ওয়াহিদাতিন (একটি একক নফস্ বা a soul single) বলা হয়েছে।
হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে একক নফস্ থেকে (নাফসিন-ওয়াহিদাতিন) সৃষ্টি করেছেন… [আল কুর’আন ৪:১]
“তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একক নফস্ থেকে (নাফসিন-ওয়াহিদাতিন); তারপর তোমাদের জন্যে রয়েছে স্থায়ী ও সাময়িক ঠিকানা; যারা বোঝে তাদের জন্য আমরা আমার নিদর্শনগুলো বিস্তারিত বর্ণনা করি।” [আল কুর’আন ৬:৯৮]
তিনি তোমাকে একটি নফস্ একক (নাফসিন-ওয়াহিদাতিন) থেকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর অনুরূপ জোড়া তৈরি করেছেন (ডিএনএ ডাবল হেলিক্স); তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেন মাতৃগর্ভে- তিনটি অন্ধকার স্তর পার করে। তিনিই আল্লাহ্, তোমাদের প্রভু। সব কর্তৃত্ব শুধুই তাঁর। কোনো ইলাহ্ নেই তিনি ছাড়া। সুতরাং তোমরা মুখ ফিরিয়ে চলেছো কোথায়? [৩৯:৬]
হজরত ইসা আ.-এর কাছে নাযিল করা বাইবেলও ‘প্রদত্ত নফস্’ (নাফসিন-ওয়াহিদাতিন) সম্পর্কে বলা হয়েছে:
প্রথম দিকে, ঈশ্বর যখন মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন, তখন পৃথিবীর অস্তিত্ব ছিল না। সব কিছু ঢেকে রাখা উত্তাল সমুদ্র সম্পূর্ণ অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল; এবং ঈশ্বরের আত্মা জলের উপরে ঘোরাফেরা করছিল।– জেনেসিস ১ (১-২), পবিত্র বাইবেল, জিএনবি
ঈশ্বরের যে আত্মা, যা জলের উপর ঘুরছিল, তা স্বয়ং ঈশ্বর ছিলেন না। তা ছিল একটি আত্মা (নফস্ / যৌগিক আত্মা) যা ঈশ্বর প্রদত্ত। একটি ক্যাথলিক বাইবেলে এটিকে ‘ঈশ্বরের নিঃশ্বাস’ হিসাবে অনুবাদ করা হয়েছে; কারণ ঈশ্বর একে তার নিজের মধ্যে থেকে (ফুঁকে) ত্যাগ করেছিলেন।
ঈশ্বর, সময়ের শুরুতে স্বর্গ (আকাশ) এবং পৃথিবী (ভূমি) সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবী তখনো একটি খালি আবর্জনা এবং গভীর অন্ধকারে ঝুলে ছিল, কিন্তু ইতোমধ্যে এর জলের উপরিভাগ ঈশ্বরের নিঃশ্বাস আলোড়িত করেছে।
-জেনেসিস ১ (১-২), পবিত্র বাইবেল (নক্স)
ঈশ্বর মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্য তাঁর নিজের শরীর থেকে আত্মা ফুঁকে দিয়েছিলেন। পবিত্র কুর’আনে এই আত্মাকেই নাফসিন-ওয়াহিদাতিন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
যখন ঈশ্বর আদেশ করলেন, “আলো দেখা দিক”, তখন প্রদত্ত আত্মায় (নাফসিন-ওয়াহিদাতিন) আলো দেখা দিল:
“…Then God said: Let there be light. And the light began”
“…তখন ঈশ্বর বললেন, আলো হোক। আর আলো দেখা দিলো”
-জেনেসিস ১:৩, বাইবেল (নক্স)
বাইবেল থেকে দেখা গেল, নাফসিন-ওয়াহিদাতিন, যা ছিল একটি যৌগিক আত্মা (নফস্)। যা বিচ্ছিন্ন হয়ে আলো ও অন্যান্য শক্তির ক্ষেত্র (force fields) তৈরি করেছিল- “আলো তৈরি হোক” এই নির্দেশের আলোকে।
৫. নাফসিন-ওয়াহিদাতিন থেকে সামাওয়াত ওয়াল আরদ গঠন
মহান রবের নির্দেশ পাওয়া মাত্রই নাফসিন-ওয়াহিদাতিন বা যৌগিক আত্মা (নফস্) ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স ফিল্ড (আলো), স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স ফিল্ড, উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স ফিল্ড এবং অজানা অনেক ফোর্স ফিল্ডের উদ্ভব হলো। এই ধারণা সম্পূর্ণ বিজ্ঞান-সম্মত। একটি মৌলিক উপাদান ভাঙতে প্রচণ্ড পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। এটি একই সঙ্গে ধ্বংস ও সৃষ্টির খেলা। মহাকাশে এখনও লক্ষ কোটি নেবুলা বা নক্ষত্রের জন্মস্থান আছে- যেখানে বিস্ফোরণে নির্গত প্রচণ্ড শক্তি বা এনার্জি থেকে একের পর এক নক্ষত্র-রাজি তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
যাই হোক, মহান রবের নির্দেশে শক্তিশালী যৌগিক আত্মা (নফস্) ভয়াবহ শক্তি নির্গত করে ফোর্স ফিল্ড ও আলোতে রূপান্তরিত হলো (ভেঙ্গে গেল) এবং বর্তমান মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হলো। একেই বিজ্ঞানের ভাষায় বিগ ব্যাং বলা হয়।
এরপর মহাবিশ্ব আলোর গতিতে প্রসারিত হতে শুরু করলো এবং (বিস্ফোরণে সৃষ্ট) তাপমাত্রাও (লক্ষ কোটি বছর ধরে) কমতে শুরু করল। ফলে, নাফসিন-ওয়াহিদাতিন থেকে তৈরি হওয়া আলো সাব-অ্যাটমিক কণা (sub atomic particle) গঠন করা শুরু করল।
একটি পরমাণু (atom) আসলে কতটুকু ছোট?
মানুষের মাথার ছোট একটি চুলে ৫ লাখ কার্বন পরমাণু পাশাপাশি থাকে। মানুষের মুখমণ্ডলে আছে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পরমাণু যদি একটি পরমাণু মার্বেলের সমান ধরা হয়, তাহলে আপনার মুখমণ্ডলের আকৃতি কত বড় হবে জানেন? এই পৃথিবীর সমান!
এখানে উল্লেখ করা যায় যে, পবিত্র বাইবেলের উক্ত আয়াতগুলোতে পানির কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে (বিগ ব্যাং এর আগে) পানি সৃষ্টি করা হয়েছিল। ধারণা করা যায় যে, বিগ ব্যাং এর আগে আল্লাহ রব্বুল আলামিন আরেকটি বিগ ব্যাং ঘটিয়েছিলেন যা এই পানি তৈরি করেছিল। সম্ভবত, অসীম এই সুপার স্পেসে (এই মহাবিশ্বের বাইরে মহাকাশ) একটি বিশাল জল ভাসমান অবস্থায় ছিল। আমরা জানি- আরেকটি মহাবিশ্ব আছে, যার নাম জান্নাত। মূলত, সেই জান্নাতের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছিল পানি। মহাগ্রন্থ কুর’আনে জান্নাতের বর্ণনায় বার বার প্রচুর পানির কথা পাওয়া যায়। যাই হোক, সৃষ্টির আদিতে সেই পানির খুব সামান্য অংশই এই মহাবিশ্বে (সামাওয়াতে) দেওয়া হয়েছিল।
আল-কুর’আনে বলা হয়েছে যে- এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে নাফসিন-ওয়াহিদাতিন (আল্লাহ প্রদত্ত একটি বিশাল যৌগিক আত্মা) থেকে এবং বিজ্ঞান বলছে যে- বিগ ব্যাং তথা মহাবিশ্ব গাট ফোর্স (GUT: Force of Grand Unified Theory) থেকে তৈরি হয়েছে। তাহলে, আমরা খুব সহজেই ‘আত্মা’ ও ‘ফোর্স ফিল্ডকে’ (GUT Force) একই জিনিস হিসাবে বিবেচনা করতে পারি। বস্তুত, এটি একই জিনিসের (আত্মার) দুটি ভিন্ন নাম-মাত্র।
৬. মহাবিশ্ব ও পৃথিবী
বিশাল এই মহাবিশ্ব গঠন প্রক্রিয়ার একটি অংশ হলো মানুষ। কল্পনার অযোগ্য ক্রমশ বিস্তৃত এই মহাবিশ্বে প্রায় অদৃশ্য একটি গ্যালাক্সির নাম মিল্কিওয়ে (Milky Way)। সেই গ্যালাক্সির কোনও এক অদৃশ্য কোণায় অবস্থিত আমাদের পৃথিবী। সেই পৃথিবীর বুকে ভালো-মন্দ কর্মে লিপ্ত মানুষগুলোকেও আল্লাহ তাঁর নাফসিন-ওয়াহিদাতিন থেকে সৃষ্ট আত্মা এবং বিশেষ রুহ দিয়েছেন। পাশাপাশি এই মানুষকে তিনি খলিফার মর্যাদাও দিয়েছেন।
মহাগ্রন্থ আল-কুর’আনে মহান আল্লাহ বলেছেন:
The creation of the Universe and Lands are greater than the creation of mankind, but most of the people do not know. [Al Quran 40:57]
মহাকাশ ও যমিন-সমূহের সৃষ্টি মানবজাতি সৃষ্টির চেয়ে বৃহত্তর বিষয়, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ তা বোঝে না। [আল কুর’আন ৪০:৫৭]
৬. শেষ কথা
দৃশ্যমান মহাবিশ্বের তুলনায় আকার–আয়তনে অদৃশ্যের চেয়েও ক্ষুদ্রতম একটি অংশ মানুষ! সৃষ্টির অন্যান্য অংশের মতো মানুষও আত্মা (নফস্) পেয়েছে এবং সেই সঙ্গে মহান রবের দেওয়া বিশেষ আত্মা বা রুহ পেয়েছে।
এই দুয়ের অভূতপূর্ব সমন্বয়পর্ব ও বিকাশ চলছে পৃথিবীর জীবনে।
এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী? এসব জেনেই বা কী লাভ? কেনই বা মানুষকে সেই বিশেষ রুহ দিলেন রব্বুল আলামিন?
প্রচণ্ড গতিতে ধ্বংসের দিকে ছুটে যাওয়া এই মহাবিশ্ব এবং মানুষের মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সঙ্গে এর সম্পর্কই বা কী?
পাপ-পুণ্য বা শাস্তি ও পুরস্কারের সঙ্গে নফস্ বা রুহের সংযোগ কোথায়?
এসব নানা প্রশ্নের যৌক্তিক ও কুর’আনিক জবাব থাকবে পরবর্তী পর্বে।