জিন-সমগ্র (তৃতীয় পর্ব)
প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে আমরা মহাগ্রন্থ থেকে জিন সৃষ্টির উপাদান ও বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য জানতে পেরেছিলাম। এবার জিন জাতির বাসস্থান সম্পর্কে জানার ও বোঝার চেষ্টা করব।
৩. জিনের বাসস্থান
জিনদের গঠন ও কিছু বৈশিষ্ট্যের আলোকে বোঝা গেছে যে- এই মহাবিশ্বই হলো জিনদের বসবাসের উপযুক্ত স্থান। কীভাবে ও কেন? নিচে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হলো।
আমরা যদি মাহাবিশ্বের (universe) দিকে তাকাই তাহলে দেখি, পৃথিবীর মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই ভূখণ্ড/যমিন ছাড়া মানুষের বসবাসের আর কোনও স্থান নেই। খালি চোখে আকাশের দিকে তাকালে কয়েক কোটি নক্ষত্র চোখে পড়ে। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে মহাকাশ দেখলে দৃশ্যমান নক্ষত্রের সংখ্যা গণনার অযোগ্য হয়ে ওঠে। গত ৩০ বছর ধরে ‘হাবল স্পেস টেলিস্কোপ’ (Hubble space telescope) এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নিকষ কালো আঁধার ও উজ্জ্বল আলোর দিকে। বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র, লক্ষ-হাজার নক্ষত্রের বাসস্থান হাবলের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।
আমরা জানি গ্যালাক্সিতে আছে নক্ষত্র আর নক্ষত্রের সঙ্গে থাকে গ্রহ, উপগ্রহ। অথচ আজ পর্যন্ত পৃথিবীর মতো বা তার কাছাকাছি মানের কোনও গ্রহ (Planet) খুঁজে পাওয়া যায় নি- যেখানে প্রাণের বিকাশ হতে পারে! পৃথিবীর মতো ইউনিক বৈশিষ্ট্যের কোনও গ্রহ খুঁজে পাওয়া যায় নি। মার্কিন বিজ্ঞানীরা এবার মহাকাশে স্থাপন করেছেন হাবল-এর চেয়েও শতগুণ ক্ষমতাসম্পন্ন জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ (James Webb Space Telescope); যা শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য ধারণ করে বিজ্ঞানীদের তাক লাগানো শুরু করেছে।

এই তাক লাগানো মহাবিশ্বে আরেকটি ‘ইউনিক’ মানববসতি খুঁজে পাওয়া যায় না। পৃথিবী নামক গ্রহের বাইরে আর কোনও মানববসতি আছে– এমন কোনও ইঙ্গিত কুর‘আনে পাওয়া যায় না। বরং মহাগ্রন্থে বলা হয়েছে- এই পৃথিবীকে মানুষের ‘সাময়িক বাসস্থান’ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। স্বল্পকালীন বাসস্থান- একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে!
- বলা হলো, তোমরা নেমে যাও (اهْبِطُوْا)- তোমাদের কেউ কারো শত্রু (عْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ); আর যমিনের মধ্যে (فِى الْاَرْضِ) তোমাদের বসবাস ও জীবনোপকরণ (مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ)- নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত (اِلٰى حِيْنٍ)। {৭:২৪}
- … আর আমি বললাম- তোমরা নেমে যাও (اهْبِطُوْا)- তোমাদের কেউ কারো শত্রু (عْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ); আর যমিনের মধ্যে (فِى الْاَرْضِ) তোমাদের বসবাস ও জীবনোপকরণ (مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ)- নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত (اِلٰى حِيْنٍ)।। {২:৩৬}
পৃথিবীবাসীর জীবন অনন্তকালের নয়। মানবদেহের গঠন অনন্তকালের জন্য নয়। অন্যান্য সব প্রাণীর জন্ম ও মৃত্যু আছে। মানবদেহও তাই। তাত্ত্বিকভাবে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে- মানবদেহ অমর হতে পারে– তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ, মানুষের অমরত্ব তার চিরদিন টিকে থাকার নিশ্চয়তা দেয় না।
এর কারণ কি?
কারণ হলো, এই পৃথিবী নিজেই চিরকাল টিকবে না! প্রাকৃতিক কারণে পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য। পৃথিবীর প্রাচীনতম পাথরের radiometrically date নির্ধারণ করে নানা গবেষণার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন যে- পৃথিবীর বয়স কমবেশি ৫০ মিলিয়ন বছর বা ৪.৫৫ বিলিয়ন বছর। স্বাভাবিক কারণে, অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহের মতো পৃথিবীও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। যেই সূর্যের চারদিকে ঘুরছে এই পৃথিবী- সেই সূর্যেরও একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। অন্যান্য নক্ষত্রের মতো সূর্য নিজেও চিরস্থায়ী নয়।

সূর্যের বয়স ৪.৬০৩ বিলিয়ন বছর। সূর্যের ভেতর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জ্বালানিশক্তি আছে। এতে আগামী ৭/৮ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত সূর্য টিকে থাকতে পারবে। তারপর মহাবিশ্বের কোটি-কোটি-কোটি নক্ষত্রের মতো সূর্যকেও ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে পৃথিবীও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। গোটা কুর‘আন জুড়ে কিয়ামতের যে নিদর্শনগুলো বর্ণনা করা হয়েছে তা আমাদের সে দিকেই ইঙ্গিত দেয়।
যাই হোক, পৃথিবী সৃষ্টির পর দীর্ঘ এক প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে উত্তপ্ত পৃথিবী ক্রমশ শীতল হয়েছে। তারপর বিবর্তনের মাধ্যমে লক্ষ-কোটি প্রাণী তৈরি হয়েছে। অবশেষে এক পর্যায়ে পৃথিবীতে খুবই সামান্য একটি সময়ের জন্য মানুষকে পাঠানো হয় জান্নাত নামের মহাবিশ্ব (universe of different dimension- Jannat) থেকে- পৃথিবীর উপযোগী পোশাক বা স্পেসসুট দিয়ে।
আর আমাদের মানবদেহ হলো স্পেসস্যুট। যা শুধুমাত্র পৃথিবীর উপযোগী করে বানানো হয়েছে। এখন যদি কেউ পৃথিবীর আবহাওয়া-মণ্ডলের বাইরে যেতে চায় বা গিয়ে থাকতে চায়, তাকে ভারী স্পেসস্যুট পরতে হবে। হ্যাঁ, পৃথিবীর বাইরে আমাদের জানা মহাবিশ্বের কোথাও মানবদেহ টিকবে না। মজার ব্যাপার হলো যতদূর দৃষ্টি যায়, ততদূর ভ্রমণের শক্তি সামর্থ্যও মানুষের নাই।
আমাদের নক্ষত্র হলো সূর্য। সূর্যের পর কাছাকাছি যে নক্ষত্র আছে তার নাম প্রক্সিমা সেন্টুরাই। তার দূরত্ব ৪০ ট্রিলিয়ন ২০৮ বিলিয়ন কিলোমিটার। মানবজাতির কৃত্রিম উপগ্রহ ভয়েজার, যা মহাকাশে পাঠানোর পর প্রতি সেকেন্ডে ১৭.৩ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে ছুটে চলেছে। এই গতিতে প্রক্সিমা সেন্টুরাই নক্ষত্রতে পৌঁছাতে ভয়েজার স্যাটেলাইটের প্রয়োজন ৭৩ হাজার বছর! এতদিন টেকসই থাকার মতো কোনও পদার্থই মানুষ উদ্ভাবন করতে পারে নি এখনও। আর যদি (কল্পনায়) লাইট স্পিড বা আলোর গতিতেও যাওয়া যায়, তাহলে লাগবে সাড়ে চার বছর!


পাশাপাশি আমাদের সূর্য এবং আমরা রয়েছি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে। আমাদের সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সি হলো প্যাঁচানো গ্যালাক্সি- অ্যান্ড্রোমিডা। মিল্কিওয়ে থেকে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে কেউ যদি আলোর গতিতেও রওয়ানা দেয়- তার লাগবে ২০ লাখ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ, আলোর গতিতে ছুটলে ২০ লাখ বছর লাগবে! মানুষ আলোর গতি অর্জন করলেও তার সেখানে যাওয়া হবে না। কারণ, মানুষের স্পেসস্যুট বা মানবদেহের (Human body) মেয়াদ কমবেশি ১০০ বছর মাত্র।
আর যে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে আমাদের সূর্য অবস্থিত, অর্থাৎ আমরা থাকি- সেটা কিন্তু খুব বড় ও বিশেষ কোনও ধরনের গ্যালাক্সি নয়। অ্যান্ড্রোমিডা পর্যন্ত যেতে হলে তো মিল্কিওয়ের সীমানা থেকে আগে বের হতে হবে। এই মিল্কিওয়ের ব্যাস (diameter) হলো ১০৫,৭০০ আলোকবর্ষ! অর্থাৎ, আলোর গতিতে আপনার মহাকাশযান ছুটতে পারলে সূর্যের বাসস্থান- মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি পার হতে সময় লাগবে ১ লাখ ৫ হাজার ৭০০ বছর! এসব সংখ্যা ও তার বিশালত্ব ধারণা করার মতো মন-মগজ কি আমাদের আছে?
দেখা যাচ্ছে, মানুষ এই মহাবিশ্বের বিশালত্ব ও বড়ত্বের কাছে একেবারেই বেমানান অনুপযুক্ত।
শুধু কি তাই, পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলের বাইরে গিয়ে অল্প কিছুদিন থাকাও আমাদের জন্য বিপজ্জনক। ভয়াবহ রেডিয়েশন, তাপ ও চাপ-শূন্যতায় দেহ থেকে আত্মা বের হবার আগেই মারা যেতে হবে- এমন দুরবস্থা! মাথার ওপর ওই নীল আকাশের ওপরে যে মহাশূন্য আছে- যার মাঝে অনন্তকাল ধরে ধূলিকণার মতো ভেসে যাচ্ছি আমরা- তার কোথাও আমরা নিরাপদ না। এই পৃথিবী, যা আমাদের জন্য ক্ষণস্থায়ী বাসস্থান, তা ছাড়া কোথাও মানুষ মানানসই না। এটাই সার কথা।
তাহলে এই মহাবিশ্ব কার জন্য? কিসের জন্য? এই চিন্তা কি মাথায় আসবে না? জানা ও অজানা মহাবিশ্বে কে থাকে, কারা ঘুরে বেড়ায়? খুবই সাধারণ জিজ্ঞাসা। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কে দেবে তার জবাব!
- বলা হলো, তোমরা নেমে যাও (اهْبِطُوْا)- তোমাদের কেউ কারো শত্রু (عْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ); আর যমিনের মধ্যে (فِى الْاَرْضِ) তোমাদের বসবাস ও জীবনোপকরণ (مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ)- নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত (اِلٰى حِيْنٍ)। {৭:২৪}
মহাপ্রভু আমাদের নামিয়ে দিলেন। দাঁড়ান! আমাদের মানে? আমার শত্রুকেও নামিয়ে দিলেন। কে সেই শত্রু? আর কেউ নয়। আমাদের আলোচ্য বিষয়- ইবলিস; যে জিন জাতির সদস্য।
কিন্তু তাকে দেখা যায় না, ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। সে কীভাবে আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে। আমরা তা-ও আলোচনা করব।
পূর্ববর্তী ২টি পর্বে আমরা জিনের যে ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করেছি, তা থেকে স্পষ্ট যে, এই বিশাল অজানা দৈর্ঘ্যের মহাবিশ্ব একমাত্র জিন-জাতির জন্যই উপযুক্ত। এই মহাবিশ্বে তাদের অবাধ বিচরণ; শুধুমাত্র পৃথিবী ছাড়া। মহাবিশ্বের আর কোথাও পৃথিবীর মতো এত বৈচিত্র্যময় এত সুন্দর স্থান পাওয়া যায় না। এই পৃথিবী যেন জান্নাতের ক্ষুদ্রতম একটি টুকরা! আর গোটা মহাবিশ্ব ভয়াবহ একটি স্থান- মানুষের জন্য। কিন্তু জিনের জন্য তা ভয়াবহ নয়। বরং অ্যান্টিম্যাটারের তৈরি জিনের জন্য উপযুক্ত স্থান হলো এই মহাবিশ্ব। কারণ, সে বাঁচে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর। ইবলিস শয়তান-জিন কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতিকে বিভ্রান্ত করার কাজই করে যাবে। আর জিন জাতির মৃত্যুবরণের কোনও ইঙ্গিতই কুর‘আনে দেওয়া হয় নি। জিন জাতি মহাকাশের বিভিন্ন স্থানে ছুটে বেড়ায়, ওঁৎ পেতে বসে থাকে অদৃশ্য জগতের খবর সংগ্রহের জন্য (১৫:১৬-১৮)। মানবজাতি যে ডাইমেনশনে থাকে, জিনজাতি থাকে আরও উন্নত স্তরে (ডাইমেনশনে)। তারা তার চেয়েও উন্নত মালাক বা গায়েবের জগতের ডাইমেনশনের গোপন তথ্য হাতানোর চেষ্টা করে। তারা চোখের নিমেষে পালিয়ে যেতে পারে এখান থেকে লক্ষ-কোটি বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্বে। তাদের আছে সেই যোগ্যতা বা প্রযুক্তি।
মানুষের ধারণা ও পর্যবেক্ষণ শক্তি দিয়ে এই মহাবিশ্বের দূরত্ব ধারণা করা হয় ৪৬.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। এই দূরত্ব কত বড়ো- তা আমাদের মস্তিষ্ক উপলব্ধি করার যোগ্যতা রাখে না।
মহাজগতের প্রভু বলছেন- মহাকাশ ও যমিনসমূহের কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর, আর আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে শক্তিমান {৩:১৮৯}। যারা মহাকাশ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে তারা বলে ওঠে, হে প্রভু- আপনি এসব অকারণে সৃষ্টি করেন নি {৩:১৯১}।
চিন্তা করলেই বোঝা যায়- যেসব জায়গা মানুষের নয়, নিশ্চয়ই সেসব জায়গা অন্যকারও। আর কর্তৃত্ব ও ব্যবস্থাপনা হুকুম তো শুধুই নিরঙ্কুশভাবে তাঁর।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। সব জিন কি মানুষের শত্রু? সব জিন কি শয়তান?
কুর’আন থেকে জানা যায়, কিছু জিন মহাপ্রভুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তারা আল-কুর’আনকে হুদা বা পথনির্দেশ হিসেবে মেনে নিয়েছিল। তারা শয়তান নয়, মানুষের শত্রুও নয়। বরং তারা ভালো জিন। ঠিক যেমন, মানুষের মধ্যেও আছে ভালো ও মন্দ মানুষ।
যেমন মানুষের মধ্যেও কেউ-কেউ অন্যদের শত্রু / some of you enemy to others/ بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ {৭:২৪; ২:৩৬}। অর্থাৎ সবাই শত্রু নয়, সবাই খারাপ নয়। [بَعْضُكُمْ মানে তোমাদের কেউ/ কেউ কেউ]।
রেফারেন্স:
https://www.space.com/14732-sun-burns-star-death.html
httpswww.gsi.ieen-ieeducationour-planet-earthPagesThe-Earth-through-time.aspx
https://www.sciencefocus.com/space/the-voyager-mission-exploring-the-interstellar-void/
https://www.livescience.com/37009-human-body.htmlবলা হলো, তোমরা নেমে যাও ( اهْبِطُوْا)- তোমাদের কেউ কারো শত্রু (عْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ); আর যমিনের মধ্যে (فِى الْاَرْضِ) তোমাদের বসবাস ও জীবনোপকরণ (مُسْتَقَرٌّ وَّمَتَاعٌ)- নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত (اِلٰى حِيْنٍ)।