সুন্নাহ বা সুন্নত কি

সুন্নাহ বা সুন্নত কি?

কুর'আন রিসার্চ সেন্টার- কিউআরসি

আরবি শব্দ সুন্নাহ বা সুন্নাত (سُنَّةَ) অর্থ- কাজ করার পথ বা পদ্ধতি (way of doing things or methodology)। মহাগ্রন্থ আল-কিতাবেও সুন্নাহ্‌ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। মহান আল্লাহও বেশ কয়েকবার সুন্নাহর কথা উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু তিনি কি বলেছেন? কোন বিষয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন? রব্বুল আলামিন কি আমাদের শেষ নবী মোহাম্মদ রসুলুল্লাহ  সা.-এর সুন্নাহ অনুসরণ করতে বলেছেন?

তিনি যাই বলবেন- একজন বিশ্বাসীর জন্য তা শিরোধার্য। চলুন দেখা যাক।

কুরআনে সুন্নাহ্‌র বিষয়বস্তু নিয়ে অনুসন্ধান করলে, চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাওয়া যায়:

ক) কুরআন শুধুমাত্র একটি সুন্নাহ্‌র কথা বলেছে, যার কোনও বিকল্প নাই; সেটা হলো- আল্লাহ্‌র সুন্নাহ (سُنَّةَ اللَّهِ)।

  • যারা অতীত হয়েছে, তাদের ব্যাপারেও এটাই ছিলো আল্লাহর সুন্নাহ্‌ (নিয়ম), তুমি কখনো আল্লাহর সুন্নতে পরিবর্তন পাবে না। {৩৩:৬২}

খ) নবী মুহাম্মদ সা.-এর জন্য নির্ধারিত একমাত্র অনুসরণীয় সুন্নাহ্‌ ছিল মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের সুন্নাহ্‌।

  • আল্লাহ্ নবীর জন্যে যা ফরয করেছেন তা বাস্তবায়নে তার কোনো বাধা নেই; অতীত নবীদের ক্ষেত্রেও এটাই ছিলো আল্লাহর সুন্নত; আর আল্লাহর নির্দেশ অবশ্যই একটি সুনিশ্চিত ফায়সালা। {৩৩:৩৮}

গ) কেউ আল্লাহর সুন্নাহ (سُنَّةَ) থেকে বিমুখ হতে পারবে না

  • তোমরা কখনও আল্লাহর সুন্নতে কোনো পরিবর্তন (no change) পাবে না এবং তোমরা আল্লাহর সুন্নতে কোনো ব্যতিক্রমও (no alteration) পাবে না। {৩৫:৪৩}
  • …এটাই আল্লাহর সুন্নত (سُنَّةَ), প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। তুমি আল্লাহর সুন্নতে কোনো পরিবর্তন পাবে না। {৪৮:২৩}

ঘ) চূড়ান্তভাবে, কুরআনের কোথাও নবী মোহাম্মদের সুন্নাহ্‌ বাক্যাংশ বা ধারণা (concept) পাওয়া যায় না।

দেখা যায় যে, মোহাম্মদ রসুলুল্লাহ একনিষ্ঠভাবে যে সুন্নাহ্‌র অনুসরণ করেছিলেন, তা হলো মহাবিজ্ঞানময় কুরআনে বিশদভাবে বর্ণিত মহান আল্লাহ্‌র সুন্নাহ্ (سُنَّةَ اللَّهِ)

যে কেউ, প্রিয় নবী সা.কে অনুসরণ করতে চাইলে- তিনি যা করতেন, আমাদেরকেও তাই করতে হবে। পবিত্র কুরআনে দেখা যায়, মোহাম্মদ রসুলুল্লাহ সবাইকে কুরআন অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। তাহলে রসুল সা.-কে অনুসরণ তখনই সার্থক হবে, যখন আমারাও তাই অনুসরণ করবো, যা স্বয়ং রসুল সা. অনুসরণ করতেন। আর তা হলো- আল্লাহর সুন্নাহ। আল্লাহ্‌র সুন্নাহ্‌র কোন বিকল্প নেই এবং পবিত্র কুরআনে মহাবিশ্বের সৃষ্টি, অদৃশ্য জিন ও মানুষের সৃষ্টি, গায়েবের জগতের ফেরেশতা, প্রাচীন অতীতের জনপদগুলো এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ে আল্লাহর পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে- তার বিস্তারিত বর্ণনা (কখনও ইঙ্গিত) দেওয়া হয়েছে।

যেহেতু মহাগ্রন্থে সুন্নাতুর রসুল বা রসুলের সুন্নাহ্র ধারণা নেইতাহলে গোটা সুন্নি বিশ্বের ভিত্তি কোথায়? আমরা কুরআন থেকে দেখেছি আতিউল্লাহ ওয়া আতিউর রসুল বলতে শুধুমাত্র রসুলের কাছে থাকা রিসালার আনুগত্যই বোঝায়। অর্থাৎ, আতিউল্লাহ ওয়া আতিউর রসুল মানে কুরআনের আনুগত্য ও অনুসরণ। তাহলে গোটা দুনিয়ায় ১৪০০ বছরের সুন্নি-মুসলমানদের ভিত্তি আসলে কী?

বর্তমান ইহুদি সম্প্রদায়ের নবী ও রসুল ছিলেন মুসা আ.। তিনি ছিলেন আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)। কিন্তু, বনি ইসরাইল তাওরাতের বিধিবিধান বা ‘দীন ইসলাম’ পরিবর্তন করে নতুন ধর্ম- ইহুদি সৃষ্টি করে ফললো। যার কেন্দ্রে রাখা হলো- মুসা নবী বা মোজেসকে।

ইহুদি জাজক ও তাদের তাওরাত
গির্জায় খ্রিষ্ট ধর্মের মানুষ

এই অবস্থা সংশোধনের জন্য রব্বুল আলামিন শক্তিশালী রসুল ও নবী ঈসা আ.কে পাঠালেন। তিনিও ছিলেন আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)। তৎকালীন সমাজের লোকজনও সুন্নাতুল্লাহ বা আল্লাহর সুন্নাত থেকে সরে গিয়ে ‘দীন ইসলামকে’ পরিবর্তন করে নতুন ধর্ম- খ্রিষ্টান বানালো। যার কেন্দ্রে রাখা হলো ঈসা নবী বা জিসাস খ্রাইস্টকে।

ওই দুটি ধর্মের কাছে তাওরাত কী বলেছে, বাইবেল কী বলেছে– সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো মুসা ও ঈসা। তারা আল্লাহর দীনকে সম্পূর্ণ বিকৃত করে ফেলল। ইসলামকে পরিবর্তন করে ভিন্ন ধর্ম সৃষ্টিকারীদের সতর্ক করে দিলেন আল্লাহ। তিনি বিকৃতি সৃষ্টিকারী ও অনুসরণকারী এসব লোকদের স্মরণ করিয়ে দিলেন তাদের পূর্বপুরুষ ইবরাহিম আ.এর কথা। তিনি বললেন- 

  • তোমরা ইবরাহিমকে নিয়ে কেন তর্ক করোঅথচ তাওরাত ও ইনজিল তো তার পরে নাযিল হয়েছে। তোমরা কি বিচার-বিবেচনা করবে না? {৩:৬৫}
  • ইবরাহিম ইহুদিও ছিলনা খ্রিষ্টানও ছিল না; বরং সে ছিলো একনিষ্ঠ মুসলিম; আর সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্তও ছিল না। {৩:৬৭}

এমন অবস্থায় পৃথিবীতে আবির্ভূত হলেন শেষ নবী মোহাম্মাদ রসুলুল্লাহ। যিনি নিয়ে এলেন মহাগ্রন্থ আল-কিতাব। যা পূর্ববর্তী নবী ও রসুলের কিতাবসমূহের স্বীকৃতি দেয়। তিনি নিজে ছিলেন আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) এবং মানবজাতিকে তিনি সব বাতিল, মনগড়া বিধি-বিধান থেকে মুক্ত করে তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ করার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) হতে নির্দেশ দিয়ে গেলেন। যেসব মানুষ এই উসউয়াতুন হাসানা বা উৎকৃষ্ট উদাহরণ মেনে চলবে, তারা মহান রবের সিরাতুল মুস্তাকিমে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।

এই অবস্থায়, স্রষ্টার দীনের মধ্যে যুগে যুগে যারা ফিরকা বা দল/ গ্রুপ তৈরি করে এসেছিল, তারা কোথায়? শেষ নবী মোহাম্মদ রসুলুল্লাহর উম্মতের মধ্যে তারা কোথায়? জিন-শয়তান এবং তার অনুসারীদের কার্যক্রম তো বন্ধ থাকার কথা নয়!!! তাহলে, ষড়যন্ত্রকারীরা এখন তারা কীভাবে কাজ করছে? এ বিষয়েও আল্লাহ আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন বহু আগে। যারা আল্লাহর বিধান মানতে চায়না, তাদেরও একটা কর্মপদ্ধতি বা সুন্নাত (سنة) আছে। সেইসব কুরআন বিরোধীদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন-

  • তারা এতে বিশ্বাস করে না; আর অতীতের (অপরাধীদের) সুন্নতও ছিলো এমন। {১৫:১৩}

এ বিষয়টি তিনি আরও ব্যাখ্যা করে বলেন-

  • আমরা এই কুরআনে বিভিন্ন রকম উপমার মাধ্যমে মানুষের জন্যে আমাদের বাণী বিশদভাবে বর্ণনা করেছি। অথচ মানুষ বেশিরভাগ বিষয়ে বিতর্কপ্রিয়। মানুষের কাছে যখন হিদায়াত আসে তখন তাদেরকে ঈমান আনা এবং তাদের প্রভুর কাছে ক্ষমা চাওয়া থেকে এ ছাড়া আর কিছুই বিরত রাখে না যে, তারা চায়, তাদের আগের লোকদের সুন্নতই (রীতিই) তাদের কাছে আসুক, তা না-হলে সরাসরি আল্লাহর আযাব আসুক। {১৮:৫৪,৫৫}

এমন অবস্থায় যে কেউ সুন্নাতুল্লাহ বা আল্লাহর সুন্নতের বাইরে গিয়ে স্রষ্টার জন্য, দীন ইসলামের নামে অথবা অন্য যে কোনও ‘সুন্নতের ধারণা’ তৈরি করবে এবং অনুসরণ করবে- সে অপরাধীদের দলে গণ্য হবে। কারণ, সুস্পষ্টভাবে সঠিক সুন্নত একটাই। তা হলো- আল্লাহর সুন্নত (سنة الله)। দীনের নামে নতুন যে কোনও বিষয়/ ধারণা সৃষ্টি করা পথভ্রষ্ট হবারই সমতুল্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *