মানুষের ইতিহাস (৩)
কুর'আন রিসার্চ সেন্টার- কিউআরসি
৩. ফেরেশতা কীভাবে জানলেন?- একটি ভুল ধারণা
কথা হচ্ছিলো ফেরেশতারা কীভাবে জানলেন- মানুষ পৃথিবীতে ফ্যাসাদ ও রক্তপাতের ঘটনা ঘটাবে?
তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। চতুর্থ আরেকটি কারণ হতে পারে- এর আগে মানুষকে কোথাও পাঠানো হয়েছিল বা রাখা হয়েছিল, সেখানে মানুষ এমন কাজ করেছিল, যা দেখে ফেরেশতারা এই ধারণা করেছেন। জনৈক কুর‘আন গবেষক এই চতুর্থ দাবিটি করেছেন। তিনি বলেছেন- রুহ জগতে এমন একটি হলোগ্রাফিক ওয়ার্ল্ড বা পৃথিবী ছিল। সেখানে মানুষের আত্মাগুলো এমন কাজ করেছিল। তা থেকে মানুষের ভাগ্য লেখা হয়েছে এবং মানুষ এ কারণেই তার ভাগ্যের শিকলে বন্দী। মানুষের কিছু করার নেই। তবে এই ধারণাটি কুর‘আন সম্মত নয়। ধীরে ধীরে তা প্রমাণিত হবে।
- আর যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বলেছিলেন- আমি পৃথিবীতে খলিফা (প্রতিনিধি) বানাতে যাচ্ছি। তারা বলেছিল- আপনি কি সেখানে এমন কাউকে বানাবেন, যারা সেখানে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত করবে? আমরা স্বাভাবিকভাবে কাজ করছি / এগিয়ে নিচ্ছি- এভাবেই আপনার প্রশংসা করছি আর আমরা আপনার পবিত্রতা জানাচ্ছি; তিনি বলেছিলেন- আমি যা জানি তা তোমরা জানো না। {২:২৯}
ফেরেশতারা বলেছিলেন,
আমরাই স্বাভাবিকভাবে কাজ করছি / এগিয়ে নিচ্ছি- এভাবেই আপনার প্রশংসা করছি আর আমরা আপনার পবিত্রতা জানাচ্ছি।। (ওয়া নাহনু নুসাব্বিহু বিহামদিকা ওয়া নু-কদ্দিসু লাকা) মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের এই দাবিটিও অগ্রাহ্য করেন নি এবং ভুল বলেন নি। মহান আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করছে তাঁর সৃষ্টির সবকিছু। তবে নিশ্চয়ই সবার ওপরে আছে মালাইকা-রা। সম্মানিত ফেরেশতাগণ ধরে নিয়েছিলেন যে- রব্বুল আলামিনের যে কোনও কিছু সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো- সবাই নিরবচ্ছিন্নভাবে মহাজগতের প্রভুর প্রশংসা, তাসবিহ, গুণকীর্তন করবে।
তাঁদের এই দাবি ‘একমাত্র সত্য‘ হলে- মানুষকে খলিফা হিসেবে সৃষ্টি ও পৃথিবীতে পাঠিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই করার কোনও অর্থ থাকে না। অর্থাৎ এটি ‘একমাত্র সত্য’ নয়। আরও কিছু সত্যতা ও যৌক্তিক কারণ আছে। আর এ জন্যই রব্বুল আলামিন জবাব দিলেন- নিশ্চয়ই আমি যা জানি, তা তোমরা জানো না! (ক্বলা ইন্নি আ‘লামু মা লা তা‘লামুন)।
আল্লাহর সামনে উপবিষ্ট ফেরেশতাগণ ততটুকুই জানতেন যা তারা বলেছিলেন। কিন্তু তার বাইরে যে বিশাল অজানা জগৎ- সে সম্পর্কে জানেন একমাত্র আল্লাহ। সেই অজানা জগতের সঙ্গেই রয়েছে মানুষের সৃষ্টির সম্পর্ক ও সংশ্লিষ্টতা। “নিশ্চয়ই আমি যা জানি, তা তোমরা জানো না!” সরল বাংলায় এভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে- প্রশংসা ও গুণকীর্তনের বাইরে, তোমাদের চেনা-জানা কর্মকাণ্ডের বাইরে যে অজানা অংশ আছে- তার সঙ্গেই রয়েছে মানুষের মূল সম্পর্ক। সেটা আমি জানি কিন্তু তোমরা জানো না।
একটি উদাহরণ দেখা যাক। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ঘোষণা করলেন, একটি বিজ্ঞান মেলা হবে। যারা ভালো একটি প্রজেক্ট তৈরি করতে পারবে, তাদেরকে বিরাট পুরস্কার দেওয়া হবে। স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ব্যাপক আনন্দ-উৎসাহে বিজ্ঞান প্রজেক্ট তৈরিতে ব্যস্ত হবে। মেলা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় নির্বাচিত হবে। তাদেরকে অনেক উপহার উপঢৌকন, টাকা, সুযোগ-সুবিধা, সম্মান, গোটা স্কুলে ৩ দিনের ছুটি- ইত্যাদি দেওয়া হলো।
কিছুদিন পর দেখা গেল- সারা দেশে শিক্ষার্থীদের ‘বিজ্ঞান মেলা‘ আয়োজন করেছে দেশের সরকার। ছোট্ট এই স্কুল থেকে সবাই সেখানে অংশগ্রহণ করতে পারলো না। শুধুমাত্র স্কুলের ওই কয়েকজনের ছোট দলটিকেই জাতীয় পর্যায়ের মেলায় পাঠানো হলো। এখানেই শেষ নয়। জাতীয় পর্যায়েও ছোট্ট এই স্কুলের দলটি জয়ী হলো। তখন আন্তর্জাতিক সায়েন্স ফেয়ার ঘোষণা হলো। গোটা দেশ থেকে ৪/৫টি দলের মধ্যে অজানা এই স্কুলের ছোট দলটিকে পাঠানো হলো উন্নত বিশ্বের কোনও এক আন্তর্জাতিক ইভেন্টে।
এই যে ধাপে ধাপে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সামনে এগিয়ে যাওয়া–কখনোই পরের ধাপটি জানতো না শিক্ষার্থীরা। কিন্তু জানতো প্রধান অধ্যক্ষ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো আন্তর্জাতিক সায়েন্স কমিউনিটি।
স্কুল কলেজের গণ্ডি পার হবার আগেই মেধাবী ওই শিক্ষার্থীরা পেয়ে যায় উন্নত বিশ্বের গবেষণা প্রকল্পে কাজ করার স্কলারশিপ। ওই শিক্ষার্থীরা জানতো না পরবর্তীতে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। কিন্তু, তাদের জন্য অপেক্ষা করেছিল দুনিয়ার উন্নত প্রকল্পগুলো। যারা গোটা বিশ্ব থেকে ছেঁকে বের করছে মেধাবী মস্তিষ্কগুলো। অথচ সব মানুষের মস্তিষ্কের ওজন সমান। অনেকের আইকিউ লেভেলও একই রকম।
তারপরও বিশেষ পদ্ধতিতে মেধাবী মানুষগুলোকে বাছাই করে বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানিগুলো।
যাই হোক, এটি একটি উদাহরণ মাত্র।
তবে, স্কুলের শিক্ষার্থীদের মতো মানুষের মধ্যে ভালো ও মন্দ বাছাইয়ের প্রক্রিয়া আমরা দেখতে পাই। জান্নাত জাহান্নামের পুরস্কার ও শাস্তির কথাও আমরা জানতে পারি। তার পরেও কিছু আছে- সে ইঙ্গিত আমরা পাই।
যেমন বলা হচ্ছিল- ফেরেশতারা জান্নাতের কথা জানতেন। তারা বলতেই পারতেন, পৃথিবীতে মানুষ না দিয়ে জান্নাত জাহান্নামে ভালো ও মন্দ মানুষগুলোকে ভাগাভাগি করে দিলেই হয়। তা- তারা বলতে পারেন নি।
এমনকি ফেরেশতাদের বিস্ময়মাখা কথা শুনে আল্লাহ বলতে পারতেন– আমি মানুষের তকদির/ ভাগ্য বেঁধে দেবো। মানুষ কোনও ফ্যাসাদ ও রক্তপাত ঘটাতে পারবে না।
ব্যাস, ঝামেলা চুকে যেত। মানুষ অন্যায়, অপকর্ম করতে পারতো না। যারা দাবি করে- মানুষের ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত- তাদের দাবিও পূরণ হয়ে যেতো! কিন্তু তা হয় নি।
তকদির বা কদর নির্ধারিত করে দিলে মানুষের মধ্যে ভালো ও মন্দ আলাদা করার কোনও সুযোগ থাকে না। বরং আল্লাহ ফেরেশতাদের কথা বলার বা চিন্তা ভাবনা করে বিস্ময় প্রকাশ করার যে স্বাধীনতা দিলেন; তার চেয়েও বেশি স্বাধীনতা মানুষকে দিয়েছেন। চিন্তা-ভাবনা ও সেই আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করার স্বাধীনতা। তা নাহলে- কিয়ামত দিবসে মানুষ তো আল্লাহকে বলতে পারে- হে মহান আল্লাহ! আপনি আমাদের ভাগ্য বেঁধে দিয়েছেন- আমরা তো ভালো হতে চাইলেও ভালো হতে পারি নি। এখন কেন আমাদেরকে শাস্তি দেবেন???
মানুষ সে কথা বলবে না। বরং মানুষ তার স্বেচ্ছায় করা অপরাধের স্বীকৃতি দেবে। জাহান্নামিদের কথোপকথন পড়ে দেখুন।
উল্লেখ্য যে- মহান আল্লাহ মানুষকে যেসব বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস করতে বলেছেন- তার মধ্যে তকদির বা কদর বা ভাগ্য নেই। এটি মানুষের তৈরি করা বিধান- যা ইসলামের সঙ্গে যোগ করা হয়েছে- রসুল সা.-এর নাম দিয়ে।
মজার বিষয় হলো- এমন ধরনের দাবি ও অভিযোগ শেষ নবী রসুলুল্লাহর প্রতি তৎকালীন মুশরিকরা করেছিল। আর, আল্লাহ তাঁর নবীর মাধ্যমে উপযুক্ত যৌক্তিক জবাব দিয়েছিলেন। আল্লাহ আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন- তোমরা কি চিন্তাভাবনা করবে না?
মানে?
মানে- চিন্তা-ভাবনা করে সঠিক সিদ্ধান্তটা নাওনা কেন ??? কোন জিনিস তোমাদের বাধা দেয় ???
এমনকি আল্লাহ রব্বুল আলামিন ফেরেশতাদের চিন্তা-ভাবনাও বেঁধে দেন নি। এজন্যই ফেরশতাগণ চিন্তাভাবনা করে বিস্ময় প্রকাশ করে বললো যে- আমরাই তো আপনার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাসবিহ করছি; আর আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি।
আল্লাহ সাফ বলে দিলেন- নিশ্চয়ই আমি যা জানি, তা তোমরা জানো না! মানুষ সৃষ্টির কোন বিষয়টি ফেরেশতারা জানে না। আল্লাহ রব্বুল আলামিন কি মানুষকে সে বিষয়ে কোনও ইঙ্গিত দিয়েছেন আল-কুর‘আনে? সে বিষয়টিও আমরা অনুসন্ধান করার চেষ্টা করবো।
আপাতত, দৃশ্যমান জগতে মানুষের চেয়ে বৃহত্তম/ উন্নত/ শ্রেষ্ঠ বা আকবারু সৃষ্টি সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। এই বিশাল ‘সামাওয়াত ওয়াল আরদে’ কোনও কিছু করার ক্ষমতাই মানুষের নাই। এই বিশালত্বের কাছে মানুষ কতটা ক্ষুদ্র ও অদৃশ্য- তা তুলনা করার বা সেই ক্ষুদ্রতা পরিমাপের চিন্তা শুরু করার শক্তিও মানুষের নাই। এহেন নাজুক অবস্থায়- মানবজাতির সঙ্গে যোগাযোগ করে আল্লাহ রব্বুল আলামিন মানুষকে যে মর্যাদা দিলেন- তার যথাযোগ্য প্রশংসার অদৃশ্য ভাগের ক্ষুদ্রতম অংশের হক আদায়ের শক্তি, ক্ষমতা, সাধ্য ও যোগ্যতার কথা চিন্তা করার ‘সর্বনিম্নতম শক্তিও‘ মানুষের নাই।
তাহলে আমরা এখন যেভাবে প্রশংসা আদায় করি- তার পরিমাপ কতটুকু? তার পরিমাণ “সর্বনিম্নতম শক্তি বা যোগ্যতার” সর্বনিম্ন অংশের চেয়েও কম।
প্রতি সেকেন্ডের হৃৎস্পন্দন তাঁর অনুগ্রহ, প্রতি সেকেন্ডে স্নায়ুতন্ত্রের বৈদ্যুতিক ঝলকানি তাঁর অনুগ্রহ। মানবদের একটি কোষের মধ্যে এক মিনিটে যে পরিমাণ ঘটনা ও কাজ ঘটে থাকে- তার জন্য কতবার সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানানো যাবে–তার হিসাব করাই মানুষের পক্ষে সম্ভব না। অথচ গোটা মানবদেহে ৩৭.২ ট্রিলিয়ন কোষের ব্যাপারে মানুষ আসলে কী করতে পারে- তা ভাবার শক্তি গোটা মানবজাতির নাই!