জিন-সমগ্র (ষষ্ঠ পর্ব)
আগের অধ্যায়ে নফস সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। আমরা বুঝেছিলাম- পৃথিবীতে নফসকে বিকশিত করা হচ্ছে। যাতে মানুষ পরবর্তী গন্তব্যে সঠিকভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। এ কাজে বাধা দেয় জিন-শয়তান। তাই জিনের কবল বা উসকানি থেকে বাঁচতে হবে সচেতন ভাবে। কিন্তু কীভাবে? তাই জানার চেষ্টা করবো।
৬. নফসের সুরক্ষা (জিন থেকে বাঁচার উপায়)
আল্লাহ নিজে নফস তৈরি করেছেন ও সাজিয়েছেন। নিশ্চয়ই তিনি তার ধ্বংস চান না। বরং তিনি প্রতিটি নফস রক্ষা করতে চান। তবে, তিনি তাঁর অসীম জ্ঞান দিয়ে জানেন, অনেক নফস বিপথে চলে যাবে। তাদের ঠাঁই হবে জাহান্নামে। সেই জাহান্নামের ভয়াবহ কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মানুষ বা নফস-নির্ভর দেহগুলো পুনরায় সুগঠিত হবে। তখনই কেবল মানুষগুলো জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং মানুষের জন্য জাহান্নামের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে। সে প্রমাণ দেওয়া হয়েছে জাহান্নাম অধ্যায়ে। আর তা দীর্ঘ সময় পরের কথা, সে হিসাব করার সাধ্য মানুষের নাই। (পড়ুন- জাহান্নামের স্থায়িত্ব)
তবে, কোনও মানুষ যদি তার নফসকে পৃথিবীতেই ঠিকঠাক রাখতে পারে- তার জন্য মৃত্যুর পরই জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন আল্লাহ। তার কোনও দুশ্চিন্তা থাকবে না, কোনও ভয় থাকবে না। এত সুসংবাদ, এত শাস্তির হুমকি- সব কিছু্ই মানুষের নফসকে রক্ষা করার জন্য। আল্লাহর প্রতি বিনীত, অনুগত নফসগুলোকে বাছাই করার জন্য। কারণ, মানুষের ‘পরিপূর্ণ বিকশিত নফসই’ হলো প্রকৃত মানুষ। তিনিই তাঁর সৃষ্টি করা নফসকে রক্ষায় ‘পাহারাদার বা রক্ষক’ নিয়োগ করেছেন। তাঁরা হলেন ফেরেশতা।
- প্রত্যেক নফসের ওপর রয়েছে একজন রক্ষাকারী। {৮৬:৪}
এসব পাহারাদার ফেরেশতা থাকেন উজ্জ্বল নক্ষত্রে। রব্বুল আলামিন পৃথিবীর আকাশকে সাজিয়েছেন উজ্জ্বল নক্ষত্র দিয়ে। শুধুমাত্র দেখতে ভালো লাগবে- এজন্য? নিশ্চয়ই নয়। এর অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। ‘তারকা দেখে বন্দরে ভিড়বে জাহাজ’– এজন্য ? সেই যুগ বহু আগেই শেষ। আর কবে আপনি আকাশের নক্ষত্র দেখে সমুদ্রে নৌকা ভাসাবেন? কোনোদিন না!
- আমরা দুনিয়ার কাছের আকাশকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছি নক্ষত্ররাজি দিয়ে; যা রক্ষাকারী- প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তান থেকে। (And as protection against every rebellious devil) {৩৭:৬,৭}
- বরকতময় তিনি, যিনি আকাশে বানিয়েছেন বুরুজ এবং বানিয়েছেন একটি উজ্জ্বল প্রদীপ ও চাঁদ। {২৫:৬১}
- শপথ নক্ষত্র-শোভিত আকাশের! {৮৫:১}
অর্থাৎ, সুস্পষ্টভাবে বুরুজ হলো সূর্যের মতো নক্ষত্র। আর মানুষের নফসের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে নিকট আসমানের নক্ষত্র-মণ্ডলীর। সেই নক্ষত্রেই থাকেন ফেরেশতারা। সেখান থেকে এই মহাবিশ্বের স্তরে (dimension) বিচরণকারী মানুষের নফস রক্ষা করা হয়। হয়তো মনে হবে- পৃথিবীর মানুষ থেকে নক্ষত্রগুলো তো অনেক অনেক দূর!
বিষয়টি তেমন নয়। দূরত্ব এই দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা-সময় দিয়ে তৈরি মহাবিশ্বের (dimension) জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু ঊর্ধ্ব স্তরের সৃষ্টিরা তাদের স্বভাবসুলভ ক্ষমতা দিয়ে নিচের স্তরে বা জগতে অনায়াসে ঢুকতে পারে; এখানে দূরত্ব কোনও বিবেচ্য বিষয়ই নয়।
নফস রক্ষাকারী ফেরেশতারা যেহেতু যমিনে স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে-না; এজন্য তাদের দূরেই থাকতে হয়। এটা তাদের সীমাবদ্ধতা। তাই মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ‘নফস রক্ষণাবেক্ষণকারী ফেরেশতারাগণ’ থাকেন তাদের সুবিধার জায়গায়- নিকট আকাশের নক্ষত্রে। কারণ, এই নক্ষত্র হলো তাদের পাওয়ার হাউস (ধারণা করা যায়- ব্যাটারির মতো)।
- বলো- পৃথিবীতে যদি ফেরেশতারা স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতো, তবে আমরা অবশ্যই আকাশ থেকে (সামায়ি) তাদের জন্যে ফেরেশতাকেই রসুল হিসেবে পাঠাতাম। {১৭:৯৫}
আবার, মহান রব্বুল আলামিন মুসার সঙ্গে দেখা করার জন্য আরশ থেকে নেমে বহুদূর পথ পারি দিয়ে এখানে আসেন নি। বরং, সর্বোচ্চ স্তর (dimension) বা সর্বোচ্চ স্থান ‘আরশ’ থেকেই সব স্তর ভেদ করে তুর পাহারের ওপর ‘নুর’ প্রকাশ করেছিলেন মহান রব্বুল-আলামিন। এ এক অত্যাশ্চর্য সংযোগ পথ; যা ব্যবস্থা করেছেন মহাজগতের পরাক্রমশালী স্রষ্টা।
ফেরেশতাদের সঙ্গে নক্ষত্রের সম্পর্ক নিয়ে আরও একটু চিন্তা করা যাক। কেন তাঁরা সেখানে থাকে?
স্বাভাবিক যুক্তি অনুযায়ী- মানুষ যেমন দৃশ্যমান পদার্থের তৈরি (ম্যাটার- ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন)। তাকে টিকে থাকার জন্য এই পদার্থেরই তৈরি খাদ্যশস্য গ্রহণ করতে হয়; যা থেকে আমিষ, শর্করা, চর্বি ইত্যাদি শক্তি পাওয়া যায়।
জিন অ্যান্টিম্যাটারের তৈরি। হাবিশ্বের বিপুল পরিমাণ (৯৬%) ডার্ক এনার্জি থেকে শক্তি নিয়ে জিনরা টিকে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
তেমনি, ফেরেশতা নুর বা আলোর তৈরি। মহাবিশ্বে নক্ষত্রের আলোই সবচেয়ে বেশি। ‘মালাইকারা’ মহাবিশ্বের স্তরে এলে নক্ষত্রের ফোটন কণা (আলো) থেকে শক্তি নেয়। এর সঙ্গে তাদের স্বচ্ছন্দ-স্বাভাবিক থাকার তীব্র সম্পর্ক রয়েছে বলে বোঝা যাচ্ছে।
- তিনিই প্রভু সাইরাস নক্ষত্রের (ٱلشِّعۡرَىٰ)। তিনিই ধ্বংস করেছিলেন প্রথম আদকে, সামুদ জাতিকেও- যাদের একজনকেও বাকি রাখেননি। এর আগে নুহের জাতিকেও। এরা সবাই ছিলো বড় যালিম আর চরম বিদ্রোহী। এ ছাড়া তিনি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন উল্টে দেওয়া জনপদকে। তারপর তাদের আচ্ছন্ন করে নিয়েছিল আচ্ছন্নকারী আযাব। {৫৩:৪৯-৫৪}
অন্যান্য সুরা থেকেও জানা যায়, এসব সীমালঙ্ঘনকারী জাতিকে ধ্বংসের জন্য ফেরেশতা পাঠিয়েছিলেন রব্বুল আলামিন। আর সেখানেই বলা হচ্ছে- একটি সুনির্দিষ্ট নক্ষত্রের কথা। তারপর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়। অর্থাৎ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ফেরেশতারা ওই নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে পৃথিবীতে এসে ধ্বংস করে দিয়ে যায় সীমালঙ্ঘনকারী জাতিগুলোকে- আল্লাহর আদেশে। মহাবিশ্বের ডাইমেনশনে ফেরেশতাদের থাকার সঙ্গে নক্ষত্রের সম্পর্ক বেশ জোরালো ও সুস্পষ্ট। পাশাপাশি, এটা আল্লাহর কথা বলার একটি স্টাইল বা ধরণ। প্রতিটি বিষয় সংযুক্ত। তিনি খাপছাড়া, এলোমেলো কোনও কথা বলেন নি কোথাও।
যাই হোক, নক্ষত্রে অবস্থানকারী ফেরেশতারা মানুষের নফসকে শয়তান-জিনের অস্ওয়াসা বা কুমন্ত্রণা (Influence) থেকে রক্ষা করে।
- তার সামনে ও পেছনে (মু’আক্কিবাতুন) ফেরেশতা আসে- যারা আল্লাহর নির্দেশে তাকে রক্ষা করে। {১৩:১১}
- প্রত্যেক নফসের ওপর রয়েছে একজন রক্ষাকারী। {৮৬:৪}
ফেরেশতারা তাদের দায়িত্ব সবসময় পালন করেন, তাহলে কখন ও কীভাবে শয়তান কোনও মানুষের নফসের নিয়ন্ত্রণ নেয়?
যদি মহান আল্লাহই যদি মানুষকে রক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেন- তাহলে মানুষের শাস্তি ও পুরস্কার কীভাবে হয়? কীভাবে ভালো ও মন্দ আত্মা বা নফস পৃথক হতে পারে? এজন্য মহান রব্বুল আলামিন এই ব্যবস্থাটি তৈরি করেছেন।
- নিশ্চয়ই শয়তানকে তাদের বন্ধু বানিয়েছি- যারা বিশ্বাসী নয়। {৭:২৭}
- যারা বিশ্বাস করে এবং তাদের প্রভুর উপর আস্থা রাখে তাদের উপর তার (শয়তানের) কোনো কর্তৃত্ব নেই। সে তো কর্তৃত্ব খাটায় কেবল তাদের উপর, যারা তাকে বন্ধু বানিয়েছে, আর যারা মুশরিক। {১৬:৯৯,১০০}
অর্থাৎ, যারা আল্লাহকে, মহান প্রতিপালককে, নিজের সৃষ্টিকর্তাকে অবিশ্বাস করে, অস্বীকার করে- তখনই শয়তান-জিন মানুষের নফস দখল করার সুযোগ পেয়ে যায়। আর যে বিশ্বাসী বা মু’মিন মানুষ শিরকের অপরাধ করে ফেলে, সে মুশরিক হয়ে যায় এবং কাফিরদের দলভুক্ত হয়। নিঃসন্দেহে তখনই নফসের ওপর থেকে মহান রবের প্রোটেকশন/ পাহারাদার উঠে যায়। মহাগ্রন্থে মুশরিকদের- কাফির দলের অন্তর্ভুক্ত করেছেন রব্বুল আলামিন। শিরক অধ্যায়ে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এসব লোকের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন,
- আমরা জাহান্নামের জন্যেই তৈরি করেছি অনেক জিন ও মানুষকে। তাদের কলব আছে, তা দিয়ে বোঝে না; তাদের চোখ আছে, তা দিয়ে দেখে না; তাদের কান আছে, তা দিয়ে শোনে না। এরা হলো পশুর মতো, বরং তারা চেয়েও বেশি বিভ্রান্ত ও অচেতন। {৭:১৭৯}
- নিশ্চয়ই যারা অস্বীকার করে তারা সেই রকমই- তাদের তুমি সতর্ক করো আর নাই করো, তারা বিশ্বাস করবে না। {২:৬}
যাই হোক, এ অবস্থায় শয়তান-জিন থেকে নফসকে সুরক্ষিত রাখতে হলে, মহান আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া কোনও বিকল্প নেই। আসুন মহান রব্বুল আলামিনের শরণাপন্ন হই। দেখি- তিনি আমাদের কী করতে বলছেন।
মানুষের জন্য একের পর এক সামনে ও পেছনে (ফেরেশতা থাকে)- যারা আল্লাহর নির্দেশে তাকে রক্ষা করে…। ১৩: ১১
যারা ঈমান আনে এবং তাদের প্রভুর উপর ভরসা করে- তাদের উপর তার (শয়তানের) কোনও কর্তৃত্ব নেই। সে কর্তৃত্ব খাটায় তাদের উপর, যারা তাকে সহযোগী/ মৈত্রী বানিয়েছে এবং যারা মুশরিক। ১৬:৯৯, ১০০
যদি শয়তানের কোনও কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে, তাহলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি সব শোনেন, সব জানেন। যারা আল্লাহকে ভয় করে, যখন শয়তানের মন্দ চিন্তা তাদের স্পর্শ করে, তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চোখ খুলে যায়। ৭:২০০, ২০১
এবং বলো- ‘আমার রব, আমি আপনার কাছে শয়তানের কু-মন্ত্রণা থেকে আশ্রয় চাই; এবং আমি আরও আশ্রয় চাই- যাতে আমার কাছে তারা না আসে। ২৩:৯৭, ৯৮
জিন-শয়তানের প্রভাব থেকে নিজেকে ও পরিবারকে রক্ষার এটাই একমাত্র পদ্ধতি। তাঁর কাছে প্রার্থনা করা, আশ্রয় চাওয়া। কারণ তিনি সব শোনেন ও সব জানেন। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া সুরক্ষার পথ নাই।
যারা আল্লাহকে ভয় করে চলে- শয়তানের উসকানি টের পেলেই আল্লাহকে মনে করে এবং আল্লাহ তাদেরকে রক্ষা করেন। তোমরা বলো- হে আমার রব, আপনার কাছে আশ্রয় চাই শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে; এবং আমাকে রক্ষা করুন- শয়তান যেন কাছে আসতে না পারে।
মূলত, জিন শয়তানের হাত থেকে দুনিয়াতে নিজেকে রক্ষা করার মাধ্যমে নিজের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ- ‘নফসকে’ অপবিত্র ও বিকৃত হওয়া থেকে রক্ষা করা যায়। বিশুদ্ধ আত্মা ও বিশুদ্ধ চিত্তের মানুষ সহজেই ‘সত্য’ দীন ও রবের পাঠানো ‘হুদা’ দেখতে পায়। কারণ, তার চোখ ও কান– দেখা ও শোনার জন্য উপযুক্ত অবস্থায় থাকে। তার ‘ক্বলব’ থাকে সত্য মেনে নেওয়ার উন্মুক্ত ও শক্তিশালী।