কুর’আনের আরবি টেক্সট ও অনুবাদের জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ: masadir.org; al-islam.org; tanzil.net; qurano.com

আয়াত-ভিত্তিক বিষয়

১. অসংখ্য জগৎ ২. ইয়াওমিদ্দিন ৩. ইবাদত ৪. সিরাতল মুস্তাকিম ৫. আল-কিতাব ৬. মুত্তাকি ৭. অদৃশ্যে বিশ্বাস ৮. আকিমুস সালাত ৯. রিজিক থেকে ব্যয় করা ১০. বিশ্বাস করো ১১. বধির-মূক-অন্ধ ১২. ভয় করো ১৩. বানানো ১৪. বিছানা ১৫. আকাশ হলো ছাদ ১৬. বৃষ্টির পানি ১৭. উৎপাদিত সামগ্রী- রিজক ১৮. তাঁর সমকক্ষ নেই ১৯. ইবাদ, বান্দা, দাস ২০. সুরা ২১. যৌক্তিক দাবি ২২. সুসংবাদ ২৩. আমলে সলেহ ২৪. জান্নাত ২৫. মনে থাকবে ২৬ সমজাতীয় বা সাদৃশ্যপূর্ণ ২য় পৃষ্ঠা

১. অসংখ্য জগৎ (Multiple Universes)

সুরা ফাতিহার শুরুতে ‘জগৎসমূহের প্রতিপালক’ বা ‘রব্বুল আলামিন’ সম্পর্কে জানা যায়। অসংখ্য জগৎ (universe) এর ধারণা শুরুতেই জানতে পারি আমরা। মহাগ্রন্থে ৬১বার বিশেষ্য পদ হিসেবে আ’লামিন الْعَالَمِينَ শব্দটি এসেছে। ৭:৫৪, ১০:১০, ২৬:২৪-এর মতো আরও কিছু আয়াত থেকে জানা যায়- এসব জগতের মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও জমিন (space & lands), জিনদের রহস্যময় জগৎ, কিয়ামতের পর নিয়ামতে ভরা জান্নাত, ভয়ঙ্কর শাস্তির জাহান্নাম, সুমহান আরশ- যেখান থেকে মহান রব্বুল আলামিন সব কিছু পরিচালানা করেন।

২. ইয়াওমিদ্দিন (A New Beginning)

د ي ن দিয়ে মহাগ্রন্থে ১০১টি শব্দ এসেছে (دِينِ ,الدِّينِ ,الدِّينَ ইত্যাদি)। বিভিন্ন স্থানে এটি দিয়ে- প্রতিদান, ধর্ম, আইন, ব্যবস্থা- ইত্যাদি অর্থ বোঝানো হয়েছে। সুরা ফাতিহায় বিশেষ একটি সময়ের কথা বলা হয়েছে- যা ‘ইয়াওমিদ্দিন’। ধারণা করা যায় সামাওয়াত ওয়াল আরদ যখন বিগ ক্রাঞ্চ (The Big Crunch)-এর পর্যায়ে যাবে, তখন নতুন করে মহাকাশ ও যমিনগুলো সৃষ্টি হবে, ফের গ্রহ-নক্ষত্র বা জাহান্নাম সৃষ্টি হবে। ভালো মানুষগুলোকে ভয়াবহ সেই দিন উদ্ধার করে জান্নাতে নিয়ে যাবেন সেই সময়ের/ দিনের মালিক। আকাশ ও যমিনসমূহ সৃষ্টির প্রথম মুহূর্তের মতো আরেকটি ‘দ্বিতীয় শুরুর মুহূর্ত’ হাজির হবে।

৩. ইবাদত (Power of Freedom)

মানুষ মাত্রই স্রষ্টার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। যারা শুধু আল্লাহরই ইবাদত করে- তারা শুধু তাঁর কাছেই সাহায্য চায়। স্রষ্টা-বিমুখ মানুষ আল্লাহ দেওয়া ক্ষমতা ব্যবহার করেই তাঁর ইবাদতে অস্বীকৃতি জানায়। যাবতীয় সৃষ্টির মতো মানুষেরও এই নিয়মের বাইরে যাবার সুযোগ নেই। তাই সঠিক ইবাদত সম্পর্কে জানা এবং তারই ভিত্তিতে আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করা জরুরি। ইবাদত হলো ‘সেই স্বাধীনতার শক্তি’, যা আল্লাহর পথে টিকে থাকার জন্য মানুষ ব্যবহার করতে পারে- অথবা ভিন্ন পথে যেতে পারে। তাই ইয়াওমিদ্দিনে বিরাট একদল ইবাদ বা বান্দা যাবে জাহান্নামে। অন্যদল ইবাদ যাবে জান্নাতে।

৪. সিরাতল মুস্তাকিম (straight path)

এই সেই পথ- যে পথ (সিরাত) মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যায়; যে পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ওঁত পেতে রয়েছে জিন-শয়তান। যে পথের দিশা আছে মহগ্রন্থে; যে পথ অনুসরণ করে যুগে যুগে সব নবী রসুল চূড়ান্ত সফলতা পেয়েছেন- সেই পথ হলো সিরাতল মুস্তাকিম। যার শেষ প্রান্তে রয়েছে মহান রবের ক্ষমা ও মহা-বিস্ময়কর জান্নাত। কুর’আনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা সিরাতল মুস্তাকিম থেকে আজ মুসলিম সমাজই বেশি দূরে সরে গেছে। তাই, কুর’আন বুঝে পড়েই সিরাতল মুস্তাকিমে ফিরে আসাই হতে পারে মানুষের একমাত্র মিশন।

৫. আল-কিতাব (The Kitab)

কিতাব শব্দটি এসেছে ك ت ب থেকে। এই তিনটি অক্ষর দিয়ে কুর’আনে ৩১৯বার নানা শব্দ এসেছে। কিতাব কি?
কিতাব হলো- কিছু বিষয়বস্তুকে একত্র করে একটি ব্যবস্থা তৈরি করা- যার বিষয়গুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। কিতাবের বিষয়বস্তু হতে হবে পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ, সঙ্গতিপূর্ণ, সম্পূর্ণ, সন্দেহ-মুক্ত ও সমন্বিত। এতে কোনও বৈপরীত্য থাকতে পারে না। এ বৈশিষ্ট্য যে কোনও ‘বইয়ের’ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যারা আল্লাহ সম্পর্কে সচেতন- বা মুত্তাকি; তারা এই কিতাব থেকে জীবনযাপনের পথ খুঁজে পায়।

৬. মুত্তাকি (Conscious of Allah)

মুত্তাকি/ মুত্তাকী শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে و ق ي অক্ষর থেকে। মুত্তাকিন-দের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার কিতাবের সঙ্গে তাদের জীবন পরিচালনা সম্পর্ক (২:২; ৩:১৩৮); কিতাব নিয়ে তাদের সতর্ক অবস্থা ও সচেতনতার কথা (২:৬৬; ৬৯:৪৮; ৫:৪৬) বলা হয়েছে। কিতাব মুত্তাকিদের জন্য হুদা ও উপদেশবানী। মুত্তাকিরা কিতাবের আয়াত ও নানা উদাহরণ থেকে উপদেশ নেয় (২৪:৩৪)। মুত্তাকিরা তাদের অদৃশ্য প্রভুকে ভয় করে এবং আসন্ন কিয়ামত সম্পর্কে থাকে ভীত-সন্ত্রস্ত (২১:৪৮,৪৯)।

৭. অদৃশ্যে বিশ্বাস (Believe in Unseen)

অদৃশ্য বিষয়াদি দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে তা অনুভব করা যায়। মানুষ তার আত্মা/ Soul/ নফস/ রুহ দেখে না। কিন্তু বিশ্বাস করতে বাধ্য। মানুষ মহাকাশের ডার্ক ম্যাটার ও এনার্জি দেখে না; কিন্তু বিজ্ঞানীরা তা অস্বীকার করতে পারে না। ভয়াবহ ব্ল্যাক হোল দেখা যায় না; কিন্তু যুক্তি-বুদ্ধি-প্রমাণ দিয়ে তার অস্তিত্ব বোঝা যায়- তাই বিশ্বাস করা হয়। এভাবেই মহান রবকে ও তাঁর ফেরেশতা- যাঁরা মূলত আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে আছে- তাঁদেরকে বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে। তিনি আখিরাতের বিষয়গুলোতে বিশ্বাস করতে বলেছেন। কারণ- সেসব দেখা যায় না। মূলত দেখা গেলে- বিশ্বাস করার সুযোগ থাকে না। এই বিশ্বাস করা বা না-করা একটি মৌলিক পরীক্ষা। 

৮. আকিমুস সালাত (Establish Slalt)

মুত্তাকিরা আকিমুস সালাত করে। কুর’আনে কমপক্ষে ৪৭ বার ‘সালাত কায়েম’ কথাটি বলা হয়েছে। সালাত শব্দটি আরবি ص ل و অক্ষর থেকে উদ্ভূত। মহাপ্রভুর নির্দেশ- পাঠ করো যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে কিতাবে এবং তুমি সালাত কায়েম করো। নিশ্চয়ই সালাত বিরত রাখে ফাহেশা ও বাজে কাজ থেকে; আর আল্লাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ; আল্লাহ্ জানেন তোমরা যা করো। (২৯:৪৫)। এ ছাড়া তিনি রসুলকে বলেছেন- তুমি সালাত কায়েম করো সূর্য ক্ষয়ে যাওয়া থেকে অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত এবং ফজরে কুর’আন; নিশ্চয়ই ফজরে কুর’আন সর্বদা খেয়াল করা হয়। (is ever witnessed) (১৭:৭৮)। আরও দেখুন ১১:৮৪-৮৭, ১১৪; ১৭:১০৬; ৭:২০৪,২০৫

৯. রিজিক থেকে ব্যয় করা (They spend)

মুত্তাকিদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য- ব্যক্তিগত অর্থ-সম্পদ থেকে ব্যয় করা। এই ব্যয় হতে পারে ব্যক্তিগত সীমা থেকে শুরু করে যে কোনও ভাল কাজে খরচ করা। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র ও বিশ্বের যে কোনও ভালো কাজে ব্যয় করা এর অন্তর্ভুক্ত। তিনি বলেন- তুমি বলো, তোমরা উত্তম যা কিছুই ব্যয় করবে, তা করো বাবা-মার জন্যে, আত্মীয়-স্বজনের জন্যে এবং এতিম, মিসকিন ও পথিক-পর্যটকদের জন্যে। আর তোমরা জনকল্যাণের যে কাজই করবে, আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত। (২:২১৫)

১০. বিশ্বাস করো (Do Believe)

মানুষকে বিশ্বাস করতে বলার নির্দেশ এবং তা মেনে নেওয়া কঠিন কোনও কাজ নয়। কারণ, বিশ্বাস করা সম্পূর্ণ মানসিক বিষয়। এতে চাকরি-ব্যবসা, জীবন-জগতের কোনও পরিবর্তন হয় না। কিন্তু প্রাথমিক এই ধাপেই অহংকার ও জেদের বসে এবং জেনে-বুঝে স্রষ্টাকে অস্বীকার করে একদল মানুষ। সব সমাজেই এমন অস্বীকারকারী রয়েছে। তারা বিশ্বাসীদের বোকা বলেও উপহাস করে। তারা মূলত ‘তথাকথিত জ্ঞানের’ অহংকারে অন্যদের উপহাসের পাত্র মনে করে। এই অহংকারই তাদের চোখ, মন ও মগজ তালাবদ্ধ করে দেয়- সে বিষয়ে সুরার আগের আয়াতগুলোতে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

১১. বধির-মূক-অন্ধ (Deaf, dumb & blind)

বধির-মুক-অন্ধত্ব একটি চরম অভিশাপ। এক ভয়াবহ দুর্যোগ যারা দুনিয়ার জীবনে অন্ধ থাকবে- পরকালে আরও খারাপ পরিণতি ভোগ করবে। এখানে কয়েকটি উদাহরণ ও উপমা দিয়েছেন মহান রব। [তাদের উপমা, ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে আগুন জ্বালায়; যখন আগুন চারদিক আলোকিত করে, আল্লাহ্‌ তখন তাদের আলো নিয়ে যান এবং তাদেরকে ঘোর অন্ধকারে ফেলে দেন, তারা কিছুই দেখে না। ২:১৭ কিংবা আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টির মতো, সাথে ঘোর অন্ধকার, বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুৎচমক। বজ্রের শব্দে মৃত্যুভয়ে তারা কানে আঙ্গুল দেয়। অথচ আল্লাহ্ কাফেরদেরকে ঘিরে রেখেছেন। ২:১৯

১৩. বানানো (Make, جَعَلَ )
পবিত্র কুর’আনে দেখা যায়, মহাজগতের প্রভু দুইভাবে তৈরি করেছেন। ২:২২-এ তিনি বলেন- জা’আলা বা বানানো। তিনি পৃথিবীকে সমতল, প্রশস্ত বা বিছানার মতো বানিয়েছেন; আরও বানিয়েছেন অন্ধকার ও আলো- জুলুমাতি ওয়ান নুর (৬:১)। একই আয়াতে প্রভু বলেন, তিনি সৃষ্টি করেছেন মহাকাশ ও যমিনসমূহ- সামাওয়াত ওয়াল আরদ্। সৃষ্টি করা বা খালাকা। তিনি সৃষ্টি করেছেন জিন ও মানুষ। মহাপ্রভু বলেছেন- তিনি হলেন আহসানুল খালক্ বা সর্বোত্তম স্রষ্টা। তিনি কিছু সৃষ্টি করেন, আর কিছু জিনিস বানান। যার অস্তিত্ব আগে ছিল না- শূন্য থেকে অস্তিত্ব দেওয়াকে তিনি বলেছেন সৃষ্টি বা খালাক্। আর সৃষ্ট জিনিস থেকে পরবর্তী জিনিসের অস্তিত্বকে তিনি বলেছেন জা’আলা বা বানানো।
১৪. বিছানা (Floor - فِرَٰشًۭا )
তিনি যমিনকে বানিয়েছেন (resting place/ couch) বিছান / বিশ্রামস্থল/ সমতল ইত্যাদি নানাভাবে বলা যায়। আরবি অভিধান অনুযায়ী ফারশা (فرش) অর্থ- কোন কিছুর ওপরের আবরণ, যা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। পৃথিবীর ভেতরের প্রচণ্ড উত্তাপ, টগবগে জ্বলন্ত, গলিত লাভার স্তরকে ঢেকে রেখে, তার উপর মানুষ-সহ সব প্রাণীর বাসস্থান ও চলাচল উপযোগী করা হয়েছে। আরবিতে মেঝে-কে বলা হয় ফারশা-floor surface. পৃথিবীর এই পৃষ্ঠদেশ কীভাবে গোটা পৃথিবীকে জড়িয়ে রয়েছে? কীভাবে তা লাখ লাখ বছর ধরে গড়ে উঠেছে? পৃথিবীপৃষ্ঠের ৭০ ভাগ পানি। বাকি ৩০ ভাগে রয়েছে ৭টি মহাদেশ; যা মূলত পাথরের স্তর। পানির নিচেও রয়েছে কাদা ও পাথর।
১৫. আকাশ হলো ছাদ (Sky is the Roof)
তিনি আকাশকে বানিয়েছেন উন্নতমানের ছাদ। আপাত অদৃশ্য স্তর কীভাবে ছাদ হয়? কিছু নাই- তাও ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়! ছাদ যদি মাথার ওপর কঠিন কিছু হয়, পৃথিবীর আকাশ কি কঠিন কিছু? মহান স্রষ্টা গোটা পৃথিবীকে ঘিরে দিয়েছেন বায়ুমণ্ডল দিয়ে। বাতাসের ঘনত্ব অনুযায়ী এখানেই রয়েছে কয়েকটি স্তর। সব স্তরই কি আকাশ বা ছাদ? মহাপ্রভু বলছেন- আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়। অর্থাৎ, যে স্তরে মেঘ ভাসে, সেই স্তর হলো আকাশ- সেখান থেকে পানি পড়ে। বিজ্ঞান বলছে- মেঘ ভাসে মূলত troposphere, stratosphere, mesosphere and thermosphere অঞ্চলে। এই স্তরগুলো হলো ছাদ। যা রক্ষা করে মহাবিশ্বের জানা অজানা ভয়াবহ বিকিরণ ও উল্কাপিণ্ডের কবল থেকে। এই স্তরেই কাজ করে পৃথিবীর শক্তিশালী চৌম্বক-ক্ষেত্র।
১৬. বৃষ্টির পানি (Rain droop)
মহাজগতের প্রভু আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। আর কেউ কি বৃষ্টি বর্ষণ করে? “তিনিই নাযিল করেন বৃষ্টি। (৩১:৩৪) তারপর আমরা যখন পানি বর্ষণ করি, তখন তা শস্য-শ্যামল হয় এবং আন্দোলিত হয়, আর তা উৎপন্ন করে সব ধরনের সুদৃশ্য উদ্ভিদ (৪১:৩৯)। তুমি কি দেখোনা, আল্লাহ্ই তো পরিচালিত করেন মেঘমালাকে, তারপর সেগুলোকে একত্র করেন, অত:পর পুঞ্জীভুত করেন, তারপর তুমি দেখতে পাও সেগুলোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে বৃষ্টির পানি (২১:৪৩)।” এ ছাড়াও দেখুন ২০:৫৩, ৭১:১১, ৮০:২৫ আয়াতগুলো। এসব আয়াতে পানি ও বৃষ্টি নিয়ে মহান আল্লাহ নানা বর্ণনা ও উপমা দিয়েছেন। এতে মানুষের জন্য চিন্তা-ভাবনার নানা উপকরণ রয়েছে।
১৭. উৎপাদিত সামগ্রী- রিজক (Provision)

বিভিন্ন আয়াতে মহান আল্লাহ বৃষ্টির পানি বর্ষণ ও তা দিয়ে ফলমূল ও উদ্ভিদ উৎপাদনের কথা বলেছেন। তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো- উৎপাদিত খাদ্যবস্তুই হলো মানুষের আসল রিজক। কোনও দেশ-সমাজ যদি সমৃদ্ধ ও নিশ্চিন্ত হতে চায়, তাকে অবশ্যই ‘রিজক’-এর বিষয়ে স্বনির্ভর হতে হবে। অর্থ-বিত্ত-বৈভব নিছক অর্থহীন হয়ে পড়বে যদি মানুষের পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী না থাকে। ধনী থেকে ভিক্ষুক পর্যন্ত- সবার প্রয়োজন উত্তম খাদ্য। রিজকের নিশ্চয়তা থাকলে জাগতিক কোনও সংকট মানুষকে দুর্বল করতে পারে না। তাই ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেও মানুষের রিজক উৎপাদনে মনোযোগী হওয়া উচিত। দেখুন ২:৫৭, ৬০, ১৭২, ২১২; ৩:২৭; ৫:৮৮, ১১৪; ৬:১৪২, ১৫১…

১৮. তাঁর সমকক্ষ নেই (One & Only)

রব্বুল আলামিন ১. যমিনকে সমতল ও প্রশস্ত করেছেন, ২. আকাশকে রক্ষণাবেক্ষণকারী ছাদ বানিয়েছেন, ৩. আকাশে মেঘ ও পানি দিয়েছেন ৪. তাই মাটিতে খাদ্যশস্য জন্মায়, ৫. মানুষ ও প্রাণীজগৎ সেই রিজক খেয়ে বাঁচে। সুস্পষ্টভাবে এই কাজ যিনি করেন- তিনিই আমাদের রব। তাই তাঁর সমকক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ হতে পারে কি? গোটা পৃথিবীতে যে কেউ এই ৫টি কাজ করতে পারবে- তিনিই হতে পারেন ইলাহ্। তিনি আর কেউ নন- স্বয়ং মহাজগতের প্রভু রব্বুল আলামিন। এক আয়াতেই প্রভু ব্যাখ্যা করে দিলেন মানুষের প্রতি লক্ষ কোটি বছরের অফুরান অনুগ্রহের কথা।
এই প্রাকৃতিক নিয়মই হলো মহান রবের বেঁধে দেওয়া ব্যবস্থাপনা। কে তাঁর এই ব্যবস্থার অংশীদার হতে পারে?

১৯. ইবাদ, বান্দা, দাস (Slave)

আল-কিতাব কার কাছে এসেছিল? নিঃসন্দেহে ইবাদত কি ও কেনতিনি মানবজাতির মাঝে সুউচ্চ মর্যাদার মানুষ। আর মহান রবের কাছে তিনি কি? তিনি আল্লাহর বান্দা, দাস বা ইবাদ (عَبْدِ)। মহান রবের ইবাদ বা দাস কখনও রবের হুকুম আহাকামের মতো হুকুম দিতে পারেন কি? অবশ্যই না। বরং, তিনি জগতের সব মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরভাবে সবচেয়ে বেশি দাসত্ব করেছেন। এজন্যই তিনি শ্রেষ্ঠ ইবাদ। একজন ইবাদ যা করে- তাই ইবাদত। ইবাদ ভুল ইবাদত করলে তার দায় ইবাদ-কেই নিতে হবে। কারণ, মহাপ্রভু ইবাদ-কে যে শক্তি দিলেন, ইবাদ তার অপব্যবহার করেছে। জিন ও মানুষ ছাড়া আর কেউ সত্য-মিথ্যা বাছাই করার অনুমোতি পায় নি। এজন্যে মানুষ ইবাদ-এর মর্যাদা পেয়েছে।

২০. সুরা سُورَةٖ (a chapter)

সুরা (س و ر) কি? মহাগ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়কে সুরা বলা হয়। এই আয়াতের মতোই আল্লাহ আবার চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন। ১০:৩৮ আর তারা বলে এটা সে বানিয়েছে? তাহলে এর মতো একটি সুরা নিয়ে এসো এবং আল্লাহকে ছাড়া যাকে ইচ্ছা ডাকো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। সবচেয়ে ছোট সুরা- আল কাউসার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এতে রয়েছে- শেষ নবীর প্রতি মহান রবের অনুগ্রহ; এজন্য রবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নির্দেশনা এবং তাঁর বিরোধিতাকারীদের ধ্বংসের ঘোষণা। অর্থাৎ, মানুষের জন্য প্রভুর সুসংবাদ, কৃতজ্ঞতা ও সতর্কতা। সব সুরাতেই কমপক্ষে এই তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর কারও পক্ষে প্রভুর মতো এমন দান করা সম্ভব নয়। এমন দানের ঘোষণা দেওয়াও সম্ভব নয়। চ্যালেঞ্জে নামার আগেই শত্রুর পরাজয় নির্ধারিত।

২১. যৌক্তিক দাবি (logical demand)

আল-কুর’আন জুড়ে মহাজগতের রব কিতাব অস্বীকারকারীদের চ্যালেঞ্জ করেছেন। চ্যালেঞ্জ মানেই হারজিত ও মেনে নেওয়ার দাবি। তোমরা সুরা বানাতে না পারলে- নিশ্চয়ই প্রভু বানিয়েছেন। সহজ যুক্তি। তারপরও যদি যুক্তি অস্বীকার করে- তাহলে পাথর ও আগুনের মধ্যে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হওয়া ছাড়া আর কোনও পথ নেই। রব্বুল আলামিন মানুষকে যুক্তি দিচ্ছেন! তাঁর নিজের তৈরি করা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, মানুষের জিজ্ঞাসু অন্তরে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন! কেন??? তিনি হুকুম দিলেই সব মানুষ মুসলিম হয়ে যায়! তিনি ব্যাপক স্বাধীনতা দিয়ে মানুষের নফসকে জাগ্রত করতে চাচ্ছেন! সুবহানাল্লাহ! তিনি মানুষের স্বাধীনতার শক্তি ব্যবহার করে জেগে ওঠার সুযোগ দিচ্ছেন। মানুষ যখন স্বেচ্ছায় সত্যের অনুসারী হয়, তখন তার চরিত্র, তার নফস, তার আত্মা উন্নত হয়। মহান রব্বুল আলামিন এই পৃথিবীতে সেইসব বিশুদ্ধ, জাগ্রত ও উন্নত নফস বাছাই করছেন।

২২. সুসংবাদ (good news)

জান্নাত লাভের শর্ত হিসেবে মহাজগতের রব ঘোষণা করলেন- যারা তাঁকে বিশ্বাস করবে এবং পৃথিবীতে আমলে সলেহ করবে, তাদেরকে তিনি জান্নাত দেবেন। বিশ্বাস করা সম্পূর্ণ অদৃশ্য বিষয়, যা আপনার রব জানেন। আর, আমলে সলেহ দৃশ্যমান কার্যক্রম। যা মানুষ দেখবে। সাধারণত মানুষ ভালো কাজের স্বীকৃতি দেয় এবং মানুষটিকে সম্মান করে। একজন জান্নাতের হকদার মানুষ দুনিয়াতে সম্মান পাবে, এমন ভাবা স্বাভাবিক। কারণ, তেমন একটি সুন্দর সমাজ গড়ার নির্দেশই মহান আল্লাহ দিয়েছেন। জান্নাতের পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি অসংখ্যবার বিশ্বাস ও আমলে সলেহ উল্লেখ করেছেন। এমনকি তাঁকে বিশ্বাস করা ও সেই বিশ্বাসে দৃঢ় থাকার নির্দেশও দিয়েছেন।

২৩. আমলে সলেহ (do righteous deeds)

আমলে সলেহ-এর সরল বাংলা হলো সৎকাজ বা ভালোকাজ। কেউ কেউ বলেন- সুবিধাজনক কাজ। অর্থাৎ, যেই ভালো কাজটি আপনার চারপাশের জন্য করা সুবিধাজনক, সেটাই আমলে সলেহ। তবে, এক্ষেত্রেও অসংখ্য আয়াতে রব্বুল আলামিন আমলে সলেহ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। বিভিন্ন ভাষায় এ শব্দের অর্থ যাই হোক-না-কেন, কোন ধরনের বিষয়কে ‘আমলে সলেহ’ বলে- সে সম্পর্কে ধারণা থাকলে মানুষের জন্য বোঝা একেবারেই সহজ ও সুবিধার হয়। দেখুন- আল্লাহ কোন ধরনের কাজগুলোকে আমলে সলেহ বলছেন।

২৪. জান্নাত (Gardens)

জান্নাত কি? পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ বার বার জান্নাতের কথা বলেছেন। সরল বাংলায় জান্নাত অর্থ উদ্যান বা বাগান। আবার কখনও জান্নাত বলতে গোটা জান্নাতের মহাবিশ্বকেই বোঝানো হয়। যেমন- বিভিন্ন স্তরের জাহান্নাম থাকলেও ‘জাহান্নাম’ শব্দ দিয়ে সার্বিকভাবে সব আযাবের স্থানকেই নির্দেশ করা হয়। তেমনি, বিভিন্ন স্তরের জান্নাত সম্পর্কে আমরা জানতে পারি আল-কিতাব থেকে। তবে, তা মানুষের মতো করে ধারণাই মাত্র। জান্নাতের বৈশিষ্ট্য মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে না। এজন্য বোধগম্য করে যে ধারণা দেওয়া হয়েছে- তার ভিত্তিতে জান্নাত সম্পর্কে কিছু বিজ্ঞানসম্মত ধারণা করা হয়েছে।

২৫. মনে থাকবে (remember)

জান্নাতিদেরকে রিজক দেওয়া হবে। এই আয়াতেও রিজক বলতে খাদ্য-সামগ্রী বোঝানো হচ্ছে। জান্নাতে দেওয়া ফলমূল দেখে সৌভাগ্যবানদের মনে পড়বে, তারা পৃথিবীতেও এমন রিজিক লাভ করেছিল। অর্থাৎ, পৃথিবীতে বৈচিত্র্যময় ফলমূল উপভোগ করতে পেরেছে- এমন লোক জান্নাতে থাকবে। তাদের কথাই আল্লাহ বলছেন। তাদের সুস্পষ্টভাবে মনে থাকবে পৃথিবীর জীবনের কথা। যাদের ফলমূলের কথা মনে থাকবে, তাদের নিশ্চয় বন্ধু-শত্রু, আত্মীয়-স্বজন এমনকি পৃথিবীর জীবনে যে কথাবার্তা হচ্ছে, তাও মনে থাকার সুযোগ আছে। চিরস্থায়ী সেই জীবনে থাকবে পবিত্র আঝওয়াজুন বা সঙ্গী।

২৬. সাদৃশ্যপূর্ণ / مُتَشَـٰبِهًۭا (resemblance)

গুরুত্বপূর্ণ শব্দ মুতাশাবিহান مُتَشَـٰبِهًۭا (resemblance); যার সরল অর্থ- একই ধরনের, সাদৃশ্যপূর্ণ, সমজাতীয়। মহাগ্রন্থ আল-কুর’আনের আয়াতগুলো মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। তার একটি হলো মুতাশাবিহান বা সাদৃশ্যপূর্ণ। কুর’আনের অনেক বাংলা অনুবাদক مُتَشَـٰبِهًۭا এর অর্থ- ‘অস্পষ্ট’ উল্লেখ করেছেন; যা ভীষণ আপত্তিকর। এই আয়াতে সুস্পষ্ট করা হয়েছে- ফল খাওয়ার সময় জান্নাতিদের মনে পড়বে- পৃথিবীতেও তারা সাদৃশ্যপূর্ণ বা مُتَشَـٰبِهًۭا ফলমূল খেয়েছিল!