জিন-সমগ্র (চতুর্থ পর্ব)
ধারাবাহিক এই প্রবন্ধে আমরা জানিয়েছি-
১. জিনের সৃষ্টি; ২. জিনের বৈশিষ্ট্য; ৩. জিনের বাসস্থান।
এখানে জিনের ক্ষমতা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব।
৪. জিনের কিছু ক্ষমতা:
দ্বিতীয় পর্বে জিন জাতির বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছিল। মূলত তার মাধ্যমেই জিনদের ক্ষমতা সম্পর্কে জানা যায়। বৈশিষ্ট্য ও ক্ষমতা খুবই কাছাকাছি বিষয়- একে অপরের সঙ্গে জড়িত। তারপরও পাঠকদের স্মরণের জন্য আমরা সংক্ষেপে আরেকবার উল্লেখ করছি।
মূলত সুরা জিনের (৭২) মধ্যেই জিনদের বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্য ও ক্ষমতা উল্লেখ করা হয়েছে।
জিনদের চিন্তা-ভাবনা ও বিবেচনাশক্তি আছে। জিনরা সীমালঙ্ঘন করা এবং মহান আল্লাহর বিরোধিতা করারও ক্ষমতা রাখে। তারা সত্য-মিথ্যা কথা বলার স্বাধীনতা বা শক্তি রাখে। তারা মানুষের ওপর ‘رَهَقًا’ রহাকা/ ভারী চাপ বা বোঝা চাপাতে পারে।
তারা মহাকাশের (সামাওয়াত) বিভিন্ন অংশে যেতে পারে; তারা ছুটে বেড়াতে পারে এবং ঊর্ধ্ব জগত (upper dimension) থেকে নানা তথ্য জানার চেষ্টা করতে পারে। জিনরা هَرَبًا হারাবা/ফ্লাইট- এর মাধ্যমে বা প্রক্রিয়ায় মুহূর্তে বহু দূর-দূরান্তে পলায়ন করে থাকে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় তারা বিভিন্ন গ্যালাক্সি, এক আসমান থেকে আরেক আসমানে ভ্রমণ করতে পারে। হাজার-লাখ আলোকবর্ষ (Lightyears) দূরত্ব অতিক্রম করা জিনের জন্য কোনও সমস্যা নয়।
সুরা সাবা থেকে জানা যায়, বিশেষ সময় বিশেষ ব্যবস্থায় জিনরা শহর-নগর-বন্দর নির্মাণের কাজ করত বা ক্ষমতা রাখত। তারা বিশাল স্থাপনা তৈরি করা কিংবা সমুদ্রের গভীরে অভিযানে যেতো।
মনে রাখতে হবে, নবী সোলায়মান আ.এর সময় জিনরা বিভিন্ন কাজ করলেও মানুষকে ধরা বা স্পর্শ করার মতো ক্ষমতা তাদের নেই। এমনকি কোনও মানুষকে কোনও কাজে বাধ্য করতেও পারে না জিনরা। শয়তান-জিন বলবে,
- …তোমাদের উপর আমার কর্তৃত্ব (سُلْطَٰنٍ) ছিল না, আমি শুধুমাত্র তোমাদেরকে ডেকেছিলাম (دَعَوْتُكُمْ)- আর তোমরা সাড়া দিয়াছিলে (ٱسْتَجَبْتُمْ) আমাকে;…{১৪:২২}
এখানে সমাজের প্রচলিত ধারণা থেকে কিছু প্রশ্ন আসতে পারে। যেমন- জিন মানুষকে কীভাবে দেখা দেয়? কীভাবে মানুষের ওপর আসর করে? ভয় দেখায়? হুজুরদের সঙ্গে কথা বলে? তারা কীভাবে মাদ্রাসা মক্তবে লেখাপড়া করে? মসজিদে নামায পড়ে? ইত্যাদি।
কুর’আনের তথ্য ও বৈজ্ঞানিক উপাত্ত বলে- সমাজের প্রচলিত ধারণাগুলো সবই ধারণাপ্রসূত, অবৈজ্ঞানিক ও কুর’আনিক চেতনা বিরোধী। প্রচলিত এসব ধারণার সঙ্গে জিনের কোনও সম্পর্ক পর্যন্ত নাই!
জিনদের ক্ষমতা মহাগ্রন্থ আল-কুর’আনে যতটুকু জানানো হয়েছে মানুষ তাই জানতে পেরেছে। এর বাইরে তাদের অনেক ক্ষমতা থাকতে পারে- যা মানুষে জন্য অপ্রয়োজনীয়। যেসব তথ্য আল্লাহ রব্বুল আলামিন জানিয়েছেন- মানবজাতির জন্য তা যথেষ্ট। তা-ছাড়া গায়েবের প্রতি বিশ্বাসে- মহান রব্বুল আলামিন যে শর্ত দিয়েছেন, তার মধ্যে জিন জাতির প্রতি বিশ্বাস পড়ে না। তার একটা কারণ- জিনরাও মানবজাতির মতো পরীক্ষার মধ্যে আছে; তারাও মানুষের মতোই এক সৃষ্টি, একই মহাবিশ্বে তারা বাস করছে। মহাগ্রন্থ আল-কিতাব থেকে জিনরাও দিক-নির্দেশনা পেয়ে গেছে। জিন ও মানুষ- দুটি ভিন্ন ডাইমেনশনের বা জগতের উন্নত প্রাণী। তারা উভয়েই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে- অ্যান্টিম্যাটারের তৈরি কোনও প্রাণী বা পদার্থ দেখা বা স্পর্শ করা যায় না; যোগাযোগ করাও যায় না। কারণ তারা ভিন্ন ডাইমেনশনের বস্তু। ঠিক যেমন, মহান রব্বুল আলামিন এবং তাঁর আরশের মহা-সম্মানিত ফেরেশতাগণ সর্বোচ্চ ডাইমেনশনে থাকেন। এসব ডাইমেনশনের যে বাধা বা ব্যারিয়ার থাকে, তা কেউ পার হতে পারে না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। অর্থাৎ, আল্লাহর অনুমতি পেলে তাদের ডাইমেনশন বা এক জগত থেকে আরেক জগতে পরিভ্রমণের শারীরিক-মানসিক যোগ্যতা তৈরি হয়।
- হে জিন ও মানব সমাজ (يٰمَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْاِنْسِ) যদি তোমরা পার যে- (اِنِ اسْتَطَعْتُمْ اَنْ) মহাকাশ ও যমিনের সীমানা পার হবে (تَنْفُذُوْا مِنْ اَقْطَارِ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ) তাহলে পার হও (فَٱنفُذُوا۟); তোমরা পারবে না (لَا تَنْفُذُوْنَ) শুধুমাত্র কর্তৃত্ব দিয়ে/ অনুমোতি ছাড়া (اِلَّا بِسُلْطٰنٍ)। {৫৫:৩৩}
আরবিতে বিভিন্ন জগতের মধ্যে প্রতিবন্ধকতাকে বলা হয় বারজাখ। মহান রব্বুল আলামিন এসব প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন, বিভিন্ন জগতের সৃষ্টিকূলকে রক্ষার জন্য। স্বয়ং তাঁর নফসের যে শক্তি ও তীব্রতা, তা থেকে সব ডাইমেনশনের সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য তিনি মূল সত্তাকে বহু দূরে সরিয়ে রাখেন। তার মানে এই নয় যে- তিনি আমাদের দেখেন না বা শোনেন না।
- …হে আমার রব আমাকে দেখা দিন যাতে আপনাকে দেখি (رَبِّ اَرِنِيْٓ اَنْظُرْ اِلَيْكَ); বললেন- তুমি আমাকে দেখতে পারবে না (لَنْ تَرٰىنِيْ) তবে পাহাড়ের দিকে নজর দাও (وَلٰكِنِ انْظُرْ اِلَى الْجَبَلِ)- অতঃপর যদি (فَإِنِ) তা স্থির থাকে (ٱسْتَقَرَّ) তার স্থানে (مَكَانَهُۥ) তবে শিঘ্রই (فَسَوْفَ) তুমি আমাকে দেখবে (تَرَىٰنِى)…. {৭:১৪৩}
কিন্তু রব্বুল আলামিনের তাজাল্লি/ নুর কিছুটা প্রকাশ পাওয়া-মাত্রই পাহাড়-পর্বত ধূলিসাৎ হয়ে যায় এবং মুসা নবী শক্তির প্রখরতার কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সর্বোচ্চ ডাইমেনশনের জগত থেকে মহাবিশ্বের ডাইমেনশনে তাঁর শক্তির সামান্যতম অংশ প্রকাশ করা মাত্রই মহাপ্রলয়ের মতো ঘটনা ঘটে।
এ কারণেই মহাজগতের প্রভু যেদিন মহাবিশ্বকে নিজ শক্তির মধ্যে গুটিয়ে নেবেন- সেদিনটিই হবে ইয়াওমিদ্দিন বা কিয়ামত।
- …কিয়ামতের সময় (يَوْمَ الْقِيٰمَةِ) সব যমিন (وَالْاَرْضُ جَمِيْعًا) থাকবে তাঁর মুঠোয় (قَبْضَتُهٗ), আর আকাশগুলো থাকবে গুটানো (وَالسَّمٰوٰتُ مَطْوِيّٰتٌۢ) তাঁর ডান হাতে (بِيَمِيْنِهٖ)… {৩৯:৬৭}
মহাজগতের প্রতিপালক রব্বুল আলামিন সর্বোচ্চ ডাইমেনশন থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন ডাইমেনশনের প্রাণী (ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, মাইক্রোবস) সবার অবস্থা প্রতিমুহূর্তে অবলোকন করেন ও বিপদ-আপদ থেকে সবাইকে রক্ষা করছেন সব সময়। এজন্য তাঁর কোনও সময় ক্ষেপণ হয় না, কোনও বেগ পেতে হয় না, কোনও ক্লান্তি বা অবসাদের সৃষ্টি হয় না; এমনকি এজন্য তাঁর অন্যান্য কাজেরও কোনও ব্যাঘাত বা ঘাটতি হয় না।
দুনিয়ার সব প্রাণী ও মানুষের মস্তিষ্ক সংযুক্ত করলে যে অকল্পনীয় ও প্রচণ্ড শক্তিশালী ‘সুপার পাওয়ারফুল মস্তিষ্ক’ বা ‘ব্রেইন-পাওয়ার’ তৈরি হবে; সেই শক্তি যাবতীয় যত ধরনের দুর্বলতা বা খুঁত খুঁজতে পারবে— সব কিছু থেকেই মহান রব্বুল আলামিন সম্পূর্ণ মুক্ত! সুবহান-আল্লাহ! তিনি অকল্পনীয়-অতুলনীয় পর্যায়ের সু-মহান একক সত্তা!
তিনিই সময়ের স্রষ্টা, তাঁর কোনও সময়ের অভাব নেই!
তিনিই সীমানা নির্ধারণ করেন, তাঁর কোনও সীমাবদ্ধতা নেই!
তিনিই সব প্রাণীকে রিজ্ক দেন, তাঁর কোনও চাহিদা নেই!
তিনিই সব গুণের স্রষ্টা, তাঁকে কোনও নির্দিষ্ট গুণে বাঁধা যায় না!
তিনি সবার শুরু-শেষ বেঁধে দেন, তিনিই শুধু অনাদি-অনন্ত!
এমন রবের ইবাদ (বান্দা/ স্বাধীন দাস) হওয়া মানুষের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় নয় কী?
আমরা কয়েকটি ধাপ বা ডাইমেনশনের কথা বলেছি। একটির চেয়ে আরেকটি উন্নত ডাইমেনশনে যারা থাকে তারা বিশেষ সুবিধা লাভ করে- সে প্রমাণও দিয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুর’আন।
মনে করুন, খালি চোখে করোনাভাইরাসের মতো ক্ষুদ্র জীবাণু দেখা যায় না। এমনকি ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও করোনাভাইরাস দেখা যায় না, তবে তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। একজন মানুষ যতই চেষ্টা করুক কোনোভাবেই ভাইরাসকে ‘হাতের চাপা দিয়ে’ ধ্বংস করতে পারবে না। করোনাভাইরাসের কাছে মানুষের ফুসফুস আর অন্য প্রাণীর ফুসফুসের মধ্যে কোনও পার্থক্য নাই। নিজের তুলনায় বিশাল প্রাণীদেহ সে দেখতেও পায়না। ভাইরাস বাতাসে ভেসে ফুসফুস পর্যন্ত গিয়ে আশ্রয় নেয়।
কিন্তু মানুষ প্রযুক্তির মাধ্যমে করোনাভাইরাস সনাক্ত করতে পারে। অনেকটা সেরকম জিনরা উন্নত ডাইমেনশনের প্রাণী হওয়ায়, মানুষের ডাইমেনশনে সে নজর রাখতে পারে। আবার তার ওপরের উন্নত ডাইমেনশন বা স্তর–যেখানে ফেরেশতারা থাকেন- সেই ডাইমেনশনে তারা কিছু দেখতে পায়না।
তবে, ফেরেশতাদের ডাইমেনশন থেকে ‘মালাইকা’ জিনদের ডাইমেনশন এবং তার নিচে মানুষের ডাইমেনশন পর্যন্ত দেখতে পায়। আবার, সবকিছুর ওপরে রয়েছেন রব্বুল আলামিন; তিনি সব দেখেন, সব জানেন, সব কিছুর তত্বাবধান করেন।
মহাগ্রন্থ আল-কিতাব থেকে এই ধাপগুলো সম্পর্কে আমরা স্পষ্ট ধারণা পাই।
- … নিশ্চয়ই সে তোমাদের দেখে (يَرَىٰكُمْ) সে (هُوَ) ও তার জাতি (قَبِيلُهُۥ) যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখো না (لَا تَرَوْنَهُمْۗ) না;… {৭:২৭}
আমাদের ডাইমেনশনের চেয়ে উন্নত বা উপরের ডাইমেনশন হবার কারণেই এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। মানুষের ওপর জিনদের এই সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছে। কিন্তু মানুষকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা বা স্পর্শ ও পরিচালনা করতে পারে না। তাই আমরা স্বাধীনভাবেই নিজেদের পরিচালিত করি।
তারপরও জিনদের বিশেষ একটি ক্ষমতার কারণে তারা মানুষের একটি অংশকে প্রভাবিত করে। আর এই কাজে জড়িত থাকে ইবলিস ও তার অনুসারী শয়তান জিনের দল।
জিনদের বিশেষ এই ক্ষমতাটি মানুষের জন্য ক্ষতিকর। এর মাধ্যমেই সে মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে; আর মানুষ নিজের ক্ষমতাবলে সেই ক্ষতিকে বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ!