আল্লাহ’র আরশ-১

আল-আরশ: কুর’আনিক দৃষ্টিকোণ (১ম পর্ব)

কুর'আন রিসার্চ সেন্টার- কিউ আর সি

আরশ কি ও কাকে বলে?

আরবি ভাষার অভিধানে ‘আরশ’ শব্দটির নানা অর্থ পাওয়া যায়। তবে, আমরা দেখবো, মহাগ্রন্থ আল-কিতাব আল-আরশ (الْعَرْشِ -The Arsh) কীভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং এ বিষয়ে কি তথ্য দিয়েছে।

আল-আরশ (الْعَرْشِ) নিয়ে প্রাথমিক এই আয়াতগুলো দেখা যাক।

৭:৫৪ নিশ্চয়ই তোমাদের রব (লালন-পালন-রক্ষাকর্তা) আল্লাহ- যিনি সৃষ্টি করেছেন (خَلَقَ) আকাশ ও যমিনসমূহ ছয় পর্যায়ে/ধাপে (اَيَّامٍ); অতঃপর তা (মহাবিশ্ব) দৃঢ় (ٱسْتَوَىٰ) হয় আল-আরশে (الْعَرْشِ) তিনি রাত ঢাকেন দিন দিয়ে যা তাকে অনুসরণ করে দ্রুতগতিতে এবং সূর্য, চাঁদ, তারকারাজি তাঁর নির্দেশের অনুগত (بِأَمْرِهِ); নিঃসন্দেহে তাঁর সৃষ্টির প্রতি তাঁরই নির্দেশ; মহিমাময় আল্লাহ জগত-সমূহের রব।

১০:৩ নিশ্চয়ই তোমাদের রব আল্লাহ- যিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশ ও যমিনসমূহ ছয় পর্যায়ে/ ধাপে (اِنَّ رَبَّكُمُ اللّٰهُ الَّذِيْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ فِيْ سِتَّةِ اَيَّامٍ) তারপর তা দৃঢ় (বিকশিত) হয় আল-আরশে (ثُمَّ اسْتَوٰى عَلَى الْعَرْشِ) পরিচালিত হয় সব বিষয় (يُدَبِّرُ الْاَمْرَ); তাঁর অনুমতি ছাড়া কোনো সুপারিশকারী নেই (مَا مِنْ شَفِيْعٍ اِلَّا مِنْۢ بَعْدِ اِذْنِهٖۗ); তিনিই আল্লাহ তোমাদের রব- অতএব তাঁর ইবাদত করো (ذٰلِكُمُ اللّٰهُ رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوْهُۗ ); তবুও কি শিক্ষা নেবে না (اَفَلَا تَذَكَّرُوْنَ)? 

২৫:৫৯ তিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এর মধ্যে যা আছে ছয় পর্যায়ে (سِتَّةِ اَيَّامٍ); অতঃপর তা দৃঢ় হয় আল-আরশে (ثُمَّ اسْتَوٰى عَلَى الْعَرْشِۚ); আর-রাহমানু (اَلرَّحْمٰنُ)অতএব তাঁর সম্বন্ধে যে অবগত তাকে জিজ্ঞেস করো (فَسْـَٔلْ بِهٖ خَبِيْرًا)

৩২:৪ তিনি আল্লাহ যিনি সৃষ্টি করেছেন (خَلَقَ) আকাশমণ্ডলী ও যমিনসমূহ/ মহাবিশ্ব এবং যা আছে তাদের মাঝে ছয় পর্যায়ে (سِتَّةِ اَيَّامٍ) অতঃপর তা দৃঢ় হয় আল-আরশের (ওপর)  (ثُمَّ اسْتَوٰى عَلَى الْعَرْشِۚ) তোমাদের জন্য তিনি ছাড়া (مِّنْ دُوْنِهٖ) নাই কোনো অভিভাবক (وَلِىٍّ) আর নাই সুপারিশকারী (شَفِيعٍ); তবে কি উপদেশ নেবে না (اَفَلَا تَتَذَكَّرُوْنَ)!

৫৭:৪ তিনি যিনি সৃষ্টি করেছেন (خَلَقَ) আকাশমণ্ডলী ও যমিনসমূহ/ মহাবিশ্ব ছয় পর্যায়ে (سِتَّةِ اَيَّامٍ) তারপর তা দৃঢ় হয় আল-আরশে (ثُمَّ اسْتَوٰى عَلَى الْعَرْشِ); তিনি জানেন যা কিছু প্রবেশ করে (يَلِجُ) যমিনে আর যা বের হয় (يَخْرُجُ) তা-থেকে এবং যা কিছু অবতীর্ণ হয় (يَنزِلُ) আকাশ থেকে আর যা কিছু ওঠে (يَعْرُجُ) তা-থেকে; এবং যেখানেই তোমরা থাকো তিনি তোমাদের সঙ্গে (مَعَكُمْ); আর আল্লাহ দেখেন তোমরা যা করো।

প্রচলিত অনুবাদ নয়; বরং কুরআনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বোচ্চ সঠিক অনুবাদ এগুলো।

প্রচলিত অনুবাদগুলোতে মহান আল্লাহকে দেহধারী কাঠামো কল্পনা করে তাঁকে বিশাল এক সিংহাসনে বসানোর চেষ্টা করা হয়েছে হাজার বছর ধরে! ২/১ জন এহেন আপত্তিকর অনুবাদ করলে- তাকে ভুল বলা যায়। কিন্তু ঝাঁকে ঝাঁকে অনুবাদক যখন সমস্বরে একই কথা বলে, তখন তা ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। সবার চূড়ান্ত অজ্ঞতা, মূর্খতা ও ষড়যন্ত্রের একটি বহিঃপ্রকাশ এমন কাজ।

ইস্তাওয়া কি? কীভাবে ইস্তাওয়া হয়? এরকম বিষয় বুঝতে আল-কুরআনের সাহায্যই নিতে হবে। কী বলা হয়েছে সেখানে? দেখুন ৪৮:২৯ বাক্য।

৪৮:২৯ মুহাম্মাদ আল্লাহর রসুল, আর যারা তাঁর সঙ্গে- তারা কঠোর অস্বীকারকারীদের (ٱلْكُفَّارِ) ওপর- সহানুভূতিশীল তাদের/ নিজেদের মাঝে; তাদের তুমি দেখবে বিনয়ের সঙ্গে অবনত/আত্মসমর্পিত ( رُكَّعًا سُجَّدًا-humbly submissive) তারা সন্ধান করে আল্লাহর দান (فَضْلًا مِّنَ اللّٰهِ) ও সন্তুষ্টি (وَرِضْوَٰنًا); তাদের চিহ্ন- চেহারাগুলোতে (وُجُوْهِهِمْ) সেই আত্মসমর্পণের প্রভাবে (مِّنْ اَثَرِ السُّجُوْدِ); তাদের এই উদাহরণ আছে তাওরাতে (فِى التَّوْرٰىةِ) এবং তাদের এই উদাহরণ আছে ইনজিলে (فِى الْاِنْجِيْلِ)- বীজের মতো (كَزَرْعٍ) বের হয় অঙ্কুর (اَخْرَجَ شَطْـَٔهٗ) অতঃপর শক্তিশালী হয় (فَاٰزَرَهٗ) অতঃপর মোটা হয় (فَاسْتَغْلَظَ) অতঃপর তা দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায় (فَاسْتَوٰى) তার কাণ্ডের ওপর (عَلٰى سُوْقِهٖ)- আনন্দিত হয় চাষিরা যেন তার কারণে জ্বালা হয় কাফিরদের (ٱلْكُفَّارَ); আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দেন যারা বিশ্বাস করে ও উপযুক্ত/ ভালো কাজ করে তাদের মধ্যে (مِنْهُم) ক্ষমা ও মহা পুরস্কার (مَّغْفِرَةً وَّاَجْرًا عَظِيْمًا)।

বলা হচ্ছে: ى عَلٰى سُوْقِهٖ  فَاسْتَوٰ   ফা-ইস্তাওয়া আলা সুক্বিহি… অতঃপর তা দৃঢ় হয় তার কাণ্ডের ওপর।

৪৮:২৯ বক্তব্য অনুযায়ী- বীজ থেকে (كَزَرْعٍ) বের হয় অঙ্কুর (اَخْرَجَ شَطْـَٔهٗ) অতঃপর শক্তিশালী হয় (فَاٰزَرَهٗ) অতঃপর মোটা হয় (فَاسْتَغْلَظَ) অতঃপর তা দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায় (فَاسْتَوٰى) তার কাণ্ডের ওপর (عَلٰى سُوْقِهٖ) এই অংশ সঠিক অনুবাদ নিশ্চিত হওয়ার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

উল্লেখ্য, যদি যথাযথ অনুবাদ করা হতো, তাহলে এই কষ্ট করার প্রয়োজন হতো না।

এখানে, কয়েকটি ধাপে বীজ থেকে অঙ্কুর বের হওয়া, মোটা হওয়া, শক্তিশালী হওয়ার পর- ফা (অতঃপর) তা (গাছটি) ইস্তাওয়া (দৃঢ় হয়/ it stands) তার কাণ্ডের ওপর (upon/on its stem) অংশ খেয়াল করুন। 

ঠিক একইভাবে উপরের সব আয়াত থেকে বোঝা যায়, ছয় পর্যায়ে/ ধাপে/ দফায় (ফি সিত্তাতি আইয়্যাম) গোটা মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়ে যে কাঠামো গড়ে উঠলো- তাতেই মহাবিশ্ব সুদৃঢ় হলো।

মোদ্দাকথা, সামাওয়াত ওয়াল আরদ বা মহাবিশ্বজগত যে কাঠামো বা পদ্ধতি বা ব্যবস্থার ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত/ দৃঢ় হয়েছে- তাকেই এক শব্দে আল-আরশ’ বলা হচ্ছে। অর্থাৎ, গাছের কাণ্ডের মতো যে কাঠামোগত ব্যবস্থা (structural system) বর্তমান মহাবিশ্ব বা ইউনিভার্সের বাস্তব অবস্থাকে ধারণ করেছে/ প্রতিষ্ঠিত করেছে/ দৃঢ় করেছেসেটাই আল-আরশ (The Arash)। বিশাল এক যৌক্তিক বাস্তবতা- যা ধারণা দিয়ে কিছুটা উপলব্ধি করা যেতে পারে। মানুষের তথ্য প্রাপ্তি ও জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা যত বাড়বে, আল-আরশ সম্পর্কে ধারণাও তত বিস্তৃত ও পোক্ত হতে থাকবে।

নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ আরশের ওপর গিয়ে সমাসীন হননি/ সেখানে গিয়ে বসেন নি! প্রচলিত সব অনুবাদে এ জাতীয় কথা বলা জঘন্য অজ্ঞতা ও মূর্খতার নামান্তর।

বরং, আল-আরশ প্রচণ্ড শক্তিমান আর-রহমানের ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল বা তাঁর শক্তি-ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সে কথা বলা হয়েছে ত্বহা ৫নং আয়াতে।

২০:৫ আর-রহমানের ওপর আল-আরশ দৃঢ় হয়েছে। 

অর্থাৎ, আর-রহমান হলেন তিনি যিনি প্রচণ্ড শক্তিধর, ক্ষমতাধর, যাঁর শক্তিমত্তাকে রীতিমত ভয় করতে হয়। তাঁর এই গুণাবলীর ভিত্তিতে আল-আরশ দৃঢ়ভাবে টিকে আছে!

১৬:৬৮ আয়াতে আরশ’ শব্দটির ধাতু আঈন-রা-শিন থেকে উদ্ভূত আরেকটি শব্দ–ইয়ারিশুন (يَعْرِشُونَ) > আরিশুন (عْرِشُونَ); যার অর্থ- নির্মাণ করা/ ধাপে ধাপে কাঠামো তৈরি করা।

১৩:২ আয়াতের বিস্ময়কর ও ভ্রান্ত অনুবাদে দেখা যায়- অনুবাদকগণ মহান আল্লাহকে রীতিমতো উঠিয়ে ছেড়েছে!

১৩:২ তিনি আল্লাহ যিনি আকাশমণ্ডলী উচ্চকিত/ সু-উচ্চ (রাফায়া) করেছেন খুঁটি ছাড়া- তোমরা দেখছো; তারপর তা দৃঢ় হয়েছে আল-আরশের ওপর..।

এখানে, ওই গাছের উদাহরণের মতো আকাশমণ্ডলীর ইস্তাওয়া বা দৃঢ় হবার কথা বলা হয়েছে। খুঁটি ছাড়া সুউচ্চ হলেও তা পড়ে যাওয়ার ভয় নেই মোটেও!

প্রাথমিক এই বক্তব্যগুলো থেকে আল-আরশ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। এর বাইরেও আল-আরশ নিয়ে আরও গভীর অর্থবোধক আয়াত আছে। 

তবে, বাস্তবতা হলো মহাবিশ্বের সীমা পরিসীমা যেহেতু নির্ণয় করা যায়নি, সেহেতু মহা-বিশ্বজগতের ম্যাপ তৈরি করা বা কাঠামো কেমনতা মানুষ জানে না। এমনকি অস্পষ্ট কাঠামোও নিশ্চিত হওয়া যায় না। আমাদের সৌরজগৎ- আমাদের গ্যালাক্সি এবং শক্তিশালী রেডিও টেলিস্কোপের দৃষ্টিসীমায় পাওয়া যায় আরও অসংখ্য গ্যালাক্সি। কাছাকাছি গ্যালাক্সি নিয়ে গড়ে ওঠে গ্যালাক্সি ক্লাস্টার। আর অনেকগুলো গ্যালাক্সি ক্লাস্টার যুক্ত করে পাওয়া যায় সুপার ক্লাস্টার। এরচেয়েও বড় কোনো গ্রুপ আছে কি? সেই খবর নেই মানবজাতির কাছে। মহাবিশ্বের দৃশ্যমান অংশে এমন গ্যালাক্সি ক্লাস্টারগুলো জুড়ে দিয়ে একটি মহা-বিস্ময়কর কাঠামো পাওয়া যায়, যার নাম লানিয়াকিয়া (Laniakea)। আমরা আল-আরশের কাঠামো পাচ্ছি না! তবে আমরা যে কাঠামোর অদৃশ্য-প্রায় সদস্য, সেই কাঠামো দেখতে কেমন

https://sservi.nasa.gov/articles/laniakea-our-home-supercluster/

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *